একজন আদর্শ শিক্ষক



সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম
একজন আদর্শ শিক্ষক

শাহরিয়ার কাসেম


    সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম পেশায় একজন গণিত শিক্ষক ছিলেন। তিনি কর্মজিবন শুরু করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক পন্ডিতরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। এবং তিনি ফান্দাউক পন্ডিত রাম উচ্চ বিদ্যালয়ই শিক্ষাদান জিবন শেষ করেন। তাঁর এই দীর্ঘ পাঠদানের সময় কত ছাত্র- ছাত্রীদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এর একটুও অন্ত নেই। বলতে গেলে এখন বিভিন্ন স্থানে ফান্দাউক পন্ডিতরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম মুখে উঠলেই সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুমের নাম সবার আগে উঠে। এবং প্রত্যেকেই তাঁর গুণ কীর্তনে থাকে পঞ্চমুখ। এরকম সু-পাত্র হতে হয়ত তাঁর কঠিন ত্যাগ, সাধনা করতে হয়েছে অনেক দিন। না হলে এখনো সেই ছাত্র- ছাত্রীরা তাঁর নাম ঝঁপে কেন? সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম শুধু একজন পাঠদান করা শিক্ষকই নন; তিনি সু-মানুষ গড়ার কারিগরও ছিলেন। যার জ্বলন্ত প্রমাণ আশপাশের গ্রামের খ্যাতিমান ছাত্ররা।

     সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম তিনি শুধু একজন আদর্শ শিক্ষক নন, বরং তিনি অসংখ্য মানুষের অনুপ্রেরণার উৎসও ছিলেন। দিক হারা কত ছাত্রের দিশা তিনি হয়েছেন তাঁর প্রমাণ অহরহ।

     তাঁর অনুপস্থিতিতে তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শুরুতেই মনে হয় আমার ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের ইতি ঘটলো। কারণ তিনি শুধু সৃষ্টিতেই বিশ্বাসী ছিলেন। এবং সৃষ্টি করেছেনও। গড়েছেনও আপন যতেœ, আপন মহিমায়।

     তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি। আমি সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম সাহেবকে শিক্ষক হিসেবে দেখিনি। বলতে গেলে সে জনম আমি পাইনি। তবে জীবনের দিক নির্দেশনায় আমি তাকে পেয়েছিলাম বহুদিন।

     তিনি শিক্ষকতার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির শেষেও শিক্ষা দিয়েছেন। তবে সেটা পাঠ্যসূচীর শিক্ষা নয়। সেটা মানুষকে সৎ পথে চলতে, অসৎ পথে নিষেধের শিক্ষা। এমন কি তিনি এ শিক্ষাদানের মধ্য দিয়েই ইহলোক গমন করেন।

     তবে আমি যখন সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম সাহেবকে পেয়েছি তখনের কথা বলতে গেলে দু’চোঁখে ভেসে উঠি সেই আমার ছেলেবেলার কথা। আমি যখন তাকে প্রথম দেখেছি, তখন তিনি একজন প্রবীণ, আমার কাছে মনে হয়েছিল গল্প-পুরানে শোনা কোন মহা পুরুষ। ধবধবে সাদা কলার বিহীন পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা, সবুজ পাগড়ী, হাতে লাঠি। আমার তখন থেকেই তাঁর প্রতি মুগ্ধতার শুরু তা আজও বিদ্যামান। সমস্ত চেতনায় এবং সেই তিনি হয়ে উঠতে থাকলেন আমার কাছে ধ্রুব এবং জ্যোতিষ্মান একজন মানুষ। যিনি নির্ভরতার ভুবন তৈরী করে দিলেন আমার মনে।

     সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম সাহেব তিনি আমাকে আলাদা করে চিনতেন কি না জানিনা। কিন্তু আমি আমার মনের মন্দিরে শুধু তাকেই বসিয়ে ছিলাম। সে মন্দিরে তিনিই ছিলেন শুধু। তবে দূর থেকে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় আট বছর। এই দীর্ঘ আট বছর আমি শুধু তার দিকে চেয়েই রয়েছি। আর বার বার মুগ্ধ হয়েছি। এত বারই মুগ্ধ হয়েছি চোঁখ বুজলেই সেই মুগ্ধতার পরশ এখনো পাই।

     সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম তিনি একজন শিক্ষক হয়েও কতটা আধুনিক হতে পারেন তাঁর উদাহরণ তিনি নিজেই। তিনি তো সময়কে ধারণ করতে পারতেন, বরণ করতে পারতেন অনায়াসে। এবং সময়ের মাঝে হারিয়ে না গিয়ে সময়কে নতুন করে নির্মাণ করতে পারতেন। তাকে দেখলে আমার মনে হয়েছে বারংবার,  জ্ঞান এবং মৃত্তিকালগ্নতার অপূর্ব সমন্বয় তাকে মানুষের কাছ থেকে দূরবর্তী করেনি। তাই তো তিনি ছাত্র- ছাত্রীদের কাছে প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় হয়ে আছেন, এবং থাকবেনও। একবার তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারলে তিনি এক মুগ্ধতার জগৎ নির্মাণ করতেন শ্রোতার চেতনায়। আমি দীর্ঘ আট বছর তাঁর শ্রোতা ছিলাম, কম তো নয়। প্রায় আট বছর তাঁর হাতের নাগাল থাকা সে আমার পরম সৌভাগ্যের ব্যাপারই।

     সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম তিনি এক অননুকরণীয় শৈলী নির্মাণ করেছিলেন তাঁর চলায়, তাঁর বলায়, তাঁর লেখায়, তাঁর পাঠদানে। শিক্ষকতাকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন।  না হলে এমন শিক্ষক মিলানো সত্যিই ভার।

     আমি যখন তাঁর ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হতাম তখন আমি ভেবে কূল পেতামনা। কারণ, এত সুন্দর করে একজন মানুষ কী করে কথা বলেন! তিনি যখন সঠিক পথে চলতে, বলতে শেখাতেন তখন খানিক সময়ের জন্য হলেও সুবোধ হতাম।

     একজন প্রকৃত দিক নির্দেশক তাই করেন, সোঁজা পথে চলতে শেখান, সত্য কথা বলতে শেখান এবং জানবার বাসনাকে উসকে দেন আর প্রত্যয় জাগিয়ে তোলেন শ্রোতার মনে। তিনি তাই করেছে মৃত্যু অবদি।

     একজন মানুষ কত স্বচ্ছ হলে এই কর্দমাযুক্ত পরিবেশে নিজেকে রেখেন আলাদা ভাবে? নিখুঁত তাঁর সব কিছুই। নিখুঁত ছিল প্রত্যহ জীবন। এতটাই নিখুঁত যে, তিনি পান খেলেও পানের পিচ ফেলতেন একটি নির্দিষ্ট বাক্স। মানুষ সাধারণত পান খেলে অন্তত সাদা জামায় পানের আঁচ একটুও হলে ফেলে অথচ তিনি কতই সতর্ক ছিলেন।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট