গুচ্ছ কবিতা



গুচ্ছকবিতা
লতিফ জোয়ার্দার


জুলফিকার


নিজের জগৎটাকে ছোট করতে করতে একদিন জুলফিকার একা হয়ে গেল
একদিন বন্ধু বলতে যারা ছিলো তাদের অনেকেই রাজনীতির পালা বদলে ভেসে গেছে
তার সংসার বলতে চারচালা টিনের ঘর এক চিলতে উঠোন আর এক বুড়োবৃক্ষ
করাতকলের চোখ এখন সেই বৃক্ষের দিকে। জুলিফকার মাঝে মাঝে ভাবে
হয়তো মৃত্যু হলেই ভাল হতো। এই পরম্পরায় বেঁচে থাকার অর্থ অবরুদ্ধ হয়ে থাকা
কিছু কিছু অনউচ্চারিত দুঃখ আল্পনায় আঁকা যায় না। নিয়তির কাছে থাকা না থাকার অর্থ
জুলফিফার একদিন বুঝেছিলো, যেদিন রেললাইনের ধারে পড়েছিলো কিছু লালরঙ রক্তের আল্পনা 

ক্রীতদাস

জেলখানার সাক্ষাত কক্ষে আজ আমি আমাকে দেখে চমকে উঠি
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আরেক আমি
যেন চিৎকার করে আমি আমার সাথেই কথা বলছি
আজ আর কোন আবেগ উচ্ছ্বাস নেই আমাতে
বিবর্ণ রেখায় সাদা আর্তনাদ খেলা করে যায় একা একা
প্রতিশোধ আর প্রতিরোধের আয়নায় দ্বিধান্বিত রাস্তায় আমি
অনাবৃত পায়ে কোন এক ক্রীতদাস।
মনে পড়ে যায় রিক্সায় আসতে আসতে
জেলখানার লাল প্রাচীরেরর সাথে দেখা হয়েছিলো আমার
অদ্ভুত প্রাচীরের চোখ দেখে আমি থমকে যাই
তখন কেবলি মনে হয় আমি এক অপরাধী পিতা
শিকল ভাঙ্গার গান ভুলে যাই আমি
কেবলমাত্র বেদনাকে পূজি করে অন্ধ কালাকানুন মেনে নেই আমি
আমি আমাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠি
অথচ এই দিনটির কথা কোনদিন মনে আসেনি আমার
আমি আমাকে দেখি! প্রশ্ন করি আমি এক ক্রীতদাস 
মিথ্যে প্রবঞ্চনার কাছে  বার বার হেরে যাই আমি


প্রেম

ফিরে এসে বলবে বলেও বলতে পারেনি সে। দ্বিদ্ধা সংকোচ আর ভয় ছিলো মনে
মাঝে কিছু লজ্জার লু-হাওয়া লেগেছিলো বুকে। ম্যানিপ্লান্টে লুকিয়ে রেখেছিলো সুখ।
মন খারাপ হয়েছিলো বলতে না পারার ব্যথায়। তবুও বুকে তার অসীম তৃষ্ণার ঘোর
আর চোখে তার তুলতুলে নরম বিড়ালের আদর। জানালায় রেখেছিলো হাত, মন তার
দিয়েছিলো উকি। বার বার প্রেম আসে মনে তবুও সে বুঝে না অদ্ভুত প্রেমের ঝুকি

কবি ও তার জন্মসনদ

সম্ভবত পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি
আমার পরে আর কোন কবির জন্ম হবে না
যেমন শেষ নবীর পরে আর কোন নবীর জন্ম হয়নি
আজো। এমন একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেবার পর
কিছু মানুষ আমাকে ভুল ভাবতে শুরু করলো
কিছু মানুষ আমি আস্তিক নাকি নাস্তিক?
এ বিষয়ে বিষদ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে
পারলো না।চৌচির মাটির মত তখন আমার বুকের অধর
অতঃপর  কেউ কেউ  আমাকে আক্রমন করে
কথা বলতে শুরু করলো। কাক-মৌলভীদের
আনাগোনা তখন চারদিকে। শরৎ সন্ধ্যায় বৃষ্টির শহর
আমাকে নিয়ে ব্যস্ত এ শহরের নাগরিক গণ
মিছিলে মুখরিত রাজপথ আমার ম-ুপাতের দাবীতে!
এমন একটা স্বপ্ন দেখার পর
কিছুতেই আমার চোখে আর ঘুম এলো না

মুখ

এই ক্ষণকালীন জীবন আমার ভালো লাগে না
শত বছরের যৌবন চাই আমি
হয়তো এমন চাওয়াতে কোন নতুনত্ব নেই
হয়তো আরো অনেকেই ঈশ্বরের কাছে এমনটাই চেয়েছিলো
হয়তো চায়ের দোকানী অটোচালক কিংবা কয়লাখনির
কালোচামড়ার শ্রমিকের চাওয়াতেও কোন ভিন্নতা ছিলো না
একদিন মৃত্যুদ- প্রাপ্ত কয়েদীও সংসারী হবার কথা ভেবেছিলো
মরে যাবার আগে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার কথা ভেবেছিলো
প্রিয়জনের আকুতি শুনেছিলো জেলখানার গুমোট হাওয়ায়
দীর্ঘশ্বাসের সাথে কিছু কথা বলেছিলো সে চুপিচুপি
আমিও তার মত করে শতবর্ষী বৃক্ষের মন চাই
মৃত্যু আমাকে ভেজা ভোরের হাওয়ায় ডাকে
একদিন জন্মচিৎকার শুনে যারা নতুন সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলা
সেখানেও মৃত্যু ছিলো। পাশাপাশি বিষাদমাখা একখানা মুখ
হয়তো প্রিয় এই বোবাশহরের ট্যাফিক জ্যামে আটকে আছি আমি
অথচ আমার দু’চোখে স্বপ্ন
আর দীর্ঘজীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অনন্ত আকুতি



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট