মহাজন



মহাজন
প্রকৌ. আমিনুল ইসলাম

বাবুল সাহেব অনেক পরিশ্রম করে আজ একটি কোম্পানির মালিক হয়েছেন।
তিনি জরুরী কাজে যাবেন তার ফ্যাক্টরিতে।  অফিসের জরুরী কাজটি শেষ করে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবেন।
তার ব্যক্তিগত গাড়িটি হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলো। গাড়ির ড্রাইভার বলেছে, গাড়ি দুপুরের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের দাওয়াতে গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে।
বাবুল সাহেব অফিসের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়াই বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। তিনি হাঁটছেন আর ভাবছেন কিভাবে অফিসে যাওয়া যায়। এই রাস্তাটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রোড। বড় বড় ট্রাক চলে এই রাস্তায়। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তা ঠিক করার কিছুদিনের মধ্যেই আবার খারাপ হয়ে যায়। তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটি চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালেন। দোকানদার বলে উঠলেন,
‘ভাই চা খাবেন?
‘দিন।
‘ভাইজান আপনাকে কখনো এদিকে দেখি নাই । কই যাবেন এই দিকে?’
‘বাবুল কসমেটিকস গেইটে যাবো’
‘সে তো অনেক দূর । রিক্সা, টেক্সি, বাস কোন কিছুই এই রাস্তায় চলেনা। এক কাজ করেন, ড্রাইভারের পাশে বসে যে কোন একটি ট্রাকে করে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার এক পরিচিত ট্রাক ড্রাইভার আসবে । আপনি চাইলে তার সাথে আপনাকে উঠিয়ে দিতে পারি । এখন চা খেতে থাকুন । আমি আপনাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
‘আমাকেতো এখনো চা দেন নাই।’
‘ও দেই নাই? কথা বলতে বলতে ভুলে গেছি । আমি আবার ভুলো মন স্বভাবের মানুষ। আমার নাম মফিজ। কয়েক দিন আগে আমার পরিচিত একজন  দোকানের সামনে এসে আমাকে ডাকছিল, মফিজ ভাই, মফিজ ভাই। আমি উত্তর দিলাম, মফিজ ভাই নাই। আমি ভুলেই গেছিলাম আমার নাম মফিজ। হা হা হা।
‘আপনি আসলে ভুলো মন স্বভাবের না । আপনার আই কিউ একটু কম।
‘আই কিউটা কি ভাই? এইটার নামতো কোন দিন শুনি নাই’
‘আপনি যে আমাকে চা না দিয়ে বকবক করে যাচ্ছেন । এটাকেই আইকিউ কম বলে।
‘দেখছেন ভাই আমি কতটা ভুলো মনের?
‘আপনার ব্রেইনে একটিভ নিউরন কম।
‘এইসব কি বলেন কিছু বুঝিনা। নেন চা খান।
‘আপনার চা লবণাক্ত কেন’
‘খাইতে খারাপ লাগছে ভাই? সবাইতো খায়।’
‘আপনি কি চায়ে লবন দিছেন?’
‘জ্বি ভাই।
‘আমাকে লবণ ছাড়া চা খাওয়াতে পারবে?’
‘না ভাই। লবণ চিনি একসাথে লিকারের সাথে দিয়ে দিছি।
‘লবণ কিন্তু শরীরের জন্য খারাপ, আপনি জানেন কি?
‘আমার মায়ের কিডনিতে সমস্যা ছিল। ডাক্তার বলেছিল লবণ না খেতে। মাকে লবণ খাওয়াই নাই, তাও আমার মা মারা গেছেন। আমার মনে হয় ভাই মানুষ লবণ খাইলেও মরে, না খাইলেও মরে।
‘আপনি চায়ে লবণ দেন কেন?’
‘বেশি লাভের জন্য ভাই’
‘মানে?’
‘লবণ ছাড়া চা বেচলে দিনে যে চিনি লাগে। আর আধা কেজি লবণ যদি চিনির সাথে মিশিয়ে দেই তবে দিনে আড়াই কেজি চিনি কম লাগে। এতে প্রতিদিন প্রায় দেড়শো টাকা বেশি লাভ হয়। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা। আমি গরীব মানুষ ভাই। সাড়ে চার হাজার কি কম টাকা, আপনিই বলেন?

রতন একজন ট্রাক ড্রাইভার। প্রায় সময় মফিজের দোকান থেকে পান-সিগারেট বাকীতে খেয়ে যায়। বয়স বেশি না । তবে দেখতে বয়স্ক মনে হয়। চোখ দুটি লালচে থাকে সব সময়। মফিজের দোকানে এসে প্রথমে একটি সিগারেট ধরাবে, তারপর চা খেতে খেতে সিগারেটা শেষ করবে। চা-সিগারেট খাওয়ার পর একটি পান মুখে দিয়ে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে চলে যাবে।

রতন দৌঁড়ে এসে বলছে, ‘মফিজ ভাই নাও তোমার সব টাকা। আমি নেশাখোর হলেও মানুষ কিন্তু সৎ । কারো টাকা মেরে খাই না । আমাকে বাকি দিতে ভয় করো না।’
মফিজ বলল, ‘তা আমি জানি। রতন টাকা মেরে খাওয়ার লোক না। তুমি কি বাবুল কসমেটিকস গেইটের দিকে যাচ্ছো?’ ‘মহাজন গাড়িতে বসা আছে। ঐ দিকেই যাবে বলেছেন।’
‘তুমি এই লোকটারে একটু বাবুল কসমেটিকস গেইটে নামিয়ে দিও।
‘কে উনি? চেহারা তো ভালই দেখছি।

বাবুল কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভারের সাথে উঠলো তার গাড়িতে । গাড়িতে উঠে দেখে ড্রাইভারের পাশে আরেকজন লোক বসে আছেন। পরনে সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি। তিনি পায়ের উপর পা তুলে পা নাচাচ্ছেন আর হাতের মোবাইল টিপছেন। মোবাইল খুব দামি। চোখে চশমাও আছে। চশমার ফ্রেম সোনালী রঙের। বাবুল সাহেব গাড়িতে বসছে দেখে লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে চশমার উপরের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাবেন আপনি?
‘আমাকে বলছেন?
‘এইখানে কি আর কেউ আছেন?
‘আমি বাবুল কসমেটিকস গেইট যাবো।
‘সামনের গেইট না পিছনের গেইট?
‘পিছনের গেইট।
‘বসেন নামিয়ে দিবো।

রতন গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মহাজনের দিকে তাকালেন। মহাজন হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা দিলেন গান চালাতে। রতন দুই আঙ্গুল দেখালেন। মহাজন না সূচক মাথা নাড়িয়ে তিন আঙ্গুল দেখালেন। এর মানে হলো মহাজন তিন নম্বর ডিস্কের গান বাজাতে নির্দেশ দিলেন।
গান বেজে উঠলো...
আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো মরার কোকিলে
আমায় পাগল বানাইলো গো মরার কোকিলে
আমায় উদাসী বানাইয়া গেল বসন্তেরই কালে গো
মরার কোকিলে...
গানটি মমতাজের জনপ্রিয় একটি গান।
মহাজন তার মুখে এক খিলি পান ঢুকিয়ে দিয়ে গানের তালে তালে মাথা নাড়াচ্ছেন। পানের ফিক ফেলছেন বাবুল সাহেবের মুখের সামনে মুখ নিয়ে জানালা দিয়ে। বাবুল সাহেবের নাকে তার বাম গাল স্পর্শ করেছে। এভাবে পানের ফিক ফেলা চরম অভদ্রতা। মহাজন কাজটি স্ব-ইচ্ছায় করেছেন। তিনি বাবুল সাহেবকে বুঝাতে চান তিনি এই গাড়ির মালিক। গাড়িতে তার যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা আছে। এদিকে বাবুল সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। তিনি তার ছাত্রজীবনে লোকাল বাসে অনেকদিন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করেছেন । তিনি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে স্বীয় চেষ্টায় আজ বড় হয়েছেন। ট্রাকে যেতে তার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা, বরং মজা পাচ্ছেন।
ট্রাকটি চলতে চলতে হঠাৎ বিকট শব্দ হলো। ড্রাইভার গাড়ি থামালো। চাকা পাংচার হয়ে গেলো। দশ থেকে পনের মিনিট লাগবে স্পেয়ার চাকা লাগাতে। মহাজন আর বাবুল সাহেব গাড়ি থেকে নেমে গেলেন।
মহাজন বাবুল সাহেবকে বলছে,
‘নেন সিগারেট খান। বেনসন সিগারেট। দামী সিগারেট। নতুন চাকা লাগাতে বেশি সময় লাগবেনা।
‘আমি সিগারেট খাই না।
‘বুঝছি, আপনার মধ্যে কোন দেশপ্রেম নাই।
‘সিগারেটের সাথে দেশপ্রেমের সম্পর্ক কি?
‘আছে। আছে। সম্পর্ক আছে। চাকরি করেনতো বুঝবেন না। আমার মত ট্রাকের মালিক হলে ঠিকই বুঝতেন।
‘আপনি কিন্তু আমাকে বলেন নাই সিগারেটের সাথে দেশপ্রেমের সম্পর্ক কি?
‘সিগারেটের উপর শুল্ক একশো শতাংশের উপরে। একটি বেনসন সিগারেটের দাম এগারো টাকা হলে পাঁচ থেকে ছয় টাকা সরকারের কাছে যায়। সিগারেট খেয়ে নিজের ক্ষতি করছি তাতে কি? দেশের উপকার কিন্তু করে যাচ্ছি। তাই বেশি বেশি সিগারেট খেয়ে দেশপ্রেম বাড়ান।’
মহাজনের কথাা শুনে বাবুল সাহেবের মাথা ঘুরতে লাগলো। ড্রাইভার এসে বলল, চাকা লাগানো শেষ। মহাজন ও বাবুল সাহেব গাড়িতে আবার উঠে বসলো। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। মহাজন বাবুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি যেন কোথায় নামবেন বলেছেন?
‘বাবুল কসমেটিকস গেইট।
‘আমরাও যাবো।
‘আমাকে পিছনের গেইটে নামিয়ে দিবেন।
‘আগে একবার বলেছেন। মনে আছে। নামিয়ে দিবো। আপনি কি করেন?’
‘না মানে, না মানে।
‘মানে মানে করছেন কেন? চাকরি করা কি লজ্জার কিছু? সবাই কি আর আমার মত ট্রাকের মালিক হতে পারে?

পুলিশ তাদের ট্রাক থামালো। বাবুল সাহেবকে গাড়িতে দেখে পুলিশের এএসআই হাত তুলে সালাম দিয়ে বলল, ‘ভালো আছেন স্যার?’
মহাজনের সে কি আনন্দ! পুলিশ তাকে সালাম দিয়েছেন। আবার স্যার বলেও ডেকেছেন। সারাজীবন পুলিশকে স্যার বলতে বলতে শেষ হয়ে গেলাম। আর আজ ট্রাকের মালিক হওয়ায় পুলিশ আমাকে স্যার ডাকছে। মহাজন আজ মনে যে সুখ পেলো তা আর কখনো পাননি।

বাবুল কসমেটিকসের পেছনের গেইটে নেমে গেল বাবুল সাহেব। আর মহাজনের গাড়ি ঢুকলো মেইন গেইট দিয়ে। আজ মহাজন দেখা করবেন বাবুল কসমেটিকস এর মালিকের সাথে। এক মাসের জন্য পন্য পরিবহণে তার গাড়িটি ভাড়া নিবেন বাবুল কসমেটিকসের মালিক।
সিকিউরিটি অফিসার এসে ট্রাক মহাজনকে বলছেন, আপনাকে বড় স্যার ডাকছেন।
‘আমার ভয় লাগছে স্যার। আমি এতো বড় স্যারদের সামনে কখনো যাই নাই।
‘সমস্যা নাই। স্যার মাটির মানুষ। খুব ভালো।
মহাজন বড় স্যারের রুমে ঢুকে বাবুল সাহেবকে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট