আমার একটা দুঃখ ছিল !



আমার একটা দুঃখ ছিল !
মাহবুবা নাছরিন শিশির

বৃষ্টির কথা থাক, বিরহের কথা বলি...
আকাশের কথা থাক, হৃদয়ের কথা শুনি,
যদিও বিরহ তবু মিলনের স্বপ্নজালই বুনি..
আজ আমরা বিরহের কথা বলবো। বাংলা একাডেমী  ব্যবহারিক বাংলা অভিধান এ আছে ‘বিরহ’ শব্দটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ [১] বিচ্ছেদ (প্রিয়জনের সাথে); [২]অভাব, শূন্যতা,  [৩] শৃঙ্গার রসের অন্যতম একটি অবস্থা। অভিধান মেনে হয়তো কারো জীবনে বিরহ আসেনা। তবে অনেক বিরহী-বিরহিণীর বিরহ অভিজ্ঞতা থেকেই এই অর্থ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একদিন আগে অথবা একদিন পরে বিরহের সরব উপস্থিতি আলোড়ন তোলে প্রতিটি মানব-মনে । বিজ্ঞানীদের গবেষণামতে প্রেম-বিরহের অনুঘটক হিসেবে ‘অক্সিটোসিন’ নামে এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক হরমোন দায়ী। প্রেমে পড়লে যেমন এই হরমোন বিপরীত ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ তৈরি করে, তেমনি বিরহের সময় স্মৃতিকাতর করে তোলে।
সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এক অপার বিস্ময়। একজনের পক্ষে এক জীবনে  সমগ্রটা জানা সম্ভব নয়। তাই অন্যদের অভিজ্ঞতার সাহায্য নিতে হয়। নিজের ও চারপাশের মানুষদের দিকে তাকালেই জানা যায় কত বৈচিত্র্য মানবজীবনে। মানুষের অনুভূতিগুলো সংক্রামক। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা-বিরহ। কারো মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেলে তা যেন অপরের ঠোঁটের কোণে হাসির কারণ হয়ে পড়ে । অন্যের কান্না দেখলে ব্যথিত মনে শোকভাব সঞ্চারিত হয়, হৃদয় করুণায় ভরে যায়। ভয়ানক দৃশ্যে ভয়, রক্তাক্ত দৃশ্য বা খুন জখম দেখলে শিহরণ জাগে, বীভৎস লাগে, একইভাবে কখনো ঘৃণা, কখনো মন খারাপের কারণে, মানবিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ কখনো সমান্তরাল, কখনো বৈরী আচরণ করে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে।  কেউ কেউ এই বৃষ্টিতে আনন্দিত। বৃষ্টির ছন্দ তাদের মুগ্ধ ও মোহিত করেছে। কেউ ব্যথিত। কারো চোখের জল আর বৃষ্টির জলের সমান্তরাল ধারা বহমান। কেউ বৃষ্টিতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করছে, কেউ কর্মব্যস্ত জীবনের তাগিদে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কর্মক্ষেত্রে ছুটছে। অর্থাৎ এক এক জনের এক এক মতিগতি; একই সময়ে সবাই বিরহী নয়। তবুও বিরহীর মনে ‘বিরহ’ অন্তরের অন্দরে খেলে যায় নিভৃতে। মন থাকেনা মনের ঘরে। প্রিয় সান্নিধ্যে ব্যাকুলপিয়া। যে বিরহবিধুর সেই বোঝে বিরহের কী অনুভূতি। বিরহসম্পর্কে যারা অজ্ঞাত তাদের কাছে ব্যাপারটা হলো এমন:
 চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে !
 কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
 কভু আশীবিষে দংশেনি যারে !
 যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
 তোমার অবস্থা আমার সম।
 ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
 বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।
[বুঝিবে সে কিসে / কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার]
বিরহ কী? প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদ, অনুপুস্থিতি, অবহেলায় আপনি যে শূন্যতা বা কাছে থেকেও দূরত্ব অনুভবের যাতনা ভোগ করেন তা-ই বিরহ। যখন আপনি একজনকে (যে কেউ) এত বেশি ভালোবাসেন যে, তার জন্য সব কিছু করেন, সে যখন যা চায় তাই করতে ভালোলাগে। কিন্তু তারপরও ওই মানুষটা বুঝতে পারে না আপনি তাকে কতটা ভালোবাসেন, সে যখন কারণে অকারণে খারাপ ব্যবহার করে তখন খুব কষ্ট হয়। আর এই কষ্ট টা আপনি যখন নিরবে সহ্য করতে থাকবেন তখন সেটা আস্তে আস্তে বিরহে পরিণত হয়। প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক ছাড়াও, এটা যে কোন সম্পর্কে হতে পারে। তবে মানুষেরর এই মানসিক দশা প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহরূপে সাহিত্যে অধিক প্রচলিত। প্রিয় বিরহে মানুষ প্রথমে কষ্ট পায়, কষ্টে কাতর অনুভূতি পরবর্তীতে বিরহে রূপ নেয়। এই বিরহ সহ্য করার শক্তি কোনো কোনো বিরহী মানবকে মহামানব করে তোলে। ভাঙা-গড়ার এই ভবে তারা নবসৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠে। প্রেমের যে মহত্ত্ব, প্রাণশক্তি, তেমনি বিরহেরও রয়েছে নতুন সূর্যালোকে নতুন পৃথিবী গড়ার সঙ্গীত। যুগে যুগে প্রেম-বিরহের প্রাণশক্তি নিয়ে মহাপুরুষেরা বসুধা বিনির্মাণে মহৎ কীর্তি স্থাপন করে গেছেন।


মানবমানবির এই বীরহগাথা সবচেয়ে বেশি জানে স্বীয় মন। কিছু কথা কখনো  ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কখনো গুছিয়ে প্রচারিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে, সাহিত্যের পাতায়। কেউ সুরের মূর্ছনায় বিরহ প্রকাশ করেছে, কেউ ছড়া-কবিতা-গানে লিখে গেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে সাহিত্য রচিত হতো দেবদেবী নির্ভর। আধ্যাত্মিক(জীবাত্মা, পরমাত্মা) এইসব সাহিত্য মানুষের সৃষ্টি। এগুলো সম্পূর্ণ মানবিকতা মুক্ত কী? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আজকের সাহিত্যিকদের মনেও প্রশ্ন জাগে :
  সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি
 কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
 কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
 বিরহতাপিত। হেরি কাহার নয়ান
 রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?(১)
আলো-আঁধারি সান্ধ্যভাষায় চর্যাপদের কবি গুন্ডুরীপা যখন বলেন, ‘জোইনি তঁই বিনু খনহিঁ ন জীবমি’(২)  অথবা বৈষ্ণব পদে রাধিকার মনের কথা জ্ঞানদাস প্রকাশ করেন:
 ‘রূপ লাগি আঁখি ঝরে গুণে মন ভোর।
 প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
 হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
 পরাণ-পিরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।
এই ব্যাকুলতা, প্রিয়জনকে কাছে পাবার কিংবা তার অনুপুস্থিতিতে তার বন্দনা..তার জন্য ক্রন্দসী বিরহিণীর দশা যতটা আধ্যাত্মিক, ততটাই মানবিক।
বিদ্যাপতি রাধার বিরহকে প্রকৃতির সাথে একাকার করে তুলে ধরেছেন। শারীরিক আনন্দের চেয়ে হৃদয়ের বিরহবেদনা তাঁর গভীর অনুভবে মিশেছে । সর্বযুগের বিরহীপ্রাণের দীর্ঘশ্বাস তিনি রাধার কন্ঠে বাণীরূপ দিয়েছেন :
 এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
 এ ভরা ভাদর  মাহ ভাদর
 শূন্য মন্দির মোর।
মধ্যযুগের অন্যতম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বিরহ খন্ডে বিরহ জর্জরিত হয়ে রাধা বলেছে-
এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবঈ আসার।
ছিন্ডিআঁ পেলাইবোঁ গজমুকুতার হার,
মুছিআঁ পেলায়িবোঁ মোয়ে সিসের সিন্দুর
বাহুর বলয়া মো করিবোঁ শংখচুর ।
আধ্যাত্মিকতা বাদে মধ্যযুগের বিরহ দেহজ, আধুনিক যুগের মানুষের বিরহ মানসিক। তবে দেহকেন্দ্রিক ভালোবাসা যেমন ভালোবাসা নয়; তেমনি বিরহও বিরহ নয়। মনের আরাধনাহীন দেহকেন্দ্রিক যে প্রেম, তা কাম। যা দেহকেন্দ্রিক বিরহ, তা কামের বিরহ। দেহ ও মনের ত্রিমাত্রিক মেলবন্ধন প্রেমিকের প্রার্থনা। তাই কামুকের কামনা দেহ, প্রেমিকের প্রার্থনা মন।  আধুনিক যুগে সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠেছে মানুষ ও মানুষের মনোবিশ্লেষন। তাই এ যুগে মানুষ প্রেমে-বিরহে প্রিয়জনের মনের সাথে অথবা আত্মার সাথে মিলিত হতে চায়। এ যুগের যুবক, প্রেমিক, কবিরা ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে গেলে, তার স্মৃতি আগলে রেখে বিরহবিলাস করতে ভালোবাসে। আধুনিক কবিতার প্রাণপুরুষ নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় বিরহের বহিঃপ্রকাশ :
 অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি...
 আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?
প্রস্থান কবিতায় কবি হেলাল হাফিজ যখন বলেন, ‘এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে/ এক মানবী কতটা আর কষ্ট দেবে।’ তখন বিরহের সহ্যশক্তি পাঠককে বিস্মিত করে! এই সময়ের পাঠকনন্দিত কবি হাবীবাহ্ নাসরীন-এর কবিতায় বিরহ প্রসঙ্গ এসেছে:
ভুল করেছি বাঁচতে শিখে, ভুল হয়ে যায় প্রেমে
ভুলের জলে ফুলের নৌকো কখন গেছে থেমে!
বেচতে গিয়ে ভুল লিখেছি চোখের জলের দাম
আমার একটা দুঃখ ছিল জীবন তাহার নাম।
বিরহ একপাক্ষিক তীব্র ভালোবাসা ও অপরপাক্ষিক অবহেলার কোমল অথচ যন্ত্রণাময়  এক শোকের ছায়া।  আরেকটি কবিতায় কবি বলেছেন :
 তুমিহীন এই ব্যথিত জীবন জানে
 আমিহীন তুমি কত বেশি নাবালক
 তবু তুমি দূরে, তবু আমি খুব একা
 হৃদয়ে হৃদয়ে তবু হারানোর শোক
-হাবীবাহ্ নাসরীন
উত্তরাধুনিক অর্থাৎ এখনকার কবিতায় বিরহ অঙ্গীভূত হয় মানবিক বেদনা থেকে উৎসারিত উপলব্ধিতে। বৈষ্ণব মতে বিরহিণীর দশা দশটি। বিরহী ও বিরহিণীর বিরহের এই দশাগুলো আধুনিক ভাবধারায় নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থাপিত হয় কবিতায়। কবিতা পুষ্ট হয় ভাবের সমাহারে। বিরহ মনের ভাবকে উদ্বেলিত করে। রচিত হয় কবিতা, গান। শিল্প-সাহিত্যের অপরাপর শাখাতেও এই ভাবধারা পরিপুষ্টতা দান করে। বিরহ মানবজীবনের চূড়ান্ত ভাব নয়। তবু এই খ- ভাব মানুষের জীবনের একটি মুহূর্তকে নিজের আয়ত্তে রাখতে সক্ষম । কেউ কেউ বিরহকে স্বীকার করতে অপ্রস্তুত। মানুষ স্বর্গীয় অপ্সরা, ফেরেশতা নয়। তাই সুখ-দুঃখ, ভালবাসা-বিরহের উপস্থিতি স্বাভাবিক জীবনের ইঙ্গিত বহন করে। প্রেম মধুর। সেই সৌভাগ্য একবার বিরহে পরিণত হলে আশাহত হওয়াটা অন্যায় নয়।  বিরহের শোক মৃত্যু নয়, নবজীবনের আলোকবর্তিকা বয়ে আনতে পারে বিরহ । অতীতের পথ ধরে হেঁটে চলা পথিক নবোদ্যমে চলতে পারে নতুন স্বপ্নের পথে। মহাপুরুষ, সাধক, জ্ঞানী ও ধ্যানী ব্যাক্তিবর্গ প্রেম ও বিরহের যুগলস্পর্শেই ত্যাগের মহিমায় অধিষ্ঠিত। বিরহী পথিক সে পথের অনুসারী।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট