নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া, তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তের’ই হাওয়া




নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া,
তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তের’ই হাওয়া

মামুন ম. আজিজ
 

বসন্ত নিয়ে কিছু কথা বলার প্রারম্ভে স্বভাবতই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বসন্তকে বিশেষায়িত করার অতি অভিলাষ 'ঋতুরাজ' জুড়ে দেয়া হয়, তারপর বন্দনা কীর্তন এগিয়ে যায়, এখানে আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি, আমি বসন্তকে ঋতুরাজ বলতে রাজী নই। যুগ থেকে শাতব্দী পেরিয়ে পেছনের ইতিহাসে আমরা যত রাজাদের দেখি, শুনি, পড়ি তারা ফাগুনের রক্ত রাঙা সবুজ পত্র কাননের মাঝে ঝিরি ঝিরি বসন্ত বাতাসের হিমেল পরশের মত মাধুরীময় রূপে আমাদের কাছে ধরা পড়ে না, রাজা স্বভাবতই কাঠিন্যেরা আবরণ বরন করেন, তা না হলে রাজত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন, প্রজার কাছে কেবল দয়ালু সাধু হলেই হয় না রাজাকে হতে হয় কঠোর, সত্য নিষ্টার পরাকাষ্টা, একটু উল্টো ভাবলে সেতো আরও কঠিন, আমি উল্টো ভাবনায় নিষ্ঠুর অত্যাচারী রাজাগণের কথাই বলছি, সেও ইতিহাসে ভরপুর। প্রিয় মিষ্টি মধুর পাখির কলকাকলী উচ্চকিত বসন্ত কেনো পুরুষ হবে, কেনো রাজা হবে, সেতো রানী হতে পারে, সৌন্দর্যের নিগুঢ় আলোড়ন হতে পারে, আমি তাই বসন্তকে বলব 'ঋতু শ্রেষ্ঠ'।
আমার ঋতুশ্রেষ্ট বসন্ত প্রাণে প্রাণে দোলা দেয়। সে এক নীরব নিবিড় দোলা, সে যার প্রাণ আছে সেই বোঝে। কবিরা প্রাণের নিগুড়তম আঁধার। বসন্ত আসবে আর কবিরা দুলবে না, তা কি হয়! বসন্ত আসবে আর কবিরা লিখবে না দু’কলম কিংবা আধুনিক যুগে কবিরা টিপপে না কিবোর্ডের বাটন, তা হয় না। কবিরা না লিখতে চাইলেও তাকে লিখতে হয়, মনে মনে আউড়াতে হয় কবিতার চরণ। সাধে কি কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন,
'হে কবি নীরব কেন, ফাগুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি ল’বে নাকি তব বন্দনায়? '
বসন্ত এলে পরে নিসর্গে যেমন নির্মেঘ রোদ্দুর জেগে ওঠে, সিন্ধ বাতাসের পরশে সকাল সন্ধ্যা দেহে দেহে হিল্লোলে লাগে মিষ্টি দোলা, তেমনি কবিরাও বিগত কালের কবিতায় লেখা যাপিত জীবনের বিষাদ, যাতনা, দুঃখ-ব্যথা, জরা, ঘুন চিত্র সব ভুলে এক আনন্দ সরোবরে সাঁতার কাটে, হাত নেড়ে সুখের আহ্বান জানায়, কবিতা হয়ে ওঠে ইতিবাচক। কিন্তু প্রায় কবির কবিতাই সুখের চেয়ে দুঃখকে অধিক উপজীব্য হিসাবে গ্রহণ করে কিংবা কবিতা আপন খেয়ালে বিষাদ নীড়ের ঘরে চোখ মেলে বেশি, আর কেবল ব্যতয় ঘটে ফাগুনের রঙে প্রায় সকল কবিরই প্রাণে।
কবিতায় যার স্বল্প আয়ুষ্কালেই ঝরেছে ভীষণ ক্ষোভ সব, করেছেন যিনি তীব্র প্রতিবাদ ‘ক্ষুধার রাজ্যে যেন পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ চরণ  লিখে। অতি  প্রিয় সেই ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ড ভটাচার্যও বসন্তে উতলা হয়ে ঠিকই সুখের ডাক দিয়েছেন, প্রাণের দোলায় দুলেছেন, অন্যকেও দুলিয়েছেন তার ‘ চৈত্রদিনের গান’ কবিতায়-

চৈতীরাতের হঠাৎ হাওয়া
              আমায় ডেকে বলে,
“বনানী আজ সজীব হ’ল
              নতুন ফুলে ফলে৷
এখনও কি ঘুম-বিভোর?
পাতায় পাতায় জানায় দোল
              বসন্তেরই হাওয়া৷
তোমার নবীন প্রাণে প্রাণে,
কে সে আলোর জোয়ার আনে?
নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া;
তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তেরই হাওয়া৷
              ওঠ্ রে আজি জাগরে জাগ
              সন্ধ্যাকাশে উড়ায় ফাগ
              ঘুমের দেশের সুপ্তহীনা মেয়ে৷
তোমার সোনার রথে চ’ড়ে
মুক্তি-পথের লাগাম ধ’রে
              ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে৷
রক্তস্রোতে তোমার দিন,
চলেছে ভেসে সীমানাহীন৷
              তারে তুমি মহান্ ক’রে তোল,
তোমার পিছে মৃত্যুমাখা দিনগুলি ভোল॥”
বসন্তের সুর এমনই গহীন, রক্তস্রোতে ভেসা চলা দিনের বেদনা ভুলেও কবি বলেছেন ‘ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে’। বসন্ত এমনই, এ যেন মুষঢ়ে পড়া মানুষকে সামনে ঠেলে দেয়ার কিছু ক্ষণ। প্রচন্ড বিপ্লব যার কবিতার পরতে পরতে সেই বিপ্লবের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে, খুনেরা ফাগুন..।’ শব্দ চয়নে তিনি বিপ্লবী সুর বজায় রেখেও বসন্তের সেই একই ডাক, একই প্রাণ সঞ্চারী দোলার কথাই পক্ষান্তরে বলে গেলেন কি সুন্দর। কেবলই বিপ্লবী সুরে নয় মিষ্টি সুরের বাঁশী বাজিয়েও নজরুল বসন্ত বন্দনা করেছেন অন্য কোথাও অন্য কোন কবিতায়, এমনই  তার ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত ’ কবিতা-
এলো বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে,চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।
বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,
পান্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।।
কিশলয়ে-পর্ণে অশান্ত ওড়ে তা’র অঞ্চল প্রাস্ত।
পলাশ-কলিতে তা’র ফুল-ধনু লঘু-ভার,
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত।
এলো মেলো দখিনা মলয় রে প্রলাপ বকিছে বনময় রে।
অকারণ মন মাঝে বিরহের বেণু বাজে।
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত।।
বসন্ত আর বসন্তের কবিতা নিয়ে অনেকটা লিখে ফেললাম অথচ বাংলার যে ব্যক্তিটি সর্বাধিক বসন্ত প্রেমিক তার কথা এখনও এলোনা। তাঁর কথা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে, সে যে কবি গুরু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে কে আর বেশি বসন্ত বিলাসী এ বাংলায়। তার বসন্ত গীত যে বিরাজ করে প্রতি বাঙালির হৃদয়েই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য কবিতা ও গানে উঠে এসেছে  বসন্তের কথা। মাত্র তিন লাইনেও কবি গুরু বসন্তকে চিনিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন-
‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।’


বসন্ত কেবল রূপের ছটায় মুগ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, রক্ত রঙা পলাশ, শিমূল আর কৃষ্ণচূড়ায় প্রাণে প্রাণে রঙ ছড়িয়েই হারিয়ে যায়নি, কোকিলে প্রাণে যেমন প্রেমের ঢেউ ডিন্ডির শোভিত হয়ে ফুলে উঠেছে আর কোকিল ‘কুহু কু’ রব তুলে প্রেপিকার স্পর্শ আহ্বান করেছে, প্রেমিকা কাছ না আসা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়নি, তেমনি বসন্ত মানব মাঝেতেও প্রেমের উৎসরণ ঘটিয়েছে, কবিগণ আপন কবিতায় সে বসন্ত বারৌ প্রেমের কথাও নির্দ্বিধায় তুলে এনেছেন বারবার,বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানের ভাষায়-
‘বসন্ত বাতাসে..সই গো,বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...। '
আবার কুমার বিশ্বজিৎ আধুনিক যুগের গানে বসন্ত প্রেমের উতলা হাওয়া বইয়েছেনঃ
‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে
ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে
এখন যে প্রয়োজন তোমাকে
নিঃসঙ্গ এই হৃদয়ে’
আধুনিক কবিরা বসন্তকে নতুন নতুন আঙ্গিকে উপমিত করতে চেয়েছেন। নির্মলেন্দু গুন এর বসন্ত বন্দনা কবিতায় তেমনি এক সৃষ্টি-
হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা, দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।
এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরন,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে, মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায়। হায় কি আনন্দ জাগানিয়া।
এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,
যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখানি
নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।
আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরূপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার।
 নির্মলেন্দু গুণ স্বীকার না করে পারেন নি-‘এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,/যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য’,আর তাই উপমার জালে বসন্তকে নিজের মাঝে আটকাতে চেয়েছেন অক্ষরবৃত্তেও। আবার ‘আমার বসন্ত’ নামে অন্য কবিতায় তিনি আরও উন্মাদ হয়েছেন বসন্তের ভাল লাগায় , বলেছেন...
‘এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে,
মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর,
পাতা ঝরা, স্বচক্ষে স্বকর্ণে দেখা চাঁদ, জ্যোৎস্নাময়
রাতের উল্লাসে কালো বিষ । এ না হলে বসন্ত কিসের ?’
আরও উত্তরাধুনিক কবিও বসন্তকে আধুনিক দৃষ্টিতে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। বসন্তকে এড়িয়ে উত্তীর্ণ হবার দুসাহস এ যুগের কবির ও নেই। বসন্তের মাঝে নিজেকে খুঁজে নিয়ে তাই কবি টোকন ঠাকুর তার ‘বসন্ত রজনীতে বসিয়া রচিত কবিতা’ তুলে ধরেন-
‘...শিস প্রয়োজনে
আমি
হাওয়া-ধাক্কা দিচ্ছি
বসন্ত-জঙ্গলে গাছদেবতার
শুকনো পাতায়
কে আমি? বিখ্যাত কেউ? কী ছিলাম? গুরু কেউ? লঘু ঢেউ?
ঝরনার বাথরুমে শাওয়ার ছিলাম?
সুহাসিনীর ড্রেসিং টেবিলে আয়না ছিলাম?
গুপ্তকথা হচ্ছে, আদতে সেই রাক্ষসদের ছেলে, মানুষের ছদ্মবেশে থাকি
যোগ্যতা, নিজের মুখে জোছনারাত অনুবাদ করতে পারি, এর বাইরে
আমি যা ছিলাম, তাই
ছিলাম যা, তাই।
অনলাইনের যুগে, অনলাইনের বিস্তৃত পরিসরে’ উত্তারাধুনিক কবিগণও বসন্ত বিহীন কেবল যান্ত্রিকাতার মাঝে চোখ বুজে থাকে নি, বসন্ত বারবার এ যুগের সব কবির মনের ভেতর দোলা দিয়ে বলে ওঠে একই কথা যা কবি চারুমান্নান তার ‘এবং কবিতা বসন্ত’ তে বলেছেন-
‘আমার কবিতার গা এখন বসন্ত আবিরে ঢাকে
খোলা পায়ে নিত্য ফুলের পাঁপড়ি মাড়িয়ে চলে
বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত মানে না কোন বাঁধা
একি মাতাল হাওয়ায়?
মাতাল নেশায় ছুটে,মানে না বারন,মন যে উতল’ '
বসন্ত বন্দনার কোন শেষ নেই বাংলার কবিদের লেখায়। বসন্তের মাঝে এই প্রাণের হিল্লোল, এই যে উন্মাতাল সুখ সুর, এর পিছণে বিগত শীতের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। শীতের রুক্ষতার পরেই বসন্তের আগমন, শীতের শেষে ঝরে পতা পাতার আস্তর সরিয়ে, ধুলোর আলোড়ন এড়িয়ে সবুজ পাতার ঝাঁক, তারপর উঁকি দেয় রক্ত রাঙা সব ফুল। অথচ আড়ালে চৈত্র মাসের নির্মেঘ দিনে সূর্যের যে ক্ষীপ্রতা তা কিন্তু কবিদের চোখ এড়ানোর কথা নয় মোটেও। কবিকূল বসন্ত উচ্চারণে এই তাবদাহের যাতনা তুলে না ধরারই চেষ্টা করে গেছেন, এতে যেন বসন্তেরই জয়গান প্রাণবন্ত হলো। অবশ্য চৈত্র মাসের নাম চয়নে প্রখড় রোদের অতুষ্ঠি করতেও ছাড়েন নি অনেক কবিই। ভিন্নতার কবি জীবনানন্দ দাসের ‘কখন সোনার রোদ নিভে গেছে’ কবিতায় তাই যেন চৈত্রের বিষদগার করেছেন এইভাবে-
'কখন সোনার রোদ নিভে গেছে, অবিরল শুপুরির সারি
আঁধারে যেতেছে ডুবে, প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস
ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস;
কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে, আসিবে না করে গেছে আড়ি :
ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি
কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ,
কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?...


জীবনের কবি জীবনানন্দের কবিতায় বসন্ত স্ব রূপেও এসেছে, তবে সেট্ওা অনেকটা নীরবে নিভৃতে। হতে পারে হেমন্ত প্রেমী কবির কাছে বসন্ত এক ভিন্ন রূপ বলেই হয়তো, কিন্তু আসলে কি তাই? কবিতার ছত্র তো ঠিকই বলে দিচ্ছে তিনিও নীরবে নিগুড় বসন্ত প্রেমিকই। তাঁর কবিতায়-
কোন এক বসন্তের রাতে
জীবনের কোন এক বিস্ময়ের রাতে
আমাকেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায় ৃ'
আবার ‘সবিতা’ কবিতায় জীবননানন্দ বসন্তকে তুলে ধরেছেন-
‘বসন্তের রাতে, যেমন দেখি ...
সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে
ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন...'
আবার জীবনান্দনের নিঝুম মনেও বসন্ত দোলা দেয়, আর তাইতো ‘পাখিরা’ কবিতায় তিনি বলে ওঠেন-
'শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে,
চোখ আর চায় না ঘুমাতে;
জানালার থেকে ওই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে,
সাগরের জলের বাতাসে
আমার হৃদয় সুস্থ হয়;
সবাই ঘুমায়ে আছে সবদিকে-
সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময়? '
প্রতি বসন্ত যেমন অজস্র কবিতা সৃষ্টি করে, তেমনি সৃষ্টি করে কবি। জীবনানন্দই সেই আহ্বানকেও তুলে ধরেছেন-
‘শীত-হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন
আবার তো এসে যাবে;
এক কবি,- তন্ময়,- সৌখিন,-
আবারতো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে।’
আধুনিক কবিতায় অনেক কবিই চিরায়ত রূপে বসন্ত না ভেবে প্রখা ভাঙার তীব্র প্রচেষ্টা দেখাতে চেয়েছেন। আধুনিকতার এই এক এক বৈশিষ্ট্য অগ্রগামীতা, যেন প্রথার দেয়ালে হানি আঘাত...কবি মাসুদ খানের  'বসন্তকাল' কবিতায় তাই বসন্ত ভাবনা উঠে আসে সম্পূর্ন ভিন্ন রূপে, এক নিবিষ্ট প্রতিবাদী সুরে-
মাথা কেটে পড়ে গেছে, কণ্ঠনালী ফেটে ফিনকে উঠছে ঋতুরক্তলাভা,
লালের উল্লাসে আরো লাল হয়ে উঠছে পালকপুচ্ছডানা।
তবুও চলেছে উড়ে বনমোরগ, ছিন্নমস্তা, ডাল থেকে ডালে...
মোরগঝুঁটির আঁকাবাঁকা উচ্ছ্বাস থেকে আজ
ডিমের গলিত কুসুমের মতো উৎফুল্ল সূর্যোদয়
ছোপ-ছোপ রজোবিচ্ছুরণ...
ছিটকে ছিটকে শিমুলে মান্দারে গিয়ে লাগে ওই লাল
তুম-তানা-নানা ঘটিয়ে তোলে বনে বনে বিকল্প বসন্তকাল।


কবিরা বসন্ত অত্যধিক ভালোবাসে। কবিরা বসন্ত মাঝে রক্তিম ফুলে জাগরণের হাতছানি দেখতে পায়, কবিরা বস্ত দিনে বাসন্তীরঙা শাড়ির সাজে নারীকে চিত্রিত করতে চায়
কবি সরসিজ আলীম এর ‘হাঁসেদের পালকের গন্ধ’ নামে আধুনিক গদ্য কবিতায়ও উঠে এসেছে বাসন্তী শাড়ি আর বসন্দ রূপের মাধুর্য-
‘বাসন্তী রঙের শাড়ির সুতোয় সুতোয় বসে হাঁসেদের ঝাঁক তাহাদের পুচ্ছের উপর তেলের কৌটা খুলে ঠোঁটে তেল নিয়ে মাখিয়ে দিচ্ছে পালকে পালকে, আর পালকে পালকে রোদের ঝিলিক গড়িয়ে গড়িয়ে লাফ দিয়ে পড়ছে জলের উপর। জলের ভেতর থেকে লাল রঙের ভেজা ফুলের পোষাক পরে উঠে আসছে অনিমা হোসেইন রোদের ঝিলিক লাফ দেয়া ডিঙিয়ে, অনিমার শরীর গড়ানো জলে পুকুর ঘাট ভিজিয়ে নিচ্ছে নিজেকে, আর রোদ পোহাচ্ছে পুকুর ঘাটে তখন হাঁসেদের পালকের তেলের গন্ধ।...’
এভাবে যুগযুগ ধরে বাংলা কবিতায় বসন্ত রূপ আর আর তার আনন্দ হিল্লোল মাখিয়েছেন কবিগণ কবিতার সব রূপেই তা ছন্দের সব রূপেই। আধুনিক গদ্য রূপেও তার কমতি হয়নি। কখনও হবেও না, বসন্ত আসবে, বসন্ত নিয়ে কবিতা রচিত হতেই থাকবে। কষ্ট ক্লীষ্ট ক্ষণেও, নিদারুণ কালেও বসন্ত কবিদেও কবিতার প্রাণ, তাইতো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত...’
বসন্ত দোলায়,এত এত কবিতার জাগরণে আন্দোলিত প্রাণ এখন আমার, তাই যেন বসন্ত আর বসন্তে বাংলার কবি ও কবিতার ক্ষুদ্র চিত্র তুলে ধরতে অক্ষম এই কবি আমিও বসন্ত কবিতার ছত্র বুনে ফেলি, লিখে ফেলি-
‘প্রাণে লেগেছে দোলা, সবুজ পাতার ফাঁকে রক্ত শিমুলের মেলা
হিমেল পরশে হৃদয় ছুঁয়েছে ফাগুন
হাসির শিখা যেন জ্বালিয়েছে বাসন্তী আগুন
এমনই এ দিন, পাতা ঝরার ঋন হলো ঐ আজই যে বিলীন
প্রাণে লেগেছে দোলা, জরা দিন ভুলে প্রাণে শুধু আনন্দেরই খেলা।'



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট