গল্প : মা



মা
মো: ওবায়দুল হক

তিতাস নদী। এও যেন আমাদের অন্যএক মা। মায়ের মতোই মমতা বিলিয়ে যায়। নদীটা যেন আমাদের তিতাস পাড় বাসীর প্রাণ।বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নদীঘাট। আমাদের পাড়ার নারী পুরুষ সকলে এই ঘাটে প্রক্ষালনে আসা। নিজ নিজ কৌশল প্রয়োগে কতোটা দক্ষতা তাদের! কেবল দেখলেই বোঝা যায় স্নানও একটা আর্ট! দুপরে গোসোল করতে এলে, প্রায়ই দেখতাম মা তার আঁচল দিয়ে আমার বাবার হাত, পা, পিঠ ঢলে দিতেন। সাবানের ফেনা ভর্তি সেই একই আঁচল দিয়ে আমার শরীর ও মেখে দিতেন জলে মাখা পবিত্র মমতা। খুব মনে পড়ে শৈশবের স্মৃতিমাখা সোনালি দিনগুলোর কথা। মাঝ রাতে বেলকনীতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি.. আমার মায়ের কথা। মায়েদের আঁচলগুলো ভালোবাসার ফুল বিলাতে কতো দক্ষতাময়। মায়ের শাড়ির প্রতিটা সুঁতো যেন এক একটা মমতার সাগর, যা সন্তানদের জন্য প্রভুর দেয়া নিঁখুত উপহার!!

সেচ্ছায় যেখানে এসে নারীর জীবনের সব স্বাদ আহ্লাদ আত্মসমর্থন করে সেটা হলো সন্তানের প্রতি  ভালোসা মায়া মমতা। আমার বোন সাদিয়া, খুব অন্য রকম একটা মেয়ে। ফ্যাসান এবং সাঁজগুজ করাই  ছিলো নেশা। বাবা ওকে আদর করে পাঙকু মেয়ে বলে ডাকতো!  বাচ্চাদের আদর করা। কুলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এটা  উঠতি বয়সি মেয়েদের একধরনের ভালোলাগা হলেও সাদিয়া ছিলো  ব্যতিক্রম । কখনো ছোট বাচ্চা কুলে নিতো না, কাপড় ময়লা হয়ে যাবে বলে। অথচ ওর বাচ্চাটা জন্মানোর পর কত বদলে গেছে! ওর সন্তানের প্রতি মায়া, মমতা, দায়িত্ববোধ দেখে আমি রীতিমত অভাক হই! ওর ছেলেটা রাতে খুব কাঁন্না করতো, কাঁন্নার তীক্ষè আওয়াজ, শুধু ঘরের মানুষই না, আশপাশের মানুষগুলোর ও ঘুমের বিঘœতা ঘটতো। আমি ওর মুখে এতোটুকোও বিরক্ততার ছাপ দেখতে পাইনি। ‘বাবারে সোনারে’ বলে বাচ্চাটাকে শান্ত করার কী যে প্রয়াস.! আমি মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে থাকিয়ে ভাবতাম ‘বোনটি আমার এখন আর আগের সাদিয়া নেই; ও মা হয়ে গেছে! মাতৃত্ব নারীজীবনের শ্রেষ্ঠ পূর্ণতার নাম।


আমার বাবা শ্বাস কষ্টের রোগী। বাবার এই হাঁপানি রোগটা তার জন্ম থেকেই। বছরে দু একবার এই অসুখটা দেখা দিত। সেই সময়টাতে বাবা এতোটাই কাঁশি হতো। কাঁশতে কাঁশতে বাবা অস্থির হয়ে ওঠতো। আমার মা নিজে না ঘুমিয়ে বাবার পাশে বোসে থাকতো। আমি দেখেছি, বাবার প্রতি  নিখুঁত সেবা,  স্বামীবোধ। বাবাকে ধরে ঘরে বাহিরে নেয়া। কুসুম গরম জল দিয়ে গোসল করানো। পিতলের চামচে রসুন আর সরিষার তেল গরম করে বাবার বুকে মালিশ করে দিতো। এতোটাই কাঁশি হতো, সবসময় একটি মাটির পাতিলে ছাই ভরে বাবার পাশে রাখতে হতো, কাঁশি ফেলার জন্য। মা সারারাত জেগে বাবার পাশে বসে থাকতো..।  কখনো কখনো খুব তীব্রহয়ে অসুখটা দেখা দিত।  বাবা কষ্টে গলাকাটা মোরগের মতো ছটপট করতে থাকতো। মনে হতো এই বুঝি আমরা বাবাকে হারিয়ে ফেলছি। তখন মা আমার অসহায় হয়ে ওঠতো। মা, চিৎকার করে বলত,‘আরে যা তাড়াতাড়ি গিয়া ইমাম সাবরে ডাইকা নিয়া আই।’ পাড়া গাঁ। বেশ দূরে হসপিটাল থাকার কারনে যে কোন কঠিন মুহূর্তে মসজিদের ইমাম সাহেবই ছিলো একমাত্র গন্তব্য! ইমাম সাহেব এসে বাবার মাথার পাশে বেেস ইয়াসিন সুরা পড়ে ফু দিতো। আর বাবার মুখে আঙুল ভিজিয়ে পানি দিতো। মা আমার পর্দার আড়াল থেকে কাঁন্নাভেজা চোখে তাকিয়ে থাকতো। পৃথিবীর সমস্ত অসাহায়ত্ত্ব যেন নেমে আসতো মায়ের মুখে। আর আমরা ভাই বোনগুলো বাবার সিতানের পাশে দাঁড়িয়ে অসহার মতো কাঁদতাম।

আমি বাবা হতে চলছি! এই আনন্দটা আমাদের ফ্যামালির সবার মনে আকাশ ছোঁয়া! আমি যেমন আমাদের ফ্যামেলির বড় ছেলে, স্নিগ্ধা ও ওদের ফ্যামিলির বড় মেয়ে। এই মাসেই মা হবে, স্নিগ্ধার কন্ডিসন তেমন ভালো না। কয়েক মাস আগে থেকেই ডক্টর আপা যেভাবে বলেছেন, সে ভাবেই আমার মা ওকে আগলে রাখছেন। যখন জানতে পারলেন ওর টুইনবেবি হবে, সে থেকেই স্নিগ্ধা কেমন যেন আতঙ্কে ভুগছেন। হাসি খুশি চঞ্চলা বউটা আমার কেমন যেন নীরবতার দখলে চলে গেলো। মাঝে মধ্যে আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে। অবুজ শিশুর মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমিও পরুম মমতায় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দেই। ওকে আমি এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেই না। সারাক্ষন পাশে থেকে সাহস দিয়ে যাই। আজ সকাল থেকেই ও কেমন যেন ছটপট করছিলো। আমি আমার শ্বশুর শ্বাশুরীকে ফোন করে  উপজেলা হসপিটাল আসতে বলে, মা আর আমি স্নিগ্ধাকে নিয়ে ভ্যানে উঠেলাম। যথা সময়ে এসে পৌছালাম। এমারজেন্সিতে ডোকার আগে আমার মা ও তার মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। তার পর ওদের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘আম্মা, আমার জন্য দোয়া করবেন। আর যতো ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে দিবেন। স্নিগ্ধার শেষ কথাগুলো আমার বুকের ভিতরের কাঁন্নার নদীটার বাঁধ ভাঙছে। চোখের জলে ভাবছি, ‘বউ আমার মা’ হতে যাচ্ছে , মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে...


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট