ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১২


(গত সংখ্যার পর)
বেবী আপা বলতে থাকেন, স্বৈরাচারবিরোধী আজকের এই সমাবেশ। সভাপতি এবং প্রধান অতিথি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আজকে জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে, তা আপনারা জানেন। জাতির মাথার ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা, সামরিক জান্তা এরশাদকে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাড়িয়ে জননী-জন্মভূমিকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা রাজপথে বেরিয়ে এসেছি, তার পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না। স্বাধীনতাযুদ্ধের সন্তান হিসেবে আমরা কি বসুনিয়াদের রক্তকে ভুলে যাব?  যেতে পারি?
চারদিক থেকে চিৎকার ওঠে, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’
ঠিক এ সময় মেডিকেল গেট থেকে টিয়ারশেল ফাটার শব্দ হলো। চারদিকে সেøাগান চলছে। বেবী আপা বক্তৃতা থামানোর পর চারদিক থেকে হায়েনার মতো এরশাদের পেটুয়া আর পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল। টিয়ার শেল, আর কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় চর্তুদিক আচ্ছন্ন। সমাবেশ থেকে দৌড়ে পালাচ্ছে জনতা। উর্মিলা লক্ষ করল বেবী আপা পড়ে যাচ্ছে। নাক মুখে গ্যাসের ক্রিয়ায় জ্বালা করছে উর্মিলার। এ সময় মঞ্চের ওপর দুটো টিয়ার শেল এসে পড়ে। বেবী আপা ছিটকে পড়ে যান। দৌড়ে গিয়ে বেবী আপাকে জড়িয়ে ধরে উর্মিলা। শাহরিয়ার কবির শহীদ জননীকে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। লাঠিচার্জে  আহতরা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হতভম্ব উর্মিলা বেবী আপাকে নিয়ে উড়নিতে চোখ ঢেকে বসে থাকে। ঠিক এ সময় একটি টিয়ার শেল এসে পরে উর্মিলার দু’হাত দূরে। শুধু অনুভব করে চোখের পাশ দিয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা বইয়ে যাচ্ছে। তারপর আর কিছুই মনে নেই উর্মিলার।

১৩.

যখন জ্ঞান ফিরল তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। স্যালাইন চলছে। বেডের চারপাশে ডাক্তার-নার্স তাকে পরীক্ষা করছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। নিজকে ভয়ানক দুর্বল মনে হচ্ছে। সারা শরীর ব্যথা। পরিচিত কোনও মুখ দেখতে পাচ্ছে না।
একজন ডাক্তার বলে উঠল, ‘ওকে গুড। ভয় পেয়েছিলাম। মাথার ইনজুরি বেশ ডিপ। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। থ্যাঙ্কস গড। সিস্টার পেশেন্টকে একটা প্যাথেড্রিন দিয়ে দিন। রাতের মতো ঘুমাক।’
ডাক্তার সরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে রুবী ছুটে এল। উর্মিলাকে অনেকটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘উর্মি আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া তোর কিছু হলে আমার কী হতো! বেবী আপা আহত। শহীদ জননীসহ প্রায় বিশজন আহত। তোদের কারণে সারাদেশ তোলপাড়। বাইরে এতক্ষণ সেøাগান হচ্ছিল। শহীদ জননী, বেবী আপাসহ তোদের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
ঝড়ের বেগে কথা বলছে রুবী। সিস্টার এসে বলল, ‘রুগিকে সাউন্ডলেস থাকতে হবে।’
‘আমি তো ওর পাশে থাকব। ও আমার বোন।’
‘থাকবেন। তবে কথা বলা যাবে না। সদ্য জ্ঞান ফিরেছে।’
‘না না আমি কথা বলব না।’
‘পেশেন্টকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে যাবেন।’
রুবী উর্মিলার একটা হাত ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আর ইনজেকশনের ক্রিয়ায় উর্মিলার চোখ নেতিয়ে আসে। হাসপাতাল জুড়ে দাপাদাপি। রাজনৈতিক কর্মী থেকে আরম্ভ করে আম জনতা জানতে চায় আহতদের সর্বশেষ অবস্থা। সাংবাদিক-পুলিশসহ আহতদের আত্মীয়স্বজনে হাসপাতাল সয়লাব। ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের ফটোগ্রাফাররা আহতদের ছবি তুলে নিয়ে গেছে। কেউ বুঝতেও পারেনি কেন শান্তিপূর্ণ এই জনসভায় ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ।
রাত দশটার দিকে এক প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়ে দীপু ভাই এল।
উর্মিলা জ্ঞান ফিরেছে জেনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দীপু ভাইয়ের মুখ।
রুবীকে বলে, ‘খাবার খেয়ে নাও। কেবিনে শহীদ জননী আর আর রুবী আপা ঘুমাচ্ছে। তাদের অবস্থা অনেকটা ভালো। তবে বেবী আপার হার্ট অ্যাবনরমাল। তোমাকে তো আজ দেবীর সঙ্গে থাকতে হবে।’ বারান্দায় হেঁটে আসে রুবী আর দীপু ভাই।
রুবী বলে, দীপু ভাই, উর্মির জন্য আমার বুকে এত মমতা জমেছে তা আমি আগে বুঝতে পারিনি।’ রুবী কাঁদতে থাকে।
দীপু ভাই বিষণœ কণ্ঠে বলে, ‘রুবী, জন্মভূমির জন্য দেবী রক্ত দিয়েছে। সেকি সাধারণ! তুমি বিশ্বাস করো, এ জীবনে এত শূন্যতা আমাকে কখনও গ্রাস করেনি।’
দীপু ভাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। রুবীর মনে হয় দীপু ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে।
‘রুবী আজ রাতটা জেগে থেকো। সকালে শিমু, মিতালীরা আসলে ঘুমুতে যেও।’
‘ওকে এ অবস্থায় রেখে আমার ঘুম আসবে আপনি ভাবলেন কী করে।’
‘না না আমি তা বলিনি! রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। কখন আবার কী হয়।’
‘বালাই ষাট।’ রুবী বলে।
রুবীকে বারান্দায় রেখে দীপু ভাই উর্মিলার বেডের কাছে চলে আসে। হাত দিয়ে ওর কপাল স্পর্শ করে। শরীর ঠা-া। ইনজেকশনের ক্রিয়ায় উর্মিলা ঘুমের অতলে। একটু কাঁপল না। একজন নারী হাসপাতালের বেডে লম্বালম্বি শুয়ে আছে। দীপু ভাইয়ের একবার মনে হলো, উর্মিলার জন্যই এ মানবজন্ম। সত্যি, বেবী আপা সত্যকে ধরতে পারে।
দীপু ভাই বারান্দা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। রুবীর একবার মনে হলো দীপু ভাইকে বলে, ‘দীপু ভাই আমি কি খুকি? রূপকথার বই দিয়েছেন কেন?’ বলা হয় না। খিলানের আড়ালে এক সময় অদৃশ্য হয়ে যান দীপু ভাই।
রুবী বারান্দার আধো আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনুভব করে ও কাঁদছে। ওর কী যেন নেই।

উর্মিলার যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল সাড়ে আটটা বেজে গেছে। রুবী বাসায় চলে গেছে! প্রফেসর রাউন্ডে এসেছে। অন্যান্য আহত রোগীদের দেখে যখন উর্মিলার কাছে এল তখন নয়টা বাজে!
প্রফেসর বলল, পেশেন্ট তো সুস্থ হয়ে গেছে। রাতে অবস্থা খারাপ ছিল। ভয় পেয়েছিলাম। এখন তো দিব্যি পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারের দিকে যেতে পারবে।’
উর্মিলা কথা বলে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘অবশ্য দু’একদিনের মধ্যে ছেড়ে দেব। স্পিøন্টারের ক্ষত, ড্রেসিং থাকতে হবে। ডিস্টার্ব করতে দেয়া যাবে না। পত্রিকাওয়ালাদেরও না।’
চিকিৎসাপত্রে নতুন অর্ডার লিখে প্রফেসর বেরিয়ে যেতেই বারান্দা থেকে দৌড়ে এল মিতালী সিকদার, শিমু দিদি আর নাজনীন আপা। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা উর্মিলা চিৎপাত হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে জটলার শেষ নেই।
‘মিতালী সিকদার বলল, উর্মি, ইউ আর গ্রেট।’
শিমু দিদি বলল, ‘নেশন ডোয়াটার!’
নাজনীন আপা বলে, ‘কিরে, তোর আর সাক্ষাৎকার নিতে হবে না, কতজন তোরটাই নেবে! আমি তোকে হিংসে করছি উর্মি।’
উর্মিলার ঠোঁটের কিনারে একটু ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে।
‘বেবী আপা টেলিভিশনে উর্মির কথা বলছে। কীভাবে উর্মি তাকে শরীর দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও দ্বিধা ছিল না!
মিতালী সিকদার গর্ব ভরে বলে।
‘শহীদ জননী বলেছেন, যেখানে পীড়ন, সেখানেই রক্ত ঢেলে দেব। রক্তে কেনা বাংলাদেশে স্বৈরাচারের স্থান হতে পারে না।’ শিমু দিদি কলকল করে বলে চলেন।
নাজনীন আপা বললেন, ‘উর্মি আমাদের সহযোদ্ধা। লড়াকু। আমরা ওকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব।’
‘পেশেন্টকে এভাবে ডিস্টার্ব করা কি ঠিক?’ সিস্টার অনুযোগ করে।
‘ঠিক না কী করব আপনজনের কষ্ট ভাগ করে নেব।’ মিতালী সিকদার উর্মিলার  হাতে হাত রাখে।
উর্মিলা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘দিদি, আমার কোনো কষ্ট নেই। বাবা কি জানে?’
‘ওসব নিয়ে ভেব না। আগে সুস্থ হয়ে ওঠো।’
‘বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘নিশ্চয়ই দেখবে। সে ব্যবস্থাই করব।’ নাজনীন আপা বললেন।
‘তোমার মদনতো স্তম্বিত। মদন ঠাকুর জাকির বাবাজী।’ উর্মিলা লজ্জা পায়।
এ সময় উর্মিলাকে দেখতে আসেন তেজগাঁও মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল ডলি আপা।
সরাসরি উর্মিলার বেডের কাছে এসে বলেন, ‘ও তুমি আমার ছাত্রী। তোমার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় হওয়ার আগেই তোমার এমন বিপর্যয় নেমে এসেছে। বেবী পত্রিকায় তোমার কথা না বললে তো জানতেই পারতাম না। তোমার শরীর এখন ভালো তো?’
উর্মিলা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘জি ভালো।’
 ‘তোমার জন্য আমার কলেজের ছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছে। বেবী আহত। শহীদ জননী আহত। ভাবা যায়!’ প্রিন্সিপাল ডলি আপা উষ্মা প্রকাশ করেন।
‘তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি তোমার জন্য বিবৃতি দেব। প্রেস কনফারেন্স করব। আমরা কি আইয়ামে জাহিলাতে বসবাস করছি!’ ডলি আপা উর্মিলার হাত ধরে আদর করে। ওর চোখে জল গড়াতে থাকে।
‘আপনারা পেশেন্টকে রেস্টে থাকতে দিন?’ সিসটার বলে।
ডলি আপা তার লোকজন নিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন।
মিতালী সিকদার, নাজনীন আপা, শিমু দিদি বেবী আপাকে দেখার জন্য কেবিনের দিকে ছুটে যায়।
তারও দশ মিনিট পর দীপু ভাই আসেন। হাতে রাজ্যের সংবাদপত্র। হরলিকসসহ নানান পানীয়।
উর্মিলা তখন তন্দ্রায় চলে গেছে। দীপু ভাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উর্মিলার একটি হাত ধরলে, ওর তন্দ্রা কেটে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই উর্মিলা ভাই দেখে, কী গভীর একাগ্রতা নিয়ে দীপু ভাই চেয়ে আছে। উর্মিলা তন্দ্রা-আক্রান্ত চোখে ধূসরতার ছাপ থাকলেও হাতটি সরিয়ে নেয় না। বরঞ্চ আগ বাড়িয়ে ধরতে চায়। দীপু ভাই বাকরুদ্ধ। উর্মিলার চোখে জলের রেখা।
‘দেবী দুর্গা কাঁদলে মানুষের অকল্যাণ হয়। আমি তো নেশন কন্যার হাত ধরেছি।’
এ সময় উর্মিলার আঁখি পল্লব ভিজে দু’ঁেফাটা জল গড়ায়। দীপু ভাই হাত দিয়ে ওর চোখের জল স্পর্শ করে। দীপু ভাইয়ের মনে হয় মমতা শূন্য এ নারীর জন্য এত আবেগ জন্মেছে যে, তা সামলানোই কঠিন।
পত্রিকাগুলো একেবারে উর্মিলার সামনে মেলে ধরে। প্রতিটি কাগজের হেডলাইন শহীদ জননী, বেবী আপা, শাহরিয়ার কবিরসহ আহতদের ছবি। অধিকাংশ পত্রিকা ছেপেছে বেবী আপাকে জড়িয়ে ধরা উর্মিলার ছবি।
‘দেবী তো দেশজোড়া এক লড়াকু নারীর নাম এখন। যার পূর্বপুরুষ সাপের ওঝা ছিলেন। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছে। এখন স্বৈরাচারের বিষদাঁত খুলে ফেলার জন্য রাজপথে নেমেছে। আমি কি দূরে থাকব?’
‘দূরে থাকবেন কেন? হাত তো ধরেই আছেন।’ উর্মিলার ঠোঁটে হাসির রেখা ফোটে। দীপু ভাই হাত সরিয়ে নেবার জন্য চেষ্টা করে।
উর্মিলা বলে, ‘এ হাত সরিয়ে নেবেন না। সাহায্য করুন।’
দীপু ভাই উর্মিলার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিষলক্ষ্যার ছুরির মতো বিদ্ধ হতে থাকে অচিন এক দৃষ্টিবান। সে ভাষা উর্মিলা বোঝে না, দীপু ভাই বোঝেনি।

[চলবে]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট