প্রকৃতিও সেই টানের কাছে বরাবরই পরাজিত




প্রকৃতিও সেই টানের কাছে বরাবরই পরাজিত।
আহমদ মেহেদী

ভার্সিটির বন্ধুদের মধ্যে আমিই গ্রামের বলে তারা আমার গ্রাম দেখতে যেতে চাচ্ছে, কয়েকদিন ধরে রিন্টু পিড়াপিড়ি শুরু করে দিয়েছে। আমি হঠাৎ বলে দেই যাবি, অবশ্যই যাবি, কোনদিন যেতে চাস বল? রিন্টু উচ্ছাসে বলে কেন পরশু যাব, ভার্সিটি ত বন্ধই, তবে একটি শর্ত নাইট কোচে যাব যাতে করে খুব ভোরে গিয়ে পৌছাতে পারি, কত শীত যায় আসে, কাঁচা খেজুরের রস ঠিক কবে খেয়েছি এখন তা আর মনে পড়ে না। তোর গ্রামে পৌঁছেই একেবারে টাটকা রস খেতে চাই। -ওকে, ডান। তাদেরকে কথা দেবার সময় দিয়েছি কিন্তু তারা কি আদৌ জানে আমার বাবা পুনরায় বিয়ে করায় তাকে পাঁচ  বছর আগেই একেবারে ছেড়ে চলে এসেছি আমি ? জিগাতলার একটি জীর্ণশীর্ণ মেসে টিউশনি করে, খেয়ে না খেয়ে চলছে কোন রকম। পৃথিবীর সব সহ্য করতে পারি মায়ের জায়গায় লাল লিপিস্টিক মাখা ঠোঁটে অন্য মায়ের পদচারনা মানতে পারি না এবং তার আঁচলে থাকতে চাইনা আর চাইবও না! শুনেছিলাম বাবা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। এই বুঝি তার ভালবাসার নমুনা? মৃত্যুর চল্লিশ দিন না পেরুতেই আবার  বিয়ে ! ভাবছি কী করা যায়। খেজুর গাছগুলি কি আগের মত আছে? মালেক মিয়া কী এখনো জীবিত আছে, ঘটি দেয় এখনও।

রাত তিনটা বাজে। ছেলেবেলার কাছারি ঘরের সামনে আমি। শীত পড়েছে খুব। রিন্টুরা উঠানে দাঁড়িয়ে। কয়েকবার দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে বাবাকে ডাকলাম। বাবা এত রাতে আমাকে দেখে খুব অবাক হন। কিরে পুত, তুই কেমন আছিস? ঘুম ভাঙা বাবার চেহারায় অসহায়ত্বের ভাব। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাছারি ঘর আমাদের জন্য ছেড়ে দিলেন, আলমারি থেকে লেপ নামিয়ে দিলেন। নতুন মা আমাদের জন্য আবার ভাত রান্না করলেন সাথে বেগুন ভর্তা আর ফ্রিজে রাখা শিং মাছের তরকারি। বেগুনের ভর্তা খুব প্রিয় আমার বাবা আজও মনে রেখেছেন? আমার ছোট্ট একটি বোন হয়েছে, কী সুন্দর! একেবারে যেন আমার মায়ের ফটোকপি। পুস্পা তাঁর নাম। প্রকৃতি মানুষের কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়ে যায় আবার দিয়েও যায়। অস্ফুট স্বরে আমাকে ভাইয়া বলে ডাক দিলে ভেতর টা কেমন জানি নড়ে উঠল।

বাবা ফজর পড়ে আমাদের জন্য টাটকা খেজুরের রস নিয়ে এলেন। নিজ হাতে দুধ-ছাকনি দিয়ে ছেঁকে দিলেন। রিন্টুরা সেই রস অমৃতের মত খেল। রোদ উঠতে শুরু করলে বন্ধুরা মিলে নিজের পুকুরের  তরতাজা সরপুঁটি, কই, শিংও খইয়া মাছ ধরলাম। দুপুরে তা রান্না হল সরিষার তেলে আর মায়ের স্পেশাল মাসকলাই রেসিপি। সিএনজি দাড় করানো। বাজারের স্টেশনে যেতে হবে। বাবা আমাদের জন্য বি আর টি সি’ র টিকিট আগেই কিনে রেখেছেন। বাবা পিছন থেকে ডাকলেন, শোন বাবা! তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বলে একটি টাকার বান্ডিল আমার হাতে দিয়ে দেয়। নতুন মা কিছু লাউয়ের ডোগা, ব্যাগভর্তি মাছ, ডিম দিয়ে দেন। সত্যি ওনাকে সৎ মা’র মত একবারও মনে হয়নি। তাকে নিয়ে আমার ভুল ধারনার ভেঙে গেল নিমিষে। পুস্পা আমার হাত ছাড়ছেই না। বলে, ভাইয়া আমাকে ঢাকায় নিবে একদিন? আবার আসার সময় একটি কোন আইসক্রিম নিয়ে আসবে! পুস্পা আমাকে জড়িয়ে ধরতেই অনুভব করলাম এ যেন আমার চিরচেনা মায়ের বায়না, ব্লেড দিয়ে কাটা সেই নাড়ি- পাখিরই টান যা উপেক্ষার শক্তি অন্তত আজ নেই আমার। প্রকৃতি ও সেই টানের কাছে বরাবরই পরাজিত।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট