ঘুণপোকা



ঘুণপোকা
সুদীপ ঘোষাল

রতনের স্ত্রী সাত  সকালে জানিয়ে দিলো জানালায় ঘুণ ধরেছে। প্রায় চারমাস  বর্ষাকালে পশ্চিম ধারের জানালাটা খোলা হয় নি। ঘুণ এমনভাবে ধরেছে, জানলার একটা পাটা খুলে নিচে পড়ে গেছে।
রতন বললো, তোমাকে রোজ একবার করে খুলে যতœ করতে হতো। আমি তো বাইরে কাজে থাকি।
বউ বললো, কি করবো। আমি দেখিনি। নিচের জানালাটা বন্ধই থাকে।
যাই হোক ঘুণ তো কেউ  ইচ্ছে করে ধরায় নি। কালে কালে সব কিছু সময়ের ঘুণে খেয়ে নেয়।
রতন ভাবলো, জানালাটা পুরোটা বন্ধ করে দেবে ইঁট গেঁথে। রাজমিস্ত্রি ডেকে আনতে হবে। কিন্তু তার আগে সুরক্ষার জন্যে দুটো পাটা পেরেক ঠুকে লাগানো প্রয়োজন। সব কিছু ঠিকঠাক হলে রতন নিজের কাজ নিয়ে বসলো। ভাবলো দাঁতে ব্যথা করছে। এক কাপ চা খাই। ঠান্ডার সময় ভালো লাগবে।
বেশ জমিয়ে চা পানে মগ্ন ছিলো রতন। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। খারাপ খবর এলো। তার মা অসুখে পড়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। আজ এখনি বড়দা খবর দিলেন, মা মারা গেছেন। বুকটা ধক ধক করে উঠলো জোরে। রতন কাঁদতে কাঁদতে বললো, শুনছো গো, আমি মাতৃহারা হলাম।
রতনের স্ত্রী বললো,এই সময় জোর ধরো। আমারও তো মা মরে গেলেন এই বছরে। বয়স হলে সবার অন্তিম পরিণতি এই মরণ। এখানে মানুষের কোনো হাত -নেই গো। যাও শ্মশানে যাও। আমি ও একবার দেখে আসি চলো।
দাদা আসছে মায়ের মরদেহ নিয়ে। শ্মশানের কাছাকাছি  এসে গেছে। চলো আমরাও যাই।
-চলো, তাই চলো।
টোটোতে চেপে রতন ভাবছে, এখনি ঘুণ ধরা নিয়ে তোমাকে বকাবকি করলাম। অথচ মানুষের জীবনেও তো তলায় তলায় ঘুণ ধরে যায়। এই নিয়ম।
শ্মশানের কাছে এসে রতন হু হু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো...    
মায়ের মরদেহ  দাহ করে গঙ্গায় স্নান করলো সবাই। তারপর খাওয়ার পালা। যে যা পারলো খেলো।
রতন বলে উঠলো, এই একটা নিয়ম আমার ভালো লাগে না। নির্লজ্জ ভুরিভোজ।
বড়দা বললো, পাগলা, চুপ করে যা। এখন ওসব বলতে নেই। দেখবি শ্রাদ্ধের সময় রাগে সব একজোট হয়ে যাবে। নিমন্ত্রণ বর্জন করবে কিছু লোক। তখন খারাপ লাগবে আমাদের।
রতন চুপ করে গেলো। এবার কাছা পড়ে বাড়ি ঢোকা। দশ দিন পালন করতে হবে শোক। বাইরের লোক দেখানো শোক। চটি পরা যাবে না। হবিষ্যি রান্না করে খেতে হবে। মেঝেতে শুতে হবে। বাইরে একা যাওয়া যাবে না। তারপর বামুনের প্রসাদ পেয়ে শোকভঙ্গ। মানুষের মনের শোক অবধি নাগাল সমাজের সেনাপতিরা পায় না। হয়ত সব কিছু পালন করলো আর মনে মনে কষ্ট পেলো, হয়ত গালাগালি দিলো মনে মনে।
রতন ভাবছে এইসব। সে ভাবছে নিয়ম তো একদিনে উঠবে না। একটা মৃত মানুষের শোক পালন করতে গিয়ে জ্যান্ত বড়দা অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার এসে বললো, এনার এখন স্নান করা যাবে না। মাংসের ঝোল খেতে হবে। তিনি চলে গেলেন। কিন্তু তার কথা মানা হলো না। বড়দা আরও অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভরতি করা হলো।
বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথা একদিনে বন্ধ হয় নি। তারজন্য বিদ্যাসাগরের মত লোক, রামমোহনের মত মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। রতন ভাবে, এইসব করার লোক এখন কম। নিজের নিয়েই ব্যস্ত আমরা। কিন্তু ঘুণ ধরছে অন্তরে    মানুষের সম্পর্কে। সমাজের কোণে কোণে।
বড়দা বললেন, ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি সুস্থ হয়ে যাবো শ্রাদ্ধের আগেই।
রতন আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বড়দা আর বাড়ি ফিরতে পারলেন না। আবার দশদিন পরে বড়দারও শ্রাদ্ধ হয়ে গেলো। তার একটি মেয়ে আছে। বিয়ে এখনও হয় নি। রতনের মাথায় বাজ পড়লো। কি হবে এবার। কি করে মেয়েটার বিয়ে হবে।  
বড়দার মেয়ে ঝুমা কথা কম বলে। শান্তশিষ্ট। খুব ভালো মেয়ে। এবারে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে। বিয়ের জন্যে যোগাযোগ শুরু করেছে রতন। দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে যাবে। এক বছর কাল অশৌচ। তার আগে বিয়ে দেওয়া যাবে না।
যেখানে যায় রতন সব ছেলের বাবা পণ চায় মোটা টাকা। বলে মেয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে তো কি হয়েছে। চাকরি তো করে না। করতে হবে রান্না। এক একটা পরিবার দশজন বারোজন করে আসে আর মিষ্টিমুখ করে চলে যায়। পছন্দ হয়। কিন্তু টাকায় হয় না। রঙ মেখে বসতে হয় ঝুমাকে ওদের সামনে।
একদিন ঝুমা রতনকে বললো, আমি এখন বিয়ে করবো না।
রতন বলে, কি করবি তাহলে?
আমি ছাত্র পড়াবো আর চাকরীর পরীক্ষা দেবো।
বেশ দু’বছর তাই চেষ্টা করবে। তারপর না হয় যোগাযোগ করা যাবে বিয়ের।
ঝুমা পড়ায় পাড়ায় পাড়ায় আর ইন্টারভিউ দেয় রেল, পি এস সি তে।
রতন ভাবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে বৌদির খেয়ে পড়ে চলে যাবে। দু’চার বিঘে চাষের জমি আছে। বছরে খোরাকির ধানটা পাবে। 
রতনের সংসারে ঝামেলা নেই। ওরা স্বামী স্ত্রী। ছেলে পিলে হয় নি। হবে না। ডাক্তার বলে দিয়েছেন। একদম নিশ্চিত হয়ে ওরা হাল ছেড়ে দিয়েছে।     
এখন রতনের একটাই চিন্তা কি করে ঝুমার বিয়েটা দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি। রতন ভালো রোজগারও করে না। নগদ টাকা চায় সবাই। তার সঙ্গে সোনাদানা।  তারপর খাট, আলমারি, বিছানা। তিরিশটা নমস্কারি, দেড়শো বরযাত্রী। একটা মোটর বাইক। ছেলের আংটি, গলার চেন। সব মিলিয়ে টাকার পরিমাণ যা দাঁড়াবে তার সুদে একটা জীবন খেয়ে পরে চলে যাবে। মাসে মাসে যে টাকা পাবে চলে যাবে খেয়ে কোনোরকমে। রতন ভাবে তাহলে তো সংসার পাবে না। আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে। সাত পাঁচ ভেবে রতনের মেজাজটা বিগড়ে গেলো। এক কাপ চা খেলো। তারপর বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়লো।
ঝুমা অনেক চেষ্টা করে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরির, ভাইভা টেস্টে, গেলো। ওর মা বললেন, দেখ যদি চাকরিটা হয়। তাহলে আমরা দু’জনেই বেঁচে যাই।
ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনজন বসে আছেন। ঝুমার ডাক পরলো। ঝুমা ঢুকে চেয়ারে বসলো। একজন বললেন, আপনার সার্টিফিকেটগুলো সব দেখান। আর একজন বললেন, আপনার নিজের সম্বন্ধে কিছু বলুন। আর একজন বললো, আপনার ব্রাইট রেজাল্ট। কিন্তু শুধু ওতে কাজ হবে না।
ঝুমা বললো, আর কি করতে হবে বলুন।

একজন বললো, আমাদের কোয়ার্টারে একবার আসবেন। আগামীকাল সকাল সাতটার সময়। আমরা তিনজনেই থাকবো। সব তো দেখে নিলাম। আগামীকাল মিটিংয়ের পর আপনার চাকরি পাকা। কাল আসুন। একটু গল্প, একটু বিয়ার ।
ঝুমা ভয়ে পালিয়ে এসেছিলো। মানুষ যে এত অভদ্রতা করতে পারে ও জানতো না।
তারপর ঝুমা আরও অন্য চাকরির খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলো একটা ভালো খোঁজ। লোকটি বললো, আমরা আপনাদের মত বেকারদের জন্য বসে আছি। চাকরি হলে কিছু টাকা দেবেন। ওটা আপনার মর্জি। কাল আসুন দশটার সময়। আপনার চাকরি হবেই এমন কথা বলবো না। তবে চেষ্টা করবো। অনেকের চাকরি করে দিয়েছি। বাইরে বেরিয়ে দুটো ছেলেকে দেখতে পেলো ঝুমা। সে ছেলে দু’জনকে বললো, আপনারা কি এই অফিসে এসেছেন। ছেলে দু’টো বললো। আমাদের চারজন বন্ধুকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে অই লোকটা। আমাদেরও আগামীকাল আসতে বললো। এবার চাকরি আমাদের হবে। ছেলে দু’টোকে দেখে ঝুমার সাহস বাড়লো। এতক্ষণ বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এবার নিশ্চিনত হলো। কিন্তু মুখে কিছু না বলে এগিয়ে গেলো।                     
লোকটাকে দেখে ভালো লাগলো। হয়ত চাকরিটা হয়ে যাবে। তার মা বললেন, দেখো। কিন্তু সাবধান। সমাজে এখন ঘুণপোকা ধরেছে। তোমাকে সাবধানে থাকতে হবে।
সকাল আটটার মধ্যে সেজেগুজে ঝুমা বেরিয়ে গেলো। লোকটা অফিসে বসে আছে। আরও দুজন চাকরিপ্রার্থী বসে আছে। দেওয়ালে নেতাজীর  ছবি। ঝুমার মনে সাহস এলো। দেওয়ালে ও কল্পনায় দেখতে পেলো ভারতবর্ষের মানচিত্র। সুন্দর, সবুজ দেশ। 
কত সুন্দর আমাদের দেশ। কত সুসন্তানরা আমাদের দেশে জন্মেছেন। তাদের ত্যাগে আমরা স্বাধীন হয়েছি। ভাবতে ভাবতে ঝুমা স্বপ্নের সাগরে ডুব দিলো। সেখানে কত মণি রতœ। একটা রতœকণা সে খুঁজে পাবেই।
এবার ডাক পরলো কমলেশ সেন...
তারপর বিমল পাল....
ওরা চলে গেলো।
এবার ডাকলো ঝুমা।
ঝুমা একটু বোতলের জল খেয়ে ঢুকলো।
দেখলো একজন মহিলা বসে আছে চেয়ারে। সামনে টেবিল। বাঁদিকে বড় হল ঘর। পর পর খাট পাতা।
এ আবার কেমন অফিস?
মনকে জিজ্ঞেস করলো। আবার ভাবলো, দেখাই যাক।   
এবার মহিলাটি কর্কশ কন্ঠে  বললো, চাকরি করে কত টাকা পাবি।
চলে আয় আমাদের ডেরায়। পয়সা নিতে পারবি না।
ঝুমা ভাবছে, ও ভুল জায়গায় এসে পরেছে। ওর চারপাশে চারটে ছেলে ঘিরে ধরেছে। আর কিছু করার নেই। চিৎকার করতে পারলো না। গলা শুকিয়ে কাঠ।
মহিলা  বলছে, তোর প্রথম খেপেই এখনি দশ হাজার পাবি। কোনো মাসে বিশও হয়ে যাবে। যা ভিতরে যা। বসে আছে সিল খোলার নাঙ। ঝুমার কান, গাল লাল হয়ে গেলো খিস্তি শুনে।এবার মহিলা আয়েশ করে সিগারেট ধরালো।    
চারজন জোর করে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলো। ভিতরে সুন্দর বিছানায় একটা ভুঁড়িওয়ালা লোক বসে পান খাচ্ছে। আর হাসছে নির্লজ্জের মতো।
ঝুমার মনে ভেসে উঠলো, বাবা, মা, কাকা, কাকিমার মুখ। তাদের সাবধান বাণী মনে পড়লো। মনে হচ্ছে তারা চিৎকার করে বলছে, সাবধান ঝুমা। সমাজের অঙ্গে  এখন বেশির ভাগ পোকা ধরেছে। ঘুণপোকা, ঘুণপোকা....
নন্দনপাড়া, খাজুরডিহি, পূর্ব বর্ধমান ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট