আরাধ্য আকাশবৃত্তি : এই আরাধনা পূর্ণতা পাক
ইয়ার ইগনিয়াস
‘চোখে এ কোন পথ মেলেছে আজ, রাস্তায় নেমে দেখি- চলমান রিকশা এক-এক করে ঢুকে যাচ্ছে চোখের ভেতর। বড় রাস্তার বাস, কখনো ট্রাক, ক্রমাগত ধেয়ে আসছে চোখে। ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে দুসারি মানুষ, এক পাশে ধার্মিক অন্যপাশে নতুন পরিচয়ে। ফুরসত নেই কারো দিকে তাকাবে কেউ। তোমাকে খুঁজেছি দুলাইন মানুষের মাঝে। অথচ এ শহরে আমার কোন ধার্মিক অথবা মানবিক প্রেমিকা নেই। আমি আস্তে আস্তে বুজে নিলাম চোখ।’
(চোখের বিশালতা, পৃষ্ঠা-২৯)
এমন সব দৃশ্যকল্প যদি পড়তে চান- ভেসে বেড়াতে চান শব্দের রূপকল্পে- মুর্ছা যেতে চান উপমা-অলঙ্কারের ঝঙ্কারে, তবে আপনিও হাতে তুলে নিতে পারেন শেখর দেব-এর নতুন কবিতাকিতাব আরাধ্য আকাশবৃত্তি। কবিতার দিক দিয়ে গ্রন্থটি তৃতীয় হলেও অন্যগ্রন্থগুলোর চেয়ে এই গ্রন্থটি স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর বহন করে। শেখর দেব মূলত প্রি-ভার্সে কবিতা চর্চা করলেও চলতি বইয়ের বেশকিছু কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত, সনেট রচনায়ও দেখিয়েছন মুন্সিয়ানা। এখানে কবি সরাসরি বলার চেয়ে আড়ালকে আশ্রয় করেছেন। কবিতাকে করেছেন মোহনীয়। কবিতা এমনই এক মোহনীয় রূপসী- দ্যুতি ছড়াবে ঠিকই- সহজে দেবে না ধরা। কেবল কবিতার সমঝদার পাঠক-ই এই আস্বাদ পায়। আশার কথা এই- কবি শেখর দেব ফুরিয়ে যেতে আসেননি, নিয়ত নতুন নতুন কবিতা প্রসব করে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তুলতুলে সন্তান। গ্রন্থপঞ্জি দেখলে তা স্পষ্ট হয়। ২০১৪ সালে প্রথম গ্রন্থিত হলেও ২০১৮ সালে এসে তার বইসংখ্যা দাঁড়ালো চার, যার তিনটি-ই কবিতার ও একটি প্রবন্ধের।
ইতিহাস-ঐতিহ্য-মিথ-পুরাণ আর সমকালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা তার কবিতায় নিপুণভাবে অঙ্কিত হলেও- প্রেম তার কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। তাই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যুগের কবি উচ্চারণ করেন-
-ভালোবাসার জন্য বিজ্ঞান পড়তে হয় না।
(পৃষ্ঠা-১৯)
-তোমাকে না-ছুঁয়ে কলঙ্ক লেগেছে গায়ে
ভেবেছি- চুমু খেলে গোপন বোমার আকারে
ধ্বসে পড়তো সভ্যতার খোলস!
(বোমা বিষয়ক, পৃষ্ঠা-১৫)
-হাতে হাত রাখলেই ভেবেছি বৃষ্টি হবে অথবা ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে ঝড়।
(রাত্রিবন্দি মানুষ, পৃষ্ঠা-২২)
-সব পাবে তুমি আমার মোকামে
(সবুজ খামের চিঠি, পৃষ্ঠা-৪২)
কবিতায় অন্তর্বয়ান নতুন নয়। ‘সব পাখি ঘরে ফিরে না’ ও ‘ফিরে না চাকা’ এ দুটি কবিতা বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আলোচিত দুজন কবির কবিতার অন্তর্বয়ান। যথাক্রমে জীবনানন্দ দাশ ও বিনয় মজুমদার। ভাবনার বিনির্মাণে কবিতাদ্বয় মনোজ্ঞ মনোযোগ দাবি রাখে।
নদীমাতৃক এদেশে নদী ভাঙন নতুন কোনো ঘটনা নয়; তবে যে নদীর আবহে অগণিত কবি কালক্ষেপণ করেছেন, যার সান্নিধ্যের স্বপ্ন দেখেন নব চর্যাপদ-চাষী। সে যদি কেড়ে নেয় সবুজ বাসর! কেড়ে নেয় রুগ্ণ মা; হোক সে মৃত্যুমগ্ন! তখন, দীর্ঘশ্বাসে মুদ্রিত হতে থাকে নিজস্ব আকাশ। এমন মর্মস্পর্শী ঘটনাকে উপজীব্য করে কবি লিখলেন '‘ব্রহ্মপুত্র তুই ফিরে যা’। কবিতাটি অংশত এরকম-
কখনো পারিনি যেতে ব্রহ্মপুত্র-মায়ায়। তার শান্ত সৌম্য জলের স্বপ্নে প্রায়স ভেঙে যায় ঘুম। অথচ আজ ঘরে চলে এলে ঘুম ভাঙানিয়া আর্তির শব্দে। ছুঁয়ে দিলে ভাঙা চৌকিতে শোয়া রুগ্ণ মায়ের শরীর। এভাবে তোমাকে ভাবিনি কখনো। ভয়ংকর পৌরুষে মুষড়ে দিলে বেড়া ঘেরা সংসার।
(ব্রহ্মপুত্র তুই ফিরে যা, পৃষ্ঠা-১৭)
‘বহুমাত্রিক রাত্রি’ কবিতাটিতে কবি- কতিপয় ধর্মযাজক, প্রগলভ-পুরোহিত ও চতুর ফতোয়াবাজদের চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনে সক্ষম হয়েছেন। কবিতাটা মূলত রূপক; আমাদের বিচারব্যবস্থা অদ্যাবধি মোড়লদের আজ্ঞাবহ। যাদের ইশারায় বিচারের বাণী পাল্টে যায় অলৌকিক আঁধারে। কবিতার শুরুটা এরকম-
দ্বিমাত্রিক রাত নেমে আসে তোমার ঘরহীন ঘরে। রাত হলে মানুষের বিশ্বাসী শাস্ত্র থেকে উড়ে যায় অক্ষরেরা। তার শাদা পাতায় অজগ্র নিয়ম নিজের মতো গড়ে ওঠে শ্রুতিতে, ধীর ও শান্ত মননে।
(বহুমাত্রিক রাত্রি, পৃষ্ঠা-৫০)
ঘুম ভেঙে দেখি- শরীরে প্রবেশের জন্য ভিড় করে আছে পালিয়ে যাওয়া পাখিরা!
(মায়াপাখি, পৃষ্ঠা নং-৫৫)
কী এক মোহবাস্তবতা! শেখর দেব’র কবিতা এমনই। মোহবাস্তবতায় ধরে রাখে পাঠককে। আলোচ্য বইটি এক-বসাতেই শেষ করেছি। কোথাও থামতে হয়নি। সংযতবাক্, প্রাঞ্জল ও প্রজ্ঞাময় উপস্থাপনে এগিয়ে গেছি। তবে, দুয়েকটি কবিতায় সামান্য অতিকথন আছে। দুয়েকটি পঙ্ক্তি দ্বিরুক্তি দোষে ঈষৎ দুষ্ট। শত যতœ-আত্তিরেও কিছু ভুল থেকে যায়, তেমনি তিনটি বানান প্রমাদ থেকে গেছে। ধ্যনস্থ, চুতুর্মাত্রিক, ঘীরে, যা ধ্যানস্থ, চতুর্মাত্রিক ও ঘিরে হবে। বাকি আয়োজন সুখকর। বইটিতে ৪৭টি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। যার অধিকাংশ সংবেদনশীল পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে আশা করছি, আমার পাঠ অন্তত তাই বলে। নির্মেদ ও ঝরঝরে ভাষায় আদিম উত্তাপ, ষড়সুখব্যথা, জলের ভেতর একরাত, কিছু সৌরভের জন্য, কবিতার কঙ্কাল, মৌন মুদ্রা, লীলা সমগ্র, মৃত নক্ষত্রের স্মৃতি, অদ্ভুত আলোর রেখা, ক্যালেন্ডার, স্মৃতি-শব, ঈশ্বরের বালাম থেকে, যোজন-বিয়োজন, অন্ত্যেষ্টিক্রয়া, ম্যামোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং, অনার্যাবর্ত, চন্দ্রগ্রহণ, মোহন্ত মানুষের মায়া, বৃত্তাবদ্ধ, আরাধ্য আকাশবৃত্তি ইত্যাদি কবিতাগুলো পড়ে নিতে পারেন। একটা বইতে এতগুলো ভালো কবিতা দুর্লভ। সেক্ষেত্রে কবিতামোদীদের এটা সুখবর বটে। তবে ‘রবীন্দ্রনাথ জানে বা জানে না’ ও ‘স্বল্পমাত্রার কবিতা’ কবিতাদুটি আমার কাছে তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়েছে। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে আমার দর্শন-ই চূড়ান্ত নয়; এটা আপেক্ষিক বিষয়। কবিতার টেক্সট একেকজনের কাছে একেক রকম। প্রিয় পাঠক, বইটি আপনারা সংগ্রহ করুন, প্রকৃত কবিতার আস্বাদ নিন।
কবিতায় কী লিখে কবি? এমন প্রশ্নের জবাব কবি আগেই দিয়ে রেখেছেন কবি- ‘অতঃপর নিজেকেই লিখে রেখেছি কবিতায়’। কবিকে হতে হয় একার সন্ন্যাস। তাই কবি নিঃসঙ্কোচে উচ্চারণ করেন- ‘কবিতা ছাড়া আমার কোনো ঘর নেই’। কবিতা ছাড়া যার ঘর নেই, তার কবিতাঘর নিয়ে কবি নিশ্চয় আরও যতœবান হবে এই আশা রাখতেই পারি। কবি আরও বলেছেন- ‘নিয়ত সরব চাকা চলে যায় দূরে’, এভাবে সরব থেকে কবি –সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কেঁপে -মহাকালের পথে অনেকদূর যাবেন এটাই কাম্য। তো কবির কাব্য প্রয়াস মসৃণ হোক। জয়তু কবিতা...