গল্প : চপেটাঘাত



  চপেটাঘাত
তন্ময় আলমগীর

‘ছলিম ভাই, কাঞ্চইন্যে আঙুরার সাথে ফষ্টিনষ্টি কইরা বেড়ায়। ওরে সাবধান কইরা দিয়েন। নাইলে কিন্তু ল্যাংরাডার বাকি ঠ্যাংডাও কাইট্টেলামু’। বেশ উচ্চকন্ঠে কথাগুলো বলল সুলতান। রাগে গলার স্বর কাঁপার সাথে সাথে ঠোঁট জোড়াও কেঁপে ওঠল। লাল হয়ে গেল মার্বেলের মত ঢাসা ঢাসা চোখ দুটো। উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কাঞ্চনকে এখন সামনে পেলে জিন্দা মাটিচাপা দিবে। ছলিম ভাই পানের মধ্যে খয়ার লাগিয়ে মুখে দিয়ে সিগ্রেটটা হাতে নিলেন। পানের সাথে সিগ্রেট না খেলে জমে না। সিগ্রেটে আগুন ধরাতে ধরাতে বললেন- আমি ব্যাপারটা দেখতাছি। তুই তোর কাম-কাজ ঠিক মতো কইরা যা।
  সুলতান আর কথা বাড়ায়নি। বাড়ানোর দরকারও নেই। ছলিম ভাই যেকোন অভিযোগ গুরুত্বের সাথে নেন। সুষ্ঠু বিচারের ক্ষেত্রে আপোসহীন। দশ বছর ধরে দেখে আসছে ছলিম ভাইকে। সেই ভরসায় সুলতান খানিকটা ভারমুক্ত হল। প্রথমে ভেবেছিল সমস্যার সমাধান নিজেই করে ফেলবে। কিন্তু ছলিম ভাইকে না জানালে হিতে বিপরীত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। জানিয়ে ভালই হলো। দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছেন, নিশ্চয় বিচার হবে কাঞ্চনের।
  ছলিম ভাইর বিশ্বস্ত সহযোগী সুলতান। অতিক্রান্ত দশ বছরে সে দেখেছে ১২ জনের করুন পরিণতি। কারো পায়ের রগ, কারো কব্জি, কারো চোখ মর্মান্তিকভাবে উপড়ে ফেলা। নিপুণ দক্ষতার সাথে ছলিম ভাই এসব নির্মম কান্ড ঘটিয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে অপরাধ মনে হলেও নিজেদের পেট ভরার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষুধার্থ মানুষের পাতে জুটেছে খাবার, মুখে ফুটেছে হাসি, পরিবারে এসেছে সুখ।
  কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে হাসপাতালের বারান্দায় ধুকে ধুকে মরতে বসেছিল। ছলিম ভাইর নির্দেশে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে আনে সুলতান। এনে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙা পাটাকে একেবারে অচল করে ফেলে। তারপর ভিক্ষার থালা হাতে ধরিয়ে বসিয়ে দেয় শাহআলী মাজারের প্রধান গেটে। পঙ্গু কাঞ্চনকে ফেলে চলে যায় তার বউ। নারীসঙ্গহীন কাঞ্চন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। হাত বাড়ায় সুলতানের বড় মেয়ে আঙুরার দিকে। জমেও যায় বেশ। ছলিম ভাইর কিছু পরিবারহীন বাধিত ভিক্ষুক রাতের বেলা একসাথে হলে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে আঙুরা। তারা একসাথে ঘুমায়। পাশের ছাউনি করা ঘর থেকে শেষ রাতের নির্জনতার ভেতর কাঞ্চনের কাছে আসতে আঙুরার অসুবিধা হতো না। খুব সতর্কতার সাথে চলছিল সে সম্পর্ক। একদিন সুলতানের কাছে সব গোমর ফাঁস হয়ে যায়।
  ছলিম ভাই সবাইকে নিয়ে দরবার করতে বসলেন। কাঞ্চন, আঙুরা দুজন দুদিকে বসল। বাকি সবাই সামনে। ছলিম ভাই বসেছেন মোড়ার ওপর। দু পক্ষের বক্তব্য শোনার পর কিছুক্ষণ নিরব থেকে খয়ার সম্বলিত পান মুখে দিয়ে একটা সিগ্রেট ধরালেন। এই রাজ্যের একচ্ছত্র রাজত্ব তার। যা বলবেন তার একবিন্দুও নড়চড় হবে না। তাই ভেবে চিন্তে ফয়সালা করা তার নৈতিক দায়িত্ব।
  তিনি সবাইকে বিশেষ করে কাঞ্চন ও আঙুরাকে উদ্দেশ্য করে একটা কাহিনী শুনালেন। বললেন- আমি ছিলাম বাবার একমাত্র ছেলে। ছোটবেলায় ভাতের অভাব অনুভব করিনি। যখন যা চেয়েছি, পেয়েছি। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় বিপাকে পড়ে গেলাম। তখন আমার বয়স সতের-আঠার হবে। বাবা অন্যের জমিতে বদলি কাটত। অল্প কদিন স্কুল মাড়ানো আমিও শুরু করলাম সে কাজ। মা কিছুদিন পর আমাকে বিয়ে করিয়ে দিলেন। সুখেই কাটছিল সংসার জীবন। সুস্থ-সবল এই আমি প্রতিদিন বদলি দিতাম। খানা-খাদ্যের অভাব হত না।
  বউ গর্ভবতী হল। আমাদের আনন্দের সীমা নেই। পোয়াতি বউয়ের যতœ-আত্মীর ঘাটতি রাখতাম না। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মাসখানেক আগে কষ্ট করে কিছু টাকা জমিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। পেটে ব্যথা ছিল। ডাক্তার বলল সিজার করতে হবে। টাকা লাগবে ত্রিশ হাজার। নয়তো বাচ্চা বাঁচানো যাবে না।
  আমি সিজার করাতে মনস্থির করলাম। যেভাবেই হোক আমার রক্তের ধনকে পৃথিবীতে আনবই। অতিরিক্ত পরিশ্রম করেও সব টাকা জোগাড় করতে না পেরে একরাতে মহাজনের গোদাম থেকে কয়েক বস্তা চাল সরাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। এর আগের চুরিগুলোর দায়ভারও আমার ওপর চাপিয়ে মামলা করে জেলে ঢুকিয়ে দিল। অপর দিকে সিজার লাগেনি। আল্লাহর রহমতে মা-ছেলে দুজনই সুস্থ।
  জেলে থাকতে থাকতেই আমার মা মারা গেল। কী কারনে জানি না, বউ কিছুদিন নিয়মিত যোগাযোগ করলেও মা মারা যাওয়ার পর থেকে অনিয়মিত হয়ে গেছে। এক সময় একেবারে উধাও। দু বছর জেল খেটে বের হয়ে এসে দেখি এ সংসারে আমার আমি ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ঠ নেই। অনেক খুঁজেও বউ-সন্তানের সন্ধান পেলাম না। প্রতিদিন পরিশ্রম করে টাকা উপার্জনের বিকল্প ভেবে শহরে চলে আসলাম। বস্তিতে ঘুমাতাম। দেখতাম তোদের মত ভিক্ষুকদের সর্দার আছে একজন। সেই সব নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যস, চোখ বুজে সে পথে নেমে পড়লাম আমি।
  এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু দম নিলেন। পানের সাথে সিগ্রেটও শেষ। আরেকটা সিগ্রেট ধরিয়ে আবার শুরু করলেন- আমার গল্প শেষ। এবার আসল কথা শোন। টাকার অভাবে আমার বউ চলে গেছে। পঙ্গু হওয়ার কারনে কাঞ্চনের বউ চলে গেছে। অথচ দেখ, পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও আঙুরা কাঞ্চনকে ভালবাসে। এতে খুব খুশি হয়েছি আমি। এতো পুঁজিবাদী সমাজের দুইগালে চপেটাঘাতের শামিল। আঙুরা এবং কাঞ্চনকে আমি নিজ হাতে বিয়ে দিতে চাই। কী বলিস তোরা?    



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট