গল্প- ছেড়ে হাঁটে বনেদী জীবন



ছেড়ে হাঁটে বনেদী জীবন
শাহমুব জুয়েল

না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। যত বলি বিকেলে একটু ঘুমিয়ে নে। কিছুতেই কান দেয় না। পাড়ার দুষ্টুরা এলেই গদগদ করে দুচারটে ভাত গিলে ঝাঁফিয়ে পড়ে। বিকেল গড়ায় কাদামাটির সাথে খেলা করে। বুঝাতেই পারি না পড়াশুনো কর। বড় হলে াগড়ি হবে বাড়ি হবে। শেখ জেঠুর মত। বাড়ি এলে লোকে সালাম দেবে। কত কিছু খেতে দেবে। বাবা না একটু পড়াশুনা কর। কে শুনে কার কথা।
মতিন মাষ্টার কুব জেদী মানুষ। সংসারের জ্বালাযন্ত্রনায় মেজাজ খটখটে। বাবার কালের সয়সম্পত্তি তেমন নেই। মাঠে ঘাটে দু চারখন্ড থাকলেও ভাগবাটোয়ারা হয়নি। বহু কষ্টেই টেনে চলছৈ সংসারে কাঁধি। ছেলে মেয়ে লায়েক হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেকেই স্কুলগামী। প্রতিদিন সকালেই তার সংসারের চিন্তু মাথায় তুলে দিন পার করতে হয়। এভাবে কী সংসার চলে তবুও চলতে হয়। একই গাঁয়ে বিয়ে করেছে সে। সংসারে অভাব ঘুচাতে শশুরালয়ের কয়েক খন্ড জমি চাষ করে জীবন চালায় মতিন মাষ্টার।
মতিন মাষ্টারের বড় ছেলে রাফিন। ছোট বেলা থেকেই সংসারের সব বোঝে। তেমন চাহিদা নেই।
এখন সে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার রয়েছে ছোট বোন মাহিন। দুজনেই পড়াশুনোয় বেশ ভালো। বাবার কষ্ট বোঝে। কী চায় তা থেকে জীবনের স্বপ্নে উঁকি দেয়।
সকালবেলা। প্রাইভেট টিউটর আসে। বেশ ভালো পড়ায় মনোযোগ দিয়ে পড়ে। কখন যে ঘন্টা চলে যায়। গিন্নী টিউটরকে নাস্তা দেবে। ফিন্নিবাটিটা ধুয়ে না নিতে সে উঠে পড়ে। সময় গড়ায়। রাফিন স্কুলে যাবে কিন্তু গোসল করতে চায় না। মায়ের বকাঝকায় দৌড়ে ঘাটকুলে ঝাঁপায়। অন্যদের সাথে পানি থইথই করে পেলে। হঠাৎ সাইকেলের আওয়াজ। কান ঘুরে বাড়ির আগপথে। বাব এলো। হাঁ- হায়রে পিঠের উপর আজ কী ভাঙ্গে খোদা জানে। ইতোঃপূর্বে বহু লাঠির দগদগে চিহ্ন পীঠে ঝামা পড়েছে। নতুন নেবে কী করে। পাশে রাহেলা ভাইয়া, বাবা... জলদি উঠ বলতেই রাফিন দৌড়ে।

ছেলে- মেয়েরা বড় হয়। সংসারের চাপ বাড়ে। মতিন মাষ্টার দিশেহারা। রাফিনকে লজিং দেয়। রাফিন এখন মাষ্টার। ছাত্র-ছাত্রী ক্লাসের সাইজের চেয়ে দেহে ভারী। এভাবে কেটেছে বহুদিন। মাঝে মধ্যে বাড়ী ফিরে। লিকলিকে শরীরের ভাঁজ। তার চাচা সুজন পড়াশুনা নেই। লোকে বলে মূর্খপন্ডিত। তার জোরেই সব নিজের মনে করে। তার অষ্টধাতুর জোরে রাফিনের দাদা দাদু নাতি নাতনির মায়া চুকে ফেলেছে। কিন্তু রাফিন তাদের বেশ শ্রদ্ধা করে। বাড়ি এলে ছোটে দাদুর বিছানায়। দাদু তখন পান খিলালে ব্যস্ত। কথা উঠতেই চুপ চুপ ভাই পালাও, সুজন আসছে। আহ ঠিকমত কথা হলো না। কথা আছে ভাই পরে এসো। রাফিন আবার ফিরে দাদুর হাত পা টিপে দেয়। আহরে ভাই কী ভালো লাগে। দাদু ভাই তোমাকে ঠিকমত খাবার দেয়? ভালো মন্দ খেতে দেয়? হ্যাঁ দাদু, বড় বড় মাছের পিছ। আরো কত কী। তাই দাদু? ছেড়ো না। বড় হবে। চাকরি করবে দাদুকে শাড়ি দেবে। তাই না দাদু ভাই?
দিন যায়। রাফিন ক্লাসের তালে তালে লজিং ছাড়ে আর ধরে। মা বড্ড ভালোবাসে। কিন্তু কী করবে? অভাবের তারে মায়াকে চুকে দেয়। মায়া আছে ছায়া নেই। নানীও রাফিনের জন্য টাকা গুচায়। পাঠায় না। রাফিনের খোঁজ করে। রাফিনের এসএসসি রেজাল্ট দেবে। রীতিমত মসজিদে পড়ে আছে। কিন্তু ফলাফল ভালো হলো না।
সে বাড়ি ফিরে না। খোদার উপর ভরসা রাখে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা বোগলে চেপে রাত দেখে বাড়ি ফিরে। কথায় বলে “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত পোহায়”।
সুজন চাচা মিটমিট হাসে। জল ঝরে রাফিনের। সে কষ্টে এবং জ্বালায় মনোযোগী হয়। ভরসায় মানবিক বিভাগ নেয়। এইচ এস সি পরীক্ষঅর প্রথম দিন। বাবা তাকে হলে পৌঁে দেয়। দ্বিতীয় দিন কাকডাকা ভোরে নগদখবর মারছে তোর বাপেরে মারছে রে রে রে........
রাফিন বইয়ের পাতা খসে চমকে দৌড়ায়। মা... বাবা কই? কোরআন পড়ছে। বেপারীর কবরের পাশে। দৌড়া রাস্তাজুড়ে চাচাদের আড্ডা, প্রতিবেশীদের কানাঘুষা, মহিলাদের খিলখিল। কিন্তু বাবা এগুতেই দাদাদের বাড়ি সব দরজা বন্ধ, পাশের খেতে চিৎকার।
বাবা বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু দরজাগুলো বন্ধ ছিল। রাফিনকে জড়িয়ে ধরলো মান্নান মাষ্টার। এই রাফিন তুমি যেও না। পরীক্ষা- একঘন্টা আঁটকে থাকার পর চেয়ে দেখি কর্দমাক্ত বাবার দেহ চটপট করছে। তখনো অমানুষের আচাঁছা বাঁশ লাফিয়ে উঠছে। ওপারে কবরখানা। সে কবরের মত বাবার চারপাশে কবর। চিকচিক জলে শীষের ডগার মত ধানক্ষেতে নড়ছে বাবার দমখানা। বাতাস না থাকলে হয়তো তাও থাকতো না। দাদু আসলো মা আসলো ছোট ফুফু ঝর্ণা। টেনে টেনে তুললাম সায়হীন জবিন। সেদিন বুঝেছি দাদু খুব ভালোবাসতেন বাবাকে। আঁচল টেনে মুচে দিলেন শুধু মুখখানা কিন্তু, সে মুখে ভাষা নেই,লোল আছে।
হাসাপাতাল আর পরিক্ষার হল। পরীক্ষায় মন বসছে না। হল থেকে ফিরে বাবার বেডে ফিরতেই কেঁদে ওঠেন। বুকে বেঁধে হাঁফ ছাড়েন বাঁধা স্বপ্নে কাঁধিতে।
সেদিন বুঝেছিলাম। বাবা মতিন মাষ্টার নন আমার বাবা। সে বছর ধান হয়েছে কিন্তু গোলা ভরে নি। মা কান্নায় ঘর ভরেছে। কিন্তু গোলা উপুড়।
মসজিদের তারাবির ইমামতির টাকায় জুটেছে অনার্সে পড়ার স্বপ্ন। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ বন্ধু শরীফ ফোন হাতে। বন্ধু বাড়ি থেকে কল এসেছে। বাবার কণ্ঠবাড়ি ফির... তোর দাদুর অবস্থা ভালো নেই। বাড়ি ফিরলাম, দাদু ঘুমায়, চারপাশে মানুষ। এ ঘুম নাকি তিনদিন। এগিয়ে দাদুর মাথার কার্ণিশে হাত বুলাতেই চোখ খুললেন দাদু। ক্ষণিক পরেই বুঝে গেলো। সে রাতে দাদুর ঘর থেকে কান্নার শব্দে সমস্ত বাড়ি ভারি হয়ে উঠলো।
রাফিন বড় হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বোন ভাইরাও তাই। দু চারটে পয়সা দেখে কিন্তু বনেদী জীবনে চিরসঙ্গী দাদুর ঠিকানায় বাবা চলেছে। মা বার বার বাবার পাশের খালি জায়গাটুকু চেয়ে দেখছে।
বনেদী ছেলে তার ছেলের সফেদী স্বপ্ন দেখছে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট