গল্প- ইশারা




ইশারা
সাজ্জাক হোসেন শিহাব

সরস চ্যাটিংয়ের শুরু থেকে হাসছে সদ্য বাবা হওয়া হাসান। তার হাসি কিছুতেই থামছেনা। ঘোরও। সে এখন কী করবে তাও বুঝে উঠতে পারছেনা। কোনমতেই না। কিছুক্ষন আগে যার সাথে হাসানের ফেসবুকে চ্যাটিংয়ের দরুন এমনটি ঘটেছে সে আর কেউ না। সে হাসানের একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া চার ব্যাচের জুনিয়র এক মেয়ে। নাম রেবেকা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রেবেকা, হাসানের সাথে মাঝেমাঝে কথা বলতো। তা ছিলো শুধুই ক্যাম্পাসের বড়ো ভাই হিসেবে এবং সময়টাও ছিলো মাত্র দেড় বছরের মতো। একাডেমিক গ-ি পেরুলেও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তারা প্রায় একে অপরকে হাই, হ্যালো করতো। কিন্তু রেবেকা আজকের মতো এমন ধাঁচে হাসানের সাথে কথা বলতো না। হাসান প্রথমে রেবেকার এরুপ চ্যাটিং দেখে রসিকতা ভেবেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা এক গম্ভীর কথোপকথনে রুপ নেয়। এর আগেও ফেসবুকে রেবেকা হাসানকে নক করলেও আজকের নক করার ধরণটা একটু  ভিন্ন ছিলো। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে হাসান সাধারণত নিজের মোবাইলে ফেসবুক খুলে। মুহূর্তেই অগুনতি নোটিফিকেশান আসে। লাইক-কমেন্টের ফিরিস্তি নিয়ে যেনও স্বয়ং মার্ক-জুকারবার্গ হাজির হয়। নোটিফিকেশানে ঠিকঠাক না নজর দিলেও মেসেজ অপশানে ঠিকই চোখ আটকে রাখে হাসান। কারণ এখানে অনেক সময় অনেকেই তাকে বিপদে-আপদে খোঁজে। অনেক বার্তা এসেছে আজকের আধুনিক পোস্টেও। প্রাক্তন প্রেমিকা থেকে শুরু করে অফিসের সুন্দরী সহকর্মী পর্যন্ত আছে তালিকায়। হাসান সববার্তা খুঁটে খুঁটে পড়ে। এতো খবরের ভিড়ে তার চোখ আটকায় রেবেকার কথায়। রেবেকা হাসানের ফেসবুক-ইনবক্সে লেখেছে-আমি জানি, আমাকে আপনি ভালোবাসেন। খুব বেশি ভালোবাসেন।  হাসান রেবেকার এমন কথা দেখে কী বলবে তা বুঝতে পারে না। একটু ভাবনায় পড়ে সে। কিছুদিন আগে রেবেকার স্বামী বিদেশে গেছে। উচ্চ শিক্ষার আশায়। কতদিন আর হবে। বড়োজোর সাত মাস। স্বামীর অবর্তমানে রেবেকার এমন কথা মোটেও ভালো ঠেকলও না হাসানের। হাসান দেখছে, রেবেকা নামের পাশের বাটন সবুজ রংয়ের। এর মানে রেবেকা অনলাইনে আছে। তাই সৌজন্যতার খাতিরে হাসান লেখলো- এতদিন পরে বুঝলে? হাসানের বউ-বাচ্চা শ্বশুর বাড়ি গেছে। পুরো বাড়ি ফাঁকা। বাড়িতে বউ থাকলে হাসান কখনই এমনটি লিখতো না। হয়তো অন্যভাবে রেবেকার কথার উত্তর দিতো। কিন্তু সে এখন একটু সাহস নিয়ে রসিকতার আশ্রয় নিয়েছে। কারণ, বউয়ের অবর্তমানে শয়তান তার মনে একটু সাহস জুগিয়েছে। হাসানের মাঝেমাঝে এমনটি ঘটে। সে রেবেকার ফিরতি উত্তরের অপেক্ষায় আছে। ফেসবুক মানুষের মনের কথা বাইরে আনে। ব্যক্তিত্যকে প্রকাশ করে দেয়। ওপাশে বসে রেবেকা যে লেখছে, তাও বুঝা যাচ্ছে। হাসান চেয়ে থাকে। কিছুক্ষনপর রেবেকার উত্তর আসে-আমি আগেই বুঝেছি। যেদিন আমি ক্যাম্পাসে প্রথম গেলাম সেদিনই আমার দিকে আপনি কেমন ড্যাপ ড্যাপ করে তাকালেন, তখনই আপনার চোখের ভাষা আমি বুঝেছি। জানেন কিনা জানি না, না জানলে জেনে রাখেন। মেয়েদের একেকটা চোখ একেকটা রাডার। শক্তিশালী রাডার। এই রাডারে সহজেই পুরুষের মনের কথা ধরা পড়ে। হাসান একটু স্মৃতির সরুপথ আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। সত্যিই কি রেবেকার সাথে এমনটি ঘটেছিলো? কতো মেয়ে দেখেই তো এরুপ ঘটে, ঘটেছে। তাই বলে রেবেকার সাথে! কিছুতেই হাসান কিছু মনে করতে পারলো না। কিন্তু রেবেকার কথার সাথে সুর মিলিয়ে উল্টো বলল-ঐদিন আমার মতো তুমিও আমার দিকে ড্যাপ ড্যাপ করে তাকালেই তো ল্যাটা চুকে যেতো। আজকে হয়তো আমরা এক ঘরেই থাকতাম। এভাবে কষ্ট করে চ্যাটিং করতে হতো না। একটু দুষ্টুমি করে বলে হাসান। রেবেকা সাথে সাথে লেখে-সময় তো চলে যায়নি। জীবনও ছোটো না। একদম ছোটো না। হাসান উত্তর দেয়- তা ঠিক। জীবন একদম ছোটো না। আবার বড়োও না। রেবেকার বিদ্যুৎ বেগে উত্তর আসে- ঠিক বলেছেন। কষ্টে থাকলে, জীবনকে দীর্ঘ এক নদী বলে মনে হয়। আর সুখে থাকলে মনে হয়, জীবন খুবই ছোটো। হাসান, রেবেকার কথার মানে বুঝার চেষ্টা করে। তাহলে রেবেকা কী কষ্টে আছে? সে কি সেটাই বুঝালো? হাসান নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে। কিছুক্ষণ থেমে আবার ভাবে- কিন্তু রেবেকার তো কোনও কষ্ট থাকার কথা না। তার জানা মতে রেবেকার কোনও কিছুর অভাব নেই। তাই হাসান একটু পরে রেবেকাকে লেখে- জীবনকে তোমার দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে কেনও? আর তোমার এতো কষ্টই বা কিসের? তোমার স্বামী তো এখন কোরিয়ায় গেছে। দুদিন পর তুমিও যাবে। টাকা-পয়সা, ঘর-বাড়ি তোমার কোনও কিছুর অভাব নাই। এতো চিন্তা কিসের তোমার? রেবেকার ওপাশ থেকে এবার কোনও উত্তর আসে না। হাসান গলার ভেতর থেকে কথা বের করে বেশ জোরে নিজেকেই বলে- আমি কি রেবেকাকে কষ্ট দিয়ে দিলাম! এরপর সে রেবেকাকে আবার লেখে- কী হলো ? থেমে গেলে যে!  আমি কি তোমাকে কষ্ট দিলাম? তাহলে আমায় ক্ষমা করে দিও, রেবেকা। এবার রেবেকার উত্তর আসে- একেবারেই না। যাইহোক, আমার ছেলে কেমন আছে? হাসান উত্তর দেয়- বেশ ভালো আছে। ওর মায়ের সাথে ও এখন ওর নানুর বাড়ি আছে। ওপাশ থেকে সাথে সাথে উত্তর ফিরে আসে- বেশ। আপনি বাড়িতে তাহলে একা? আমার ছেলেকে কাছে রাখেননি! আমার ছেলে কি খুব জ্বালায়? হাসান বলে- একটু একটু জ্বালায়। আমার ছেলে খুবই স্মার্ট। একটু একটু জ্বালা তো সহ্য করতে হবেই। কী বলেন হাসান? স্যরি হাসান ভাই? রেবেকা, হাসানকে ভাই বলে। কিন্তু আচমকা হাসান দেখে তার খটকা লাগে।  কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দেয়- তা তো অবশ্যই। বাবা হয়েছি, ছেলের জ্বালা তো একটুআধটু সহ্য করতেই হবে। রেবেকা উত্তর দেয়- আমার ছেলে রাতে কখন ঘুমায়? রাত দশটায়। হাসান উত্তর দেয়। আমার ছেলে তো বেশ লক্ষ্মী। বাহ। দেখতে হবে তো ছেলেটা কার! হাসান এবার খেয়াল করে, রেবেকা প্রতিটি কথায় আমার ছেলে,আমার ছেলে বলছে। হাসান একটু বিরতি দেয়। সে কোনও কিছু লেখেনা। ওপাশ থেকে আবার কথা আসে- আমার ছেলের বাবা কখন ঘুমায়? হাসান এমন প্রশ্ন দেখে একটু থমকে যায়। তার শরীর যেনও কেমন কেমন করে। হাসান কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। অন্যপ্রান্ত থেকে আবার রেবেকার প্রশ্ন আসে- নাকি ছেলের মায়ের জ্বালায় ঘুম আসে না? এবার হাসান, রেবেকার প্রশ্নের উত্তর মজা করে দেয়- তা তো ছেলের মা ভালো জানে। সাথে সাথে রেবেকার কাছ থেকে লাভ স্টিকার আসে। রেবেকা আর হাসানের চ্যাটিং চলছে। এটা সেটা কতো কী। রাত এগারটো পর্যন্ত চলতে থাকে তাদের সরস চ্যাটিং। রেবেকা হাসানকে এক পর্যায়ে লেখে-ছেলের বাবার বুঝা উচিত, এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকা ছেলের মায়ের জন্য অসম্ভব। হাসান উত্তর দেয়- হক কথা। তাহলে ঘুমিয়ে পড়া উচিত। রেবেকা সাথে সাথে উত্তর দেয়- ছেলের মায়ের কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে। আপনার মতো রসকষহীন মানুষ এই রসবোধ সহজে বুঝতে পারেনা। আর যদি বুঝেই থাকে, তবে কালরাতে যেনও আমার সাথে দ্যাখা করে।

আমার বাড়িতে। রেবেকা নিজের বাড়ির ঠিকানা পাঠিয়ে দেয়। এই বলেই রেহেনা চ্যাটিংয়ের সব কথোপকথন ডিলিট করে দেয়। শুধু বাড়ির ঠিকানা ছাড়া। এরপর রেবেকা অফলাইনে চলে যায়। এমন ঘটনার পর কোনো পুরুষের চোখে ঘুম আসার কথা না। হাসানের চোখেও ঘুম এলো না। হাসান প্রায় একটা নির্ঘুম রাত কাটালো। পরেরদিন সে অফিসে যায় না। বাড়িতে বসে থাকে। সারাদিন ধরে রেবেকাকে সে অনলাইনে পায় না। অবশেষে সন্ধ্যার সময় হাসান রেবেকাকে একবার অনলাইনে পায়। রেবেকা অনলাইনে এসেই হাসানকে নক করে- আপনি এখনও আসলেন না! আমি আপনার অপেক্ষায় আছি। একথা লেখেই সে আবার অফলাইনে চলে যায়। আর সে অনলাইনে আসেনা। হাসান অনেক চিন্তায় পড়ে যায়। সত্যিই কি রেবেকা আমার জন্য অপেক্ষা করছে? কেনও করছে? ক্যাম্পাসে কতো ছেলেকে দেখেছি রেবেকার জন্য অপেক্ষা করতে। আজ রেবেকা আমার জন্য অপেক্ষা করছে কেনও! এসব হাবিজাবি চিন্তা শেষে হাসান রেবেকার বাড়িতে না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এর কিছুদিন পরে রেবেকা কোরিয়ায় চলে যায়। তার স্বামীর কাছে। তার কিছুদিনের মধ্যেই রেবেকা হাসানকে ফেসবুকে ব্লকড করে দেয়। হাসানের কাছে এই কারণটা অজানা যেমনটি অজানা রেবেকার নিমন্ত্রণ কারণ। রেবেকার ইশারা-মানে বুঝা হাসানের জন্য বড্ডই কষ্টকর ছিলো। রেবেকা কি মজা করেছিলো? নাকি সত্যি সত্যি তার ইশারার অন্য একটা মানে ছিলো। নিশ্চয় দ্বিতীয় কারণটা হবে। তাহলে হাসানকে কেনও রেবেকা ব্লকড করলো? এই উত্তর আজও পায়নি হাসান। হয়তো হাসান আর কখনও এই উত্তর পাবেনা। এটাই হাসানের আক্ষেপ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট