গল্প : আবিষ্কার



আবিষ্কার
জাহিদ হোসেন

কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে সোনিয়ার চিঠি পেয়ে আদনানের ভেতরটা ছটফট করে ওঠে। অনেক কথার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা নামক শব্দটি বারবার তাকে সোনিয়ার কাছে টেনে নিয়ে যায়। সে ক্রমশঃ পেছনের দিকে হাঁটতে থাকে।
সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। বাঙালি সংস্কৃতির এক উলে¬খ্য দিন। সকাল থেকেই আদনানদের কলেজ চত্বরে বসেছিল বৈশাখী মেলা। গ্রাম্য ঐতিহ্যের নানা আয়োজনে চারপাশ ছিল মুখর। প্রকাশিত হয়েছিল কলেজের সাহিত্য সংগঠনের পক্ষ থেকে কবিতা পত্র  ‘বোশেখের পাতা’। সেখানে ‘আবিস্কার’ নামে আদনানের একটি কবিতা ছাপা হয়। কষ্টের কথায় মোড়ানো এই কবিতাটির অবয়বে ছিল ভালবাসার তৃষ্ণা। ছিল ঘৃণার বিদ্রুপ ভুলে যাবার জিয়নকাঠি। পহেলা বৈশাখের সেই আনন্দের দিনে কবিতাটি পড়ে কারও মনে কোন প্রশ্ন জেগেছিল কিনা জানা নেই কিন্তু নানা প্রশ্ন নিয়ে সোনিয়া নামের এক অপরিচিতা উপস্থিত হলো।
রাতে ঘুম হয়নি। আদনান কলেজের পশ্চিম দিকের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে ঝির ঝির শব্দে বাতাস বইছে। সে বাতাসের সুরে সুরে বৈশাখী আয়োজনের কলরোল ভেসে আসছে। হঠাৎ মেয়েলি কন্ঠে সে চমকে ওঠে। এক্সকিউজ মি! মুখ ফেরাতেই ঝটপট প্রশ্ন এলো, আপনার লেখা আবিস্কার কবিতাটি পড়লাম। কষ্টের কথা দিয়ে এখানে ভালোবাসাকে কিন্তু বেশ শাসিয়েছেন। আবার ঘৃণাকে ভুলে যাবার সুনিপুণ যুক্তিও ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটি আমার খুব ভাল লেগেছে। কাজিন এর কাছে পরিচয় জেনে তাই কথা বলতে এলাম। আপনি মনে কিছু নেন্নি তো? এক নিঃশ্বাসে মেয়েটি অনেকগুলো কথা বলে গেল। আদনান বিস্মিত না হয়ে পারলো না। যে মেয়েটিকে সে চেনে না, কোনদিন দেখেছে বলেও মনে পড়ে না তাকে হঠাৎ কেন যেন ভাল লেগে গেল। অসংখ্য ভাবনার ভিড় ঠেলে সে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনি- মেয়েটি দ্রুত বাধা দিয়ে বললো, আমাকে তুমি বললেই খুশি হবো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আদনান আবার জিজ্ঞেস করলো, তুমি- কথা শেষ না হতেই মেয়েটি উত্তর করলো, এখানে খালার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমার নাম সোনিয়া, চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। বলেই সে হাত বাড়িয়ে একটা ডায়েরি আদনানের সামনে মেলে ধরে আবেদনের সুরে বললো, পি¬¬জ একটা অটোগ্রাফ দেবেন। মেয়েটি যে অত্যন্ত চঞ্চল, আদনানের বুঝতে কষ্ট হয় না। চঞ্চল মেয়েদের চঞ্চলতা কি কারণে যেন ভালই লাগে। সে মুচকি হেসে ডায়েরি হাতে নিতে নিতে বললো, আজ পহেলা বৈশাখ। তুমি নিশ্চয় জানো। মেয়েটি ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর করলো, জি জানি। আদনান বললো, দেখ তোমার বয়সি মেয়েরা বেশ সেজেছে। পড়েছে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলি, রজনীগন্ধা ফুল। হাতে রিনিঝিনি বাজছে নানা রঙের চুরি। কিন্তু অবাক হচ্ছি তোমাকে দেখে। তুমি মোটেও সাজনি। জানতে পারি, সাজনি কেন? খানিকটা সংকোচ নিয়ে দুষ্টমির সুরে সোনিয়া বললো, অনেকেই বলে, সাজলে নাকি আমাকে ভাল লাগে না। সে জন্য সাজিনি। আদনান অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, সোনিয়া আসলেই সুন্দর। তবে সাজলে ভাল লাগবে কিনা বুঝতে পারলো না। ডায়রির পাতায় কিছু একটা লিখতে, লিখতে সে সোনিয়াকে আবার প্রশ্ন করলো। ক’দিন এখানে থাকবে। সোনিয়া উত্তর করলো বেশ কটাদিন। আদনান সময় নিয়ে বললো, আবার কি দেখা হবে। মিষ্টি হেসে সোনিয়া উত্তর দিলো- হয়তো হবে। এরপর থেকে প্রায়ই ওদের দেখা হতে থাকে। আর এর রেস ধরে একপা, দুপা করে কখন যে ওরা ভালোবাসাবাসির খেলায় জড়িয়ে গেছে বুঝতে পারে নাই। সময় কারও জন্য বসে থাকে না। সোনিয়ার যাবার সময় হয়ে আসে। যাবার আগে আদনানের সাথে অনেক কথা হয়। কথার ফাঁকে হঠাৎ কি জানি কি ভেবে সোনিয়া বলে ওঠে, আদনান তোমার কবিতা দিয়েই আবারও আমার আবিস্কার ঘটবে। সেদিন যেন আমাকে চিনতে ভুল করো না। সোনিয়া বিদায় নেয়। আদনান এ কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারে না। মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
আজ যখন সে সব কথা মনে পড়ে তখন তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা শুরু হয় এক ভাবে তবে সব ভালোবাসা শেষটা বোধ হয় একরকম হয় না। যেমনটি তাদের হয়নি। জীবনটাকে মধুময় করার অভিপ্রায়ে ওরা যখন উদ্বিগ্ন তখন সোনিয়ার হঠাৎ প্রস্থান আদনান মেনে নিতে পারে না। সংবাদ আসে রোড এক্সিডেন্টে সোনিয়া পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। একটা অদৃশ্য কষ্টে আদনানের সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে কিন্তু কাউকে কিছু জানাতে পারে না। মানুষের অনেক কষ্ট থাকে, সব কষ্টের কথা বলা যায় না। এরপর থেকে আদনান অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে যায়। মনের অজান্তে খানিকটা অনিয়মের মধ্যে বসবাস শুরু হয় তার। অধিক রাত জেগে থাকা, অসময়ে নাওয়া খাওয়া, কোন কিছুতেই মনোযোগ আসে না। ছেলে মেয়ের কিছু হলে মায়েরা তা আগাম বুঝতে পারে। একমাত্র ছেলের এই নিশ্চুপ অনিয়মের মধ্যে বসবাস আদনানের মা আমেনা রহমানের চোখ এড়াতে পারে না। সে ছেলের সাথে আদনানের বাবা মাহবুব রহমানের অনেক মিল খুঁজে পেলেও খানিকটা অমিল লক্ষ্য করে ভড়কে যায়। আদনানের বাবা ছিলেন একজন সৃজনশীল সাহিত্য প্রেমী মানুষ। তার লেখা কবিতা, গল্পে উঠে আসতো মাটি, মানুষ ও স্রষ্ঠার চিত্রপট। সে ছিল অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ মানুষ,   পক্ষান্তরে আদনান বাবার সাহিত্য ভাবনাকে অন্তরে ধারণ করে থাকলেও বাবার মতো হয়নি। সে স্বল্পভাষী এবং ঘরমুখো। আদনানের মা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, আদনানের বাবা একজন রহস্যাবৃত মানুষ। আর এই কারণে তাদের মধ্যে নানা রকম সন্দেহের সৃষ্টি এবং বাকবিতন্ডাও হতো। কারণে অকারণে আমেনা রহমান আদনানের বাবাকে এমন সব প্রশ্ন করে বসতেন, যার উত্তর মাহবুব রহমান খুজে পেতেন না। নিখাদ ভালবাসা আজ আমেনা রহমানকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যার চারপাশে শুধু সন্দেহ, দিধা-দ্বন্দ আর মিথ্যা বিশ্বাস। আদনানের বাবা সবকিছু বুঝতে পারলে স্ত্রীর উপর আচর হওয়া এই অপছায়াকে দূরে ঠেলে দিতে পারে না। যার প্রেমের পরশে আজ তিনি একজন লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তার এই অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে বসবাস মাহবুব রহমানকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। অনেক কথা থাকে যা বলা যায় না। তিনি কাউকে কিছু বলতে পারেন না। এক ধরনের চাপা আর্তনাদে তার বুকের ভিতরের পুরোনো ব্যথাটি ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং একদিন প্রত্যুষে হঠাৎ করেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আজ আমেনা রহমান একটু একটু করে বুঝতে পারছেন তার ধারণা সম্পূর্ণ রূপেই মিথ্যে ছিল। যে মিথ্যে ধারণাকে সম্বল করে তিনি বার বার কষ্ট পেয়েছেন এবং আদনানের বাবাকেও কষ্ট দিয়েছেন, সেই একই ধারণা তিনি ছেলের মধ্যে খুঁজে পেয়ে চমকে ওঠেন। তার সমস্ত অবয়ব দুঃচিন্তার চাদরে ঢেকে যায়।  না-না, তা হবে কেন? তিনি নিজেকে চিন্তামুক্ত করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে মুছতে দরজা ঠেলে ছেলের কাছে এসে বসে। আদনান বিছানায় শুয়ে ছিল। মাকে দেখে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, মা এসো, বিনীত স্বরে বলল কিছু বলবে? ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আমেনা রহমান বললো, বাবা তোমার কি কিছু হয়েছে ? ইদানিং খুব অন্যমনস্ক থাক। বহু কষ্টে আদনান ভেতরের যন্ত্রণাকে আড়াল করে থেমে থেমে বললো, কই নাতো। কিছু হয়নি মা। তুমি অযথা চিন্তা করছো। নরম সুরে আদনানের মা বললেন, তোমার বাবা বেঁচে নেই। তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তুমি যদি ভেঙে পড়ো তাহলে এ সংসারের হাল কে ধরবে। প্রতিটি মানুষের জীবনে বিশেষ কিছু সময় আসে কিন্তু সে সময় মনের ভিতর লালন করে কষ্ট নেয়া ঠিক নয়। এটা তো মানতেই হবে করুণাময় যা করেন তা ভালর জন্যই করেন। মায়ের কথায় আদনান খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবে, মা কি কিছু জেনে ফেলেছেন। এক ধরনের লজ্জায় তার মুখটি শুকিয়ে ওঠে।
বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমেনা রহমান হতাশ গলায় বললেন, কখন যে ওপারে চলে যাই বাবা ঠিক নেই।  শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। আমি তোমার বিয়েটা দেখে যেতে চাই। তুমি চিন্তা করে আমাকে জানিও। ধীর পায়ে আমেনা রহমান পা বাড়ান। আদনান অবাক দৃষ্টিতে মায়ের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এর কিছুদিন পর আদনান বিয়ে করে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সে আস্তে আস্তে সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ভাবেই দিন যায়। একদিন এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে প্রতিবন্ধী সংস্থার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে সে থমকে যায়। মঞ্চ থেকে কেউ একজন তার লেখা সেই ‘আবিস্কার’ কবিতাটি ভাঙা ভাঙা কন্ঠে আবৃত্তি করছে।
‘আমার আবিস্কার সেতো যন্ত্রণার
কিন্তু বড় বেশি তৃষিত আমি ভালোবাসায়,
কষ্টের গরিমা থেকে ভালোবাসা পেতে
কে না ভালোবাসে।’
সে উৎসুক হয়ে এগিয়ে এসে মঞ্চের পাশে দাঁড়ায়। পা হীন একটি মেয়ে হুইল চেয়ারে বসে তার লেখা কবিতাটি আবৃত্তি করে চলছে। মেয়েটির চোখে কালো চশমা। সমস্ত অবয়ব, মুখমন্ডল কাপড়ে ঢাকা। আদনান মেয়েটিকে চিনতে পারে না। তার মনে হাজারও প্রশ্ন জাগে, কে এই মেয়ে? এক ধরনের কৌতুহল নিয়ে, সেদিনের মত সে বাসায় ফেরে। পরদিন প্রতিবন্ধী সংস্থায় এসে সংস্থা প্রধানের সাথে কথা বলে জানতে পারে, এই সেই রায়না মির্জা। যার মৃত্যুই হয়েছিল কিন্তু বিধাতা তাকে কি জানি কি অদৃশ্য কারণে বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে সে অন্ধ হয়ে গেছে। শরীরের অনেক অংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। সংস্থা প্রধান আদনানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, একবার ভেবে দেখুন, একটা দুর্ঘটনা মানুষকে কতটা অসহায় করে ফেলতে পারে। তারপরও কি আমরা সচেতন হতে পেরেছি কিংবা দুর্ঘটনা এড়াতে সরকার কি কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন ? জানেন আমরা আসলে দুর্ভাগা। আদনানের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়ায়। তার কানে বার বার সোনিয়ার সেই কথাটিই বাজতে থাকে। হয়তো আবারও তোমার কবিতা দিয়েই আমার আবিষ্কার ঘটবে, সেদিন যেন আমাকে চিনতে ভুল করোনা। আদনানের চোখের পাতা ভিজে আসে। ইচ্ছে করে সোনিয়ার সাথে দেখা করে কিন্তু পারে না। তার মনে হয়, যে যন্ত্রণাকে ভালবেসে রায়না আজ সুখ খুঁজে নিয়েছে সেখানে তার উপস্থিতি শুধু দুঃখই বাড়াবে। সে প্রতিবন্ধী সংস্থা থেকে ক্লান্ত মনে বের হয়ে বিড় বিড় করে বলে যায়, সোনিয়া তোমার কথাই ঠিক। আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা করে দিও.....।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট