জুবাইদা গুলশান আরা : সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র



জুবাইদা গুলশান আরা
সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

রহিমা আক্তার মৌ



শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী ও নারী নেত্রী প্রতিটি ক্ষেত্রে যিনি অর্জন করেছেন সাফল্য। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত যার নাম তিনি জুবাইদা গুলশান আরা। সাহিত্যের নানা শাখায় তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার। এক কথায় একজন সফল জীবনশিল্পী হিসাবেই তিনি সবার কাছে পরিচিত। ব্যক্তি কখনো চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু জুবাইদা গুলশান আরার কর্মই নক্ষত্র রূপে উজ্জল থাকবে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে।

১৯৪২ সালে ২২ এপ্রিল বাবা আলহাজ মুহম্মদ ইউনুস এর কর্মস্থল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) খুলনা জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও জুবাইদা গুলশান আরার পিতৃনিবাস উত্তরবঙ্গে বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পদ্মা নদী ঘেঁষে সবুজ শ্যামলিমায় ছায়াময় বর্ধিষ্ণু গ্রামের রূপপুরে। তাঁর মায়ের নাম আঞ্জুমান আরা। সাত ভাই দুই বোনের মধ্যে তার বড় পাঁচ ভাই ছোট দুই ভাই এক বোন।
বাবা আলহাজ মুহম্মদ ইউনুস পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেবেলা কাটে কলকাতায় ও পরে দার্জিলিং কার্সিয়ং কালিম্পংয়ের পাহাড়ে। পাহাড়ে দুরন্ত শৈশব কাটিয়ে তিনি নেমে আসেন সমতলের টাঙ্গাইলে। তার শিক্ষাজীবনের শুরু হয় টাঙ্গাইল জেলার বিন্দুবাসিনী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশুনার পাশাপাশি গান ও আবৃত্তিতে তিনি দক্ষতা ও সুনাম অর্জন করেন। ময়মনসিংহ জেলার বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। এরপর ইডেন কলেজ থেকে বিএ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন।

দশম শ্রেণি থেকে নিয়মিত লেখালেখি করলেই তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ‘দিলরুবা' পত্রিকায়  সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে এমএ পাস করে কর্মজীবন শুরু করেন ভিকারুননিসা নূন গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার দিয়ে। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত স্কুলে শিক্ষকতার পর ১৯৬৪ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে নির্বাচিত হয়ে ইডেন মহিলা কলেজ-এ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সরকারি কলেজ থেকে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যক্তি জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের খ্যাতিমান প্রফেসর অধ্যাপক মাহমুদ-উল-আমীনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই মেয়ে, বড় মেয়ে মুসবাহ চারুকলায়, ছোট মেয়ে মেহতাব আমীন ফটোগ্রাফার।

জুবাইদা গুলশান আরা তার সাহিত্য কর্মের অবদান স্বরূপ একুশে পদক লাভ করেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, শিশুতোষ ছড়া মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬০ এর মতো। তার বেশ কিছু গল্প উপন্যাস টিভি নাটকে রূপ দেয়া হয়েছে। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

জুবাইদা গুলশান আরার বেশকিছু উপন্যাস ও ছোটগল্পের প্রসিদ্ধ লাভ করে। উপন্যাস ও ছোট গল্পের মধ্যে রয়েছে বসতি, আলোটুকুর হাতছানি, নদী তুই কোনঘাটে যাবি, মধ্যরাতের তারা, সাগর সেচার স্বাদ, তখনো ঘুম ভাঙেনি, ভোরের হিরন্ময়, আধারে নক্ষত্র জ্বলে, অগ্নিস্লান, কায়াহীন গারাগার, বাতাসে বারুদ রক্ত নিরুদ্ধ উল্লাস, হৃদয়ে বসতি, বিষাদ নগরে যাত্রা, দাওদানবের মালিকানা, প্রমিথিউসের আগুন, ঘৃণার জঠরে জন্ম, উষারাগ, অশ্রু নদীর ওপারে, কি লিখেছ তরবারি তুমি, পদ্মা আমার পদ্মা, হৃদয়ে নীল নাম, চৈতী তোমার ভালোবাসা, বিবর্ণ নগরী, মন্দাকিনী, উপন্যাস নদী, ভালোবাসার স্বভাব এমন, সোনালী রংয়ের নদী প্রভৃতি।

শিশুদের জন্য তিনি প্রচুর ছড়া কবিতা লিখেছেন। প্রথম ছড়ার বই ‘মজার ছড়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। প্রকাশিত আরো  বইয়ের মধ্যে রয়েছে  ছানাপোনাদের ছড়া, কলকাকলির গান, নিঝুম দ্বীপের গল্প কথা, ঘুম ভাঙ্গানো নদী, গল্প তবু গল্প নয়, রূপমের ছিরা খানা, তোমাদের জন্য গল্প, পরিচয় হোক বন্ধুর সাথে, শিশু তোর খেলার সাথী, ছোটদের নাটক মেলা প্রভৃতি।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। একাধারে  ছিলেন সুবক্তা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সংগঠক, চিত্রশিল্পী ও সফল উপস্থাপক। সত্তরের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান গণশিক্ষা ভিত্তিক ‘লেখাপড়া’র সফল ভাবে উপস্থাপনা করেন। আশির দশকে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় তার উপস্থাপিত অনুষ্ঠান ‘কল-কাকলি’। এছাড়া ২০১১ সালে কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও বের হয় বাংলা গানের অ্যালবাম 'গান আমার পরশমণি'।

কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য জুবাইদা গুলশান আরা সমাজে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যে রয়েছে দেশমাতৃকা, দেশের প্রতি দায়বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এগুলোর গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে জীবনকে দেখার এক অসাধারণ ক্ষমতা তার সাহিত্য। তার সাহিত্য রচনায় স্থান পেয়েছে অতীত ইতিহাস, বাংলার খেটে খাওয়া দারিদ্র্য-পীড়িত জনমানুষ। প্রকৃতির অপার রহস্যময়তা, মানব-মানবীর মনলোক, শিশু মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি। জুবাইদা গুলশান আরা মূলত শিক্ষাবিদ ও সৃজনশীল লেখিকা হলেও শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজ উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।

নারী উন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়নও নিয়েও নানাবিধ কাজ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের জন্মলগ্ন থেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আমৃত্যু এই সংগঠনের সহ-সভাপতি ছিলেন। লেখিকা সংঘ প্রকাশিত বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সঞ্চয়ন’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতেন তিনি সুনিপুণ ভাবে। পেন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখার সাহিত্যপত্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০২ সালে এশিয়ান উইমেন্স, ড্রামাটিক কনফারেন্স ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ও তার তৈরি শর্ট ফিল্ম ‘উইম্যান ওয়াক আপ ইটস টাইম’ ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। ২০০৫ সালে তিনি ‘উইম্যান অব দ্য ইয়ার’ উপাধিতে ভূষিত হন।

জুবাইদা গুলশান আরা দেশ-বিদেশ সফর করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি স্বামী মাহমুদ-উল-আমীনের সাথে ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। ২০০০ সালে উইমেন প্লেরাইট ইন্টারন্যাশনালের সেকেন্ড কনফারেন্স অন উইমেন এ্যাড থিয়েটার সম্মেলন ম্যানিলায় (ফিলিপিন্স) যোগদান করা ছাড়াও তিনি ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

গত ১৯ মার্চ ২০১৭, রোববার বেলা আড়াইটায় সিদ্ধেশ্বরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্তিকাল করেছেন। ইন্না নিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার সৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম, মানবিক বোধ আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবে। তার সাহিত্য পাঠককে যুগের পর যুগ আনন্দ দিয়ে যাবে। জীবন থেকে ছুটি নিলেও এই জীবনশিল্পী পাঠকের মন থেকে ছুটি নিতে পারবেন না কখনোই। পাঠকের মনের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্যে।

মৃত্যুর আগে তিনি সম্মানিত হয়েছেন বহুবিধ পুরস্কারে।  ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়া কবি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার, কমর মসতরী স্বর্ণপদক , বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন পদক, শের-এ বাংলা স্মৃতি পুরস্কার, জিসাস স্বর্ণপদক , কবি জসিম উদ্দীন পরিষদ পুরস্কার , চয়ন সাহিত্য পত্রিকা স্বর্ণপদক , বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক এবং লেখিকা সংঘ প্রবর্তিত ড. তাইবুন নাহার রশীদ স্বর্ণপদক , ত্রিভুজ সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার,  দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পুরস্কার , নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার ও আরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা লাভ করেন।

সাধারণ মানুষ থেকে সুশীলসমাজ পর্যন্ত সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের জীবনবোধ ও জীবনাচরণ তার সাহিত্যের পরতে পরতে লিপিবদ্ধ। জীবের জীবনকে নিয়েই ভেবেছেন তিনি। জীবনকেই উচ্চে তুলে ধরেছেন কলমের মাঝে। মাটি, মানুষ, দেশ, কাল, জাতি, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ তার সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। আজকে যাকে আমরা সাহিত্যের নক্ষত্র বলি, তাঁর বর্ণাঢ্য যাত্রা কৈশোরে হয়, তার গোড়াপত্তন ঘটে ভাষা আন্দোলনের গান ও আবেগ নিয়ে।  ভাষা আন্দোলন তার ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছিল, তাকে লেখক হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট