প্রচ্ছদগল্প : সফর আলীর ঢাকা সফর : এ আই জাজাকী



সফর আলীর ঢাকা সফর
এ আই জাজাকী

প্রায় সারারাত জার্নি শেষে সফর আলী গাবতলী বাস টার্মিনালে নামে সকাল আটটায়। উদ্দেশ্য ঢাকা শহর ঘুরে দেখা। বেশ কিছুদিন হলো সে একটা চাকরি করছে। ছোট থেকে ঢাকার অনেক গাল-গপ্পো সে শুনেছে। সবার কত আকর্ষণ ঢাকার প্রতি। সে দেখেছে দলে দলে কত লোক ঢাকায় এসেছে কাজের সন্ধানে। কাজ করছেও বছরের পর বছর ধরে। আর তারাই গ্রামে গিয়ে ঢাকা সম্বন্ধে কত অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প করে। বলে, কতই না সুন্দর সে শহর। বিশাল দালান-কোঠা, প্রশস্ত আর সুন্দর রাস্তাঘাট। আমেরিকার মতো ফর্সা ফর্সা আর ধনী মানুষজন। ছোট থেকে সেসব গল্প শুনতে শুনতে তারও ইচ্ছে জাগে ঢাকা শহর ঘুরে দেখার। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত থাকার কারণে ছাত্রজীবনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় আসা সম্ভব হয়নি তার। এখন যেহেতু একটা চাকরি করছে তাই টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সে কারণেই মনের সাধ মেটানোর উদ্দেশ্যে এ সফর।
ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সারারাত তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। আশেপাশে কোনো দোকানপাটও দেখা যাচ্ছে না। হেঁটে আন্ডারপাস পর্যন্ত যাওয়ার পর দেখা গেল রাস্তার বিপরীতে কিছু অস্থায়ী দোকানপাট দেখা যাচ্ছে। আন্ডারপাস দিয়ে পার হয়ে অপরপাশে চলে গেল সে। আপাতত কিছু চা-বিস্কুট খেলেই চলবে। ঘণ্টা দুয়েক পর নাহয় হোটেলে ঢোকে নাস্তা করে নেয়া যাবে। যতটুকু না ক্ষুধা লেগেছে তারচেয়ে বেশি লেগেছে তৃষ্ণা। দোকানে ঢুকেই ট্যাপ (ফিল্টার) থেকে দুই গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিল সে। তারপর এক স্লাইস কেক আর একটা রং চা নিল। কেক আর চা শেষ করে পানি খেল আরও এক গ্লাস। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, ভাই কত হলো? দোকানদার বলল, চব্বিশ টাকা। কথা শুনে যেন সফর আলী সামান্য ভরকে গেল। তার হিসেবে একটা কেক আর একটা চা সর্বোচ্চ বারো টাকা হতে পারে। দোকানদার বলল, কী মামা হিসেব মিলতেছে না? দাঁড়ান আমি মিলিয়ে দিচ্ছি। এক কাপ চা ছয় টাকা, একটা কেক বারো টাকা আর তিন গেলাস পানি ছয় টাকা। সফর আলী মনে মনে বলে, লোকটা বলে কী! আমাদের এলাকায় তো পাঁচ টাকায় এরচেয়ে বড় কেক পাওয়া যায় আর পানি দশ গ্লাস খেলেও কোনো দাম দিতে হয় না। তারপর ভাবল, যাগগে, এ সামান্য ক’টা টাকা নিয়ে এত ভেবে কাজ নেই। চব্বিশ টাকা দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল সে। উদ্দেশ্য মতিঝিল বা গুলিস্তানের বাস ধরে পল্টন যাওয়া। সেখানে আর এক বন্ধু থাকে। তার সাথে দেখা করে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে যুহরের নামায আদায় করে একসাথে দুপুরের খাবার খাবে। সারা বিকাল এদিক-ওদিক ঘুরে তারপর রাতে বাড়ির উদ্দেশ্যে আবার বাস ধরবে। প্ল্যান মোতাবেক গন্তব্য এখন পল্টন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ তার সামনে একটা বাস এসে দাঁড়াল। বড় করে লেখা ৮ নম্বর। বাস থামতেই হেলপার ডাকতে লাগল, এই শ্যামলী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী। সফর আলী কাল বিলম্ব না করে ওঠে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পুরো বাস ভরে গেল। শুধু সিট না, সিটের চেয়ে বেশি লোক দাঁড়ানো যাত্রী। একেবারে উঠার সিঁড়িতে পর্যন্ত যাত্রী দাঁড়ানো। এতেও যদি হেলপার সন্তুষ্ট হত তাতেও একটা কথা ছিল। তারপরও সে ক্রমাগত ডেকেই চলেছে, এই ফার্মগেট, শাহবাগ, পল্টন....। আর সুপার ভাইজার শুধু বলছে, এই মামারা পিছে চাপেন। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আর এক ইঞ্চি চাপার মতো জায়গা নেই। অথচ সে ক্রমাগত বলেই যাচ্ছে পিছে চাপেন। এখন একটা উপায় আছে, যাত্রীরা যদি পেছন দিয়ে ভেঙে বেরিয়ে পড়ে।

সফর আলী চিৎকার করে ওঠল, আরে ভাই কী শুরু করলেন? সফর আলীর কথা শুনে আশেপাশের কয়েকজন তার দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারছে না, মানুষগুলো কেন এভাবে তাকাচ্ছে। সে ভাবল, হয়ত এ দৃশ্য দেখতে দেখতে তাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই কাউকে এর প্রতিবাদ করতে দেখছে বলে হয়ত এভাবে তাকাচ্ছে। কয়েকটা ছোটখাট জ্যাম পেরিয়ে আসাদগেট থেকে বামে টার্ন নিয়ে বাসটা একটু এগিয়ে যেতেই জানালা দিয়ে দেখা গেল জাতীয় সংসদ ভবন। সে চমকে ওঠল। আরে এটা সংসদ না? আহা রে! টিভিতে কত দেখেছি। দেখি, একটু নেমে ভালো করে দেখি। তারপর খেজুর বাগানের ওখানে বাস থামতেই সে সিট থেকে বেরিয়ে আসে। বাসে এত লোকজন যে ঠিকমতো বের হওয়াও যাচ্ছিল না। সে সিট থেকে উঠতেই দুইজন লোক সিট নিয়ে হৈচৈ জুড়ে দিল। একজন বলছে, আমি বসব। আরেক জন বলছে আমি বসব। দুইজন বেশকিছু কথা কাটাকাটির পর একজন জোর খাটিয়েই যেন বসে পড়ল। কি বিচ্ছিরি একটা অবস্থা! ছোট্ট একটা বাস অথচ সব সিট ভর্তির পরও দুই সারিতে লোক দাঁড়ানো। মাঝখানে এক ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা নেই। সে কীভাবে নামবে বুঝতে পারছে না। তারপরও বলল, দেখি ভাই, একটু সাইড দিন। নামব। কেউ যেন তেমন কর্ণপাত করছে না। অথচ নামার রাস্তায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। সিগনাল ছেড়ে দেওয়ায়, বাস আস্তে আস্তে এগুতে লাগল। এখন তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে লোকজনকে সামান্য সরিয়ে দিয়ে নামতে লাগল। এদিকে এইটুকু সহ্য করতে না পেরে কয়েকজন চিৎকার করে ওঠল, এই মিয়া ধাক্কান কেন? সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই এমন চাপের মধ্যে একজনের পায়ে সামান্য পারা লাগাতে তিনি চিৎকার করে ওঠলেন, ওই মিয়া দেখে পা ফেলতে পারেন না? সফর আলী মনে মনে বলল, একটা মানুষ নামবে অথচ তাকে তো সাইড দিচ্ছেই না তার ওপর আবার উল্টো তাকেই কথা শোনাচ্ছে। একটা মানুষ নামবে না নাকি? গেটের কাছে যেতেই দেখল গেট বোঝাই লোকজন। মনে হচ্ছে ভেতরে যত লোক ছিল তার দ্বিগুণ এখানে। এবার সে ভাবছে, এতগুলো লোক সরিয়ে সে কীভাবে বের হবে। এদিকে তার কারণে আরও কয়েকজন বেঁকে, নুয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব নয়। এর মধ্যেই একজন বলে ওঠল, আরে ভাই নামেন। আপনার জন্য তো সোজাও হতে পারছি না। তারপর সফর আলী বাধ্য হয়েই বলল, ভাই সিঁড়ি থেকে একটু নেমে সাইড দিন। একজন হেল্পার বলল, আরে মামা এখন নামবেন কেমনে? বাস তো ছেড়ে দিচ্ছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? পরে নামেন। সফর আলী কিছু বলল না। শুধু মনে মনে বলল, এতক্ষণ তো ঘুমাচ্ছিলাম। সিগনাল পার হয়ে বাস থামলে কয়েকজন নেমে সফর আলীকে নামতে দেয়। সফর আলী বিশ টাকা ভাড়া দিয়ে ফুটপাতে উঠে। এতক্ষণে সে ঘেমে নেয়ে একাকার। একটু জিরিয়ে রাস্তা পার হয়ে সংসদের দিকে চলে যায়। সে ভাবে ভুল করে হয়ত লোকাল বাসে ওঠে পড়ার কারণে এ অবস্থা। পরের বার ভালো বাস দেখে উঠতে হবে। প্রশস্ত আর পরিচ্ছন্ন ফুটপাত দেখে তার ভালোই লাগে। ঝিরঝিরিয়ে বাতাসও বইছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে সে সংসদের চারপাশ, ক্রিসেন্ট লেক আর চন্দ্রিমা উদ্যানটা ঘুরে দেখল। এবার পেটেও যেন টান পড়েছে। চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে বের হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল আশাপাশে কোনো হোটেল/রেস্টুরেন্ট আছে কিনা। সে লোক বলল, না মামা, এটা ভিআইপি এরিয়া। এখানে কোনো হোটেল রেস্টুরেন্ট নেই। তবে চন্দ্রিমা উদ্যান বাস স্ট্যান্ডের অপজিটে গিয়ে খেজুর বাগানের দিকে যেতে থাকলে  চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পেতে পারেন। বিনে পয়সায় লোকটা পরামর্শ খারাপ দেয়নি। লোকটার কথামতো সে সেভাবেই এগিয়ে গেল। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পেয়েও গেল কিন্তু সেগুলোতে সে ঢুকবে না। কেননা, সে শুনেছে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গলা কাটে। চমকে ওঠবেন না, ঠিক গলা কাটে না। তবে তারচেয়ে একেবারে কম কিছুও না। সেখানে এক বেলা খেতেই নাকি ছয়শো থেকে এক হাজার টাকা লেগে যায়। তার এখন জাস্ট দুটো রুটি বা পরাটা আর একটা ডিম পোজ হলেই চলবে। সর্বোচ্চ ত্রিশ টাকার খাবার। হেঁটে খেজুর বাগানের কাছে যেতেই দু-একটা দেশি খাবার হোটেল পাওয়া গেল। সেখান থেকে নাস্তা শেষ করে বের হয়ে খেজুর বাগান স্ট্যান্ডে গেল। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোনোক্রমেই বাসে ওঠা সম্ভব হলো না। প্রতিটা বাসের অবস্থা বেগতিক। একেবারে বানরের মতো ঝুলছে মানুষ। কয়েকটা বাসে চেষ্টার পরও যখন উঠতে পারছিল না তখন এক লোক স্বেচ্ছায় এসেই তাকে জিজ্ঞেস করল, মামা কোথায় যাবেন? সে বলল, পল্টন যাব। লোকটি বলল, আপনি এক কাজ করুন, হেঁটে সামনে চলে যান। ফার্মগেটে অনেক লোক নামে। সেখান থেকে উঠতে পারবেন। সফর আলী তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খামারবাড়ি রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেট চলে গেল। একজনের কাছ থেকে জেনে নিল বাসে উঠতে হলে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে ওপর যেতে হবে। ফুটওভার ব্রিজের কাছে গিয়ে সিঁড়িতে উঠার রাস্তাই খুঁজে পাচ্ছে না। এত দোকানপাট আর হকারের উপদ্রব যে হাঁটার রাস্তাটা পর্যন্ত নেই। ফুটপাত তৈরি হয় মানুষের জন্য আর এখানে দেখে মনে হচ্ছে বাজার তৈরির জন্য। অনেক্ষণে সিঁড়ি পেয়ে ফুট ওভার ব্রিজে উঠতেই সে আরও অবাক হলো। মনে হলো ফুট ওভার ব্রিজে না, সে ভুল করে কোনো মার্কেটে ঢুকে পড়েছে। পুরো ফুট ওভার ব্রিজ জুড়েই শুধু দোকান আর দোকান। এদিকে মানুষের এত চাপ যে, হাঁটাই দায় হয়ে পড়েছে। অথচ তারা পুরো ফুট ওভার ব্রিজই দখল করে বসে আছে। নিচে নেমে আর দাঁড়াতে হলো না। অমুক সিটিং সার্ভিস নামে একটি বাস দাঁড়ানো। যাবে পল্টন হয়ে গুলিস্তান। দেরি না করে উঠে গেল সে। সিট পেল পেছনের দিকে। সিটে বসে ভাবল, নাহ, বোধ হয় এবার তাহলে ভালো বাসেই উঠলাম। যেহেতু সিটিং সার্ভিস লেখা তাহলে খারাপ হবার কথা নয়। ভেতরটা দেখতেও বেশ চাকচিক্যপূর্ণ। মুহূর্তেই সব সিট পূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু এ কী! এরপরও বাসটা ছাড়ছে না কী জন্য? আরেকটা বিষয় সে খেয়াল করেছে। শহরে সবাই শুধু মামা মামা করে সম্বোধন করে। সে সকাল থেকে বেশ কয়েকবার এটি খেয়াল করেছে। সবাই কি সবার বাপের শালা নাকি? এভাবে মামা মামা বলে ডাকার কারণ কী? ভাই বলা কি এরচেয়ে ভালো নয়? যাগগে, কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে এসব ভাবতে ভাবতে দেখে বাসে অলরেডি দাঁড়ানো যাত্রী পাঁচ-ছয়জনের মতো হয়ে গেছে। তারপরও হেলপার ডাকছে, এই শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান। সফর আলী যেন থ হয়ে গেছে। এ কী অবস্থা! বাসের গায়ে লেখা সিটিং সার্ভিস, অথচ...। তারপরও সে এবার কিছু বলল না। অন্য দু-একজন যাত্রী যখন রাগ দেখিয়ে বলল, এই মামা কী শুরু করেছ তোমরা? বাসটা ফিলাপ হয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে তারপরও বসে আছ কেন? যাও না। এবার যেন চালকের একটু টনক নড়ল। আস্তে আস্তে বাস চলতে লাগল। আরও দু-একজন যাত্রী ওঠার পর একজন লোক বাসে ওঠল। হেলপার মাথার ওপর থেকে একটা হার্ড বোর্ড বের করে দিল। লোকটা যাত্রীদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে কী যেন লিখে দিয়ে নেমে গেল। তারপর বাসটার গতি বাড়ল। শুধু গতি বললে ভুল হবে, অনেক গতি। হঠাতই যেন চোখে আঁধার দেখতে লাগল সে। মুহূর্তের মধ্যে ধূলোয় ধূসর হয়ে গেল চারপাশ। লোকজনের হাঁচি আর কাশিতে অবস্থা বেগতিক। কেউ কেউ ড্রাইভারকে বলল, মামা আস্তে চালাও। সফর আলী খেয়াল করল আস্তে চালালেও তেমন কোনো লাভ নেই। আশেপাশের অন্য গাড়িগুলো সমানে ধূলো উড়িয়ে চলেছে। বরং যত দ্রুত যাওয়া যায় ততই ভালো। কয়েকজন মন্তব্য করল, সারাটা বছর রাস্তাগুলোতে খোঁড়াখুড়ি লেগেই থাকে। এ কারণেই এ অবস্থা। কারওয়ান বাজারের কাছাকাছি যেতেই এক মধ্যবয়স্ক লোক পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে নামতে চাচ্ছে। এদিকে সুপার ভাইজার পাঁচ টাকা ভাড়া নেবে না। সুপার ভাইজার বলে, পাঁচ টাকা ভাড়া নাই। চেক হয়ে গেছে, দশ টাকা দিন। ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার এক কিলোমিটার রাস্তাও হবে না। অথচ পাঁচ টাকা ভাড়া দিচ্ছে বলে এ নিয়ে হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে। সফর আলী বুঝতেছে না চেকার আসলে কী গুণেছে। শুধু সিটের যাত্রী নাকি দাঁড়ানো নাকি যাত্রীসহ। তার কাছে তো মনে হলো সে কিছু গুণেইনি। শুধু চোখ ঘুরিয়ে কী যেন লিখে নেমে গেছে। আর মালিকপক্ষ তো বোধ করি সিটের বাইরের হিসাব কখনোই চাইবে না।

যেহেতু এতে সিটিং সার্ভিস লেখা। আর কত যাত্রী তো দাঁড়িয়েই আছে। অথচ পাঁচ টাকা কম দিচ্ছে বলে যা শুরু করল। অবশেষে লোকটা দশ টাকা ভাড়া দিয়েই নামতে বাধ্য হলো। কারওয়ান বাজারের কাছাকাছি পৌঁছতেই হুড়মুড় করে বেশকিছু যাত্রী ওঠে গেল। এবার একেবারে ৮ নম্বর বাসে যেমন অবস্থা হয়েছিল ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে। একজন পুলিশকেও উঠতে দেখা গেল। বাংলামটর সিগন্যালে সামান্য জ্যামে বসে থাকার পর বাস শাহবাগ বাস থামল। বেশকিছু যাত্রী নামল এবং উঠল। সফর আলীর পাশের সিট খালি হওয়ায় একটা ছাত্র এসে বসল সেখানে। যাত্রী ঠেসে ভরার পর আবার ওঠল এক চেকার। চেকার ওঠতেই পুলিশটি তাকে বলল, এই মামা পুলিশ পাস আছে। সফর আলীর সাথে বসা ছাত্রটিও বলল, মামা ছাত্র আছে। চেকার বলল, ছাত্র কাটা নিষেধ। ছাত্রটা সামান্য তর্ক করলেও হাফ ভাড়া নেয়নি তার কাছ থেকে। অথচ পুলিশের কাছ থেকে নেয়নি এক টাকাও। অর্থাৎ পুলিশের ভাড়া ফ্রি। ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা করে। তাদের আয় রোজগার নেই। নিলে তাদের ফ্রি নিতে পারে। অথচ তাদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া পর্যন্ত নিচ্ছে না, নিচ্ছে ফুল। আর পুলিশ চাকরি করে, মাস শেষে মোটামুটি ভালো বেতনও পায়। উপরি ইনকামের কথা নাইবা বললাম। অথচ তাদের নেওয়া হচ্ছে ফ্রি।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সফর আলী খেয়াল করল, বিশাল এক জ্যামে পড়ে গেছে তাদের বাস। সে মাথা উঁচিয়ে দেখল যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু জ্যাম। এটা গাড়িও নড়ছে না। আস্তে আস্তে, এক হাত, দুই হাত করে এগুতে এগুতে প্রায় এক ঘণ্টায় মৎস্য ভবন পার হয়ে বাসটা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পেরেছে। কেউ কেউ অবশ্য বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছে। সেখানে আরও আধা ঘণ্টা বসে থাকার পরও যখন জ্যাম ছাড়ছিল না তখন সফর আলী পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই পল্টন আর কতদূর? লোকটা বলল, এই তো সামনের মোড় থেকে বামে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পল্টন। সফর আলী যেন বোকা বনে গেল। মাত্র এইটুকু রাস্তার জন্য সে এত সময় ধরে বাসে বসে আছে? নেমে একটু এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই এত জ্যাম কিসের জন্য বলতে পারেন? লোকটা বলল, কোন ভিআইপি নাকি যাবে সেজন্য। সফর আলী বলল, ও মাই গড! এক ভিআইপির জন্য হাজার হাজার মানুষের এত ভোগান্তি? পল্টন মোড়ে গিয়ে তার বন্ধুকে ফোন দিয়ে তার ঢাকায় আসার খবর জানাল। তার বন্ধু রিসিভ করেই বলল, আহা রে বন্ধু! তুই ঢাকায় আসবি তা আমাকে আগে জানাবি না? আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রাখতাম। আজ অফিসে খুবই কাজের চাপ। সফর আলী বলল, থাক তাহলে। আমি একাই ঘুরে ফিরে চলে যাই। বন্ধু বলল, না, কী বলিস? দেখি দুই-এক ঘণ্টার জন্য ছুটি পাওয়া যায় কিনা। তুই রাস্তার দক্ষিণ পাশের ফুটপাত ধরে দৈনিক বাংলা মোড়ের দিকে আসতে থাক। আমি তোকে একটু পর কল দিচ্ছি।
সফর আলী ফোন রেখে রাস্তা পার হতে যাবে তখন পুলিশ বলল, এখন পার হতে পারবেন না। ভিআইপি যাবে, তারপর যেতে পারবেন। এদিকে আজানও পড়ে গেছে। যুহরের নামাযটা জাতীয় মসজিদে পড়ার ইচ্ছে ছিল। তাই শেষবারের মতো পুলিশকে রিকোয়েস্ট করল, ভাই আমার একটু জরুরি প্রয়োজন, যেতে দিন প্লিজ। আমার সাথে তো আর গাড়ি নেই, হেঁটে যাব। পুলিশ একটু রেগেই যেন বলল, চোখের পলকে পার হোন, দৌড় দিন। সফর আলী তাই করল। রাস্তার দক্ষিণ পাশের ফুটপাতে উঠতেই সে দেখল একটু সামনেই একটা অ্যাম্বুলেন্স সজোরে ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতরে কেনো মুমূর্ষু রোগী আছে। সে একটু কৌতূহল নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটার কাছে গেল। গিয়ে যা দেখল তা সে জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। সে দেখল, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে একটা আট থেকে দশ বছরের ফুটফুটে ছেলে বুকের ব্যথায় ছটফট করছে আর পানি পানি করছে। ছেলের এ অবস্থা দেখে আগেই তার বাবা ডাক্তারের কাছে ফোন দিয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ভুলেও পানি দেওয়া যাবে না আর যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এদিকে ছেলের করুণ কণ্ঠভরা পানির জন্য হাহাকার যেন তার মা সহ্যই করতে পারছে না। দুই-তিনটা বাসের পেছনেই এই অ্যাম্বুলেন্সটা। সফর আলী যতক্ষণ আগে ভিআইপি আসার খবর শুনেছে এর মধ্যে পুলিশ চাইলে অ্যাম্বুলেন্সটা ছেড়ে দিতে পারত। সামনের রাস্তা ফাঁকা কিন্তু পুলিশ তা করেনি। অথচ অ্যাম্বুলেন্সের বেদনাসিক্ত সাইরেন অবশ্যই পুলিশের কানে পৌঁছেছে। তারপরও ছেলে যখন একেবারেই যায় যায় অবস্থা তখন ছেলের বাবা দৌড়ে পুলিশের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাল যে, অ্যাম্বুলেন্সটা যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ বলল, এখন পারা যাবে না। ভিআইপি জিরো পয়েন্টের কাছে চলে এসেছে। ছেলের বাবা আবার দৌড়ে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে যেতেই দেখল ছেলের দেহ নিথর হয়ে আসছে। হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ করে একদম ক্ষীণ স্বরে বলছে পানি, পানি। ছেলের মা ছেলের এ অবস্থা সইতে না পেরে নিজেই বোতলের ক্যাপ খুলে ছেলের মুখে একটু পানি ঢালল কিন্তু পানিটা গিলার শক্তি যেন ছেলেটার আর ছিল না। পুরো পানিটাই গড়িয়ে পড়ে গেল গাল বেয়ে। সকলের চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল একটা তাজা প্রাণ। মুহূর্তেই তীব্র আর্তনাদে ফেটে পড়ল পল্টন মোড়। একটা অজানা-অচেনা শিশুর জন্য সফর আলীর চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ল কয়েকফোঁটা অশ্রু। ভিআইপি পার হয়ে গেলে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সের পেছনের গাড়িগুলো ক্রমাগত হর্ন দিতে থাকল। তারা হয়ত জানেই না অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরের খবর। সফর আলী আবার ফুটপাতে উঠে দাঁড়াল। সে দেখল, অ্যাম্বুলেন্সটা আর হাসপাতালের দিকে না গিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে আবার উল্টো দিকে যেতে শুরু করেছে।
এদিকে সফর আলীর ফোন ক্রমাগত বেজেই চলেছে। কতক্ষণ সময় পার হয়ে গেছে তার খোঁজ নেই। ফোন রিসিভ করতেই তার বন্ধু বলল, কী রে কোথায় তুই? সে বলল, বায়তুল মুকাররমের সামনে। তার বন্ধু বলল, সেই কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি। তুই ধরছিস না বলে আরও ভাবলাম কোনো বিপদ আপদে পড়লি নাকি? সফর আলী বলল, না তেমন কিছু না। তুই আয়। তারপর তার বন্ধু এলে পুরো ঘটনা খুলে বললে সে বলে, ও এই কথা? এরকম কত শত ঘটনা এই আজব শহরে ঘটে। বাদ দে, ঝেড়ে ফেল মাথা থেকে এসব। তারপরও যেন সফর আলীর মনটা কেমন বিষণœ। সে ভাবছে, এ কেমন শহর? মায়া নেই, দয়া নেই সহানুভূতি নেই। তারপর মসজিদে ঢুকে দুইজন অযু করে যুহরের নামাযটা আদায় করে নিল। যদিও দেরি হয়ে যাওয়ায় জামাত ছাড়াই পড়তে হয়েছে। নামাজ শেষ করে দুইজনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে। সফর আলীর বন্ধু বলে, আজ সময় দিতে পারছি না বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। অফিস থেকে এক ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়ে বের হয়েছিলাম। তা তুই এখন কোথায় যাবি? সফর আলী বলল, ইচ্ছে আছে কার্জন হল, দোয়েল চত্বর, শহিদ মিনার আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা ঘুরে দেখার। তার বন্ধু বলল, আচ্ছা আমি রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি, তুই যা। তারপর সন্ধ্যায় আমার বাসায় চলে আসিস। আজ থেকে কাল চলে যাস। সফর আলী বলল, না রে দোস্ত, আজ রাতেই ফিরব। আজ একটা বিশেষ ছুটি ছিল, কাল আবার অফিস ধরতে হবে।
তার বন্ধু রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। সে হাঁটতে হাঁটতে গোলাপ শাহের মাজারের কাছাকাছি চলে গেল। ফুটপাতে একটা কাপড়ের দোকানের কাস্টমার আর দোকানদারের বাকবিত-া শুনে সে একটু দাঁড়াল। দোকানদার বলল, এটা চায়না শার্ট, দাম ষোলোশো টাকা। কাস্টমার বলল, তিনশো টাকায় দিবেন? দোকানদার বলল, ধুর মিয়া, শার্ট কিনতে আসছেন? এই দামে চায়না শার্ট না, স্যান্ডু গেঞ্জি কিনে পরেন গা মিয়া। কাস্টমার চলে যাওয়ার সময় দোকানদার বলল, লাস্ট কত দিবেন বলেন। কাস্টমার বলল, ঐ যা বলেছি তাই। দোকানদার বলল, কিছু বাড়াতে পারলে আইসেন। কাস্টমার বলল, এক টাকাও বাড়াতে পারব না। দিলে দেন, না দিলে যাই। দোকানদার বলল, আসেন ভাই, নিয়া যান। এই প্যাক কর। আর এসব কান্ড দেখে সফর আলী মনের অজান্তেই হেসে ওঠে। কোথায় ষোলোশো টাকা আর কোথায় তিনশো। যাগগে, আর সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে পা বাড়াল সে। মূল সড়কের কাছে যেতেই ঘটল আরেক আচানক ঘটনা। একটা বাস দাঁড়িয়ে ডাকছিল, এই সদরঘাট, সদরঘাট। আরেক মহিলা জানালার পাশে বসে বসে কারও সাথে ফোনে কথা বলছিল। বড় স্মার্টফোনটা যেন জ্বলজ্বল করছিল। হঠাৎ দ্রুতবেগে এক লোক এসে চিলের মতো ছো মেরে ফোনটা নিয়ে পালিয়ে গেল। সফর আলী বুঝতে পেরে ছুট লাগাল ছিনতাইকারীর পেছনে। কিন্তু মুহূর্তেই ভিড়ের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ছিনতাইকারী। সফর আলী ফিরে এসে দেখল, মহিলা বাস থেকে নেমে হা-হুতাশ করছে সমানে। কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে মহিলাকেই উল্টো দোষারোপ করছে, আপনি জানালার পাশে বসে ফোনে কথা বলেন, শিক্ষা হলো। ভবিষ্যতে আর এমন করবেন না।



কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সফর আলী সামনে পা বাড়াল। একপাশের রাস্তা পার হয়ে ডিভাইডারে উঠতেই চোখে পড়ল চাকচিক্যপূর্ণ আর আধুনিকতায় আচ্ছাদিত একটা ছোট মাজার। লাল রঙের লেখাটা পড়ে দেখল এটাই সেই ঐতিহাসিক গোলাপ শাহের মাজার। কেউ সেজদা করছে, কেউ জিকির করছে আর কিছু পাগল নানা ভঙ্গিতে বসে আসে। মাজারের আরেকটু কাছে যেতেই দেখল, লাল শালুতে ঢাকা কবরের উপরে টাকার রাজ্য। হাজার হাজার নোট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ভেতরে। সে ভাবল, এ নির্জীব কবর এত টাকা দিয়ে কী করবে? মাজার দেখে তো মনেও হচ্ছে না যে উন্নয়নের কোনো বাকি আছে। রাস্তার মাঝখানে টাইলস মোড়ানো মাজার তো আর স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাবে না। মাজারের কাছেই এক পা-হীন প্রতিবন্ধী ভিক্ষা করছে। তার বাটিতে দেখা গেল দুই-চারটা দুই টাকা আর পাঁচ টাকার নোট। অথচ মৃত মানুষের মাজারে পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকার নোট পর্যন্ত আছে। মাজার পাহারার জন্য আবার রাখা হয়েছে আনসার বাহিনীর সদস্য। সফর আলী মনে মনে বলল, হায় আফসোস! দুর্দশাগ্রস্ত জীবিত মানুষ রেখে মৃতের জন্য কত আয়োজন। ফিনিক্স রোডের উত্তর পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটা দিতেই চোখে পড়ল সারি সারি মোবাইল আর মোবাইল এক্সেসোরিজের দোকান। সে মনে করল হয়ত তারা পুরাতন মোবাইল কিনে ঠিকঠাক করে বিক্রি করে। কিন্তু আরেকটু সামনে এগুতেই ধারণা পাল্টে গেল। এদিকে সব দামি দামি ব্র্যান্ডের নতুন মোবাইল রেখে বিক্রি করা হচ্ছে। সে চিন্তা করল, দামি দামি ব্র্যান্ডের মোবাইল এ খোলা ফুটপাতে? এবার তার চোখ পড়ল প্রায় দেড়লাখ টাকা মূল্যের আইফোন টেনের ওপর। সে চমকে ওঠল। আরে! দেড়লাখ টাকা দামের মোবাইল এভাবে পলিথিন বিছিয়ে ফুটপাতে রেখে বিক্রি করছে? সে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, ভাই আইফোন টেনটা একটু দেখি। যদিও তার পকেটে এত টাকা নাই যে একটা আইফোন কিনবে। দোকানদার ফোনটা দিলে সে নেড়েচেড়ে দেখল। নাহ, সব ঠিকই তো আছে। দেখি তো দামটা জিজ্ঞেস করে। দাম জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার বলল, মামা যদি দামাদামি না করেন, একদাম দশ হাজার টাকা। সফর আলী যেন আরও চমকে ওঠল। বলে কী! দেড়লাখ টাকা দামের নতুন মোবাইল দশ হাজার? সে বলল, এত দামি মোবাইল এত সস্তায় কীভাবে দেন? দুই নাম্বার নাকি? দোকানদার বলল, না এগুলো টানা মোবাইল। সে বলল, টানা মোবাইল মানে? দোকানদার বলল, টানা বুঝেন না? আচ্ছা, না বুঝলে নাই। এক নাম্বার মোবাইল। নিলে নিতে পারেন। সে বলল, আচ্ছা রাখেন। সামনের দিকে পা বাড়াতেই দোকানদার বলল, এই মামা কত দিবেন? সফর আলী বিড়বিড়িয়ে বলল, আরও কমানো যাবে? বাপ রে, এগুলো কী? আরেকটু সামনে যেতেই এক দোকানদার আর কাস্টমারের মধ্যে তর্কাতর্কি শুনে সে গতিটা শ্লথ করল। কাস্টমার বলছে, মামা এই মোবাইলটা কালকে আপনার কাছ থেকে নিলাম। আজই নষ্ট হয়ে গেছে, আর খুলছে না। দোকানদার বলল, আরে না এই ফোন আমার না। আমি এ ফোন বিক্রিই করি না। কাস্টমার বলল, কী বলেন? কাল নগদ সাত হাজার টাকা দিয়ে আপনার কাছ থেকেই তো ফোনটা নিলাম। দোকানদার বলল, আরে না। আর যদি নিয়েও থাকেন তারপরও তো ফেরত নিতে পারব না। কারণ আমরা কোনো ফোনের গ্যারান্টি, ওয়ারেন্টি দিই না।
সফর আলী তাদের বাকবিত-া দেখার জন্য আর অপেক্ষা করল না। এদিকে এসব তামাশা দেখতে দেখতে বিকাল হতে চলল। সন্ধ্যার আগে কয়েকটা জায়গা ঘুরে এ আজব শহর ছাড়তে হবে। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের সামনে দিয়ে ডানে টার্ন নিয়ে হেঁটে কার্জন হলে ঢুকল। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে দোয়েল চত্বর, শহিদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখে হেঁটে জাতীয় ঈদগাহের সামনে আসলো। এখান গাবতলীর বাস পাওয়া যাবে। এসে দেখল, সেই সকালের মতো সুবিশাল এক জ্যাম লেগে আছে। তারপরও একটা গাবতলীর বাস দেখে উঠে পড়ল সে। সিট তো দূরের কথা, কোনোরকম গেট থেকে একটু উপরে উঠে দাঁড়াল সে। প্রায় আধা ঘণ্টায় মৎস্য ভবন পর্যন্ত বাস যেতে পেরেছে। অথচ এইটুকু রাস্তা হেঁটে আসলে বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগত। এই জ্যাম ঠেলে কতক্ষণে গাবতলী পৌঁছাতে পারবে তা আল্লাহই জানে। সামনের গ্লাস দিয়ে যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত শুধু জ্যাম আর জ্যাম। সফর আলীর যেন আর ধৈর্যে কুলায় না। সে পাশের একজনকে বলল কমলাপুর কোন দিকে? লোকটি বলে ঐ পূর্ব দিকে। সে বলল, রিকশায় যাওয়া যাবে না? লোকটা বলল, হ্যাঁ যেতে পারবেন। সে আর কোনো কথা না বলে হেলপারের হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে নেমে পড়ল। রাস্তা পার হয়ে পূর্বপাশে গিয়ে শিল্পকলা একাডেমির সামনে থেকে রিকশা নিয়ে সোজা কমলাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। সেগুনবাগিচার আবাসিক এলাকায় ঢুকতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। রিকশাওয়ালা সিটের নিচ থেকে পলিথিন বের করে দিল। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। সে ভিজেই যাচ্ছে। রিকশাওয়ালাকে বলল, ভাই কোনো বাসার সামনে রাখেন, আপাতত দাঁড়াই। একটা বাসার সামনে রিকশাটা রেখে দুইজনেই ঢুকে গেল গেইটের ভেতরে। খাকি পোশাক পরা এক সিকিউরিটি গার্ড বলল, স্যার কয়তলায় যাবেন? সফর আলী বলল, কোনো তলায় না। বৃষ্টির জন্য এখানে এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি কমলেই চলে যাব। গার্ড বলল, না না, এখানে দাঁড়াতে পারবেন না। এখনই স্যারদের গাড়ি ঢুকবে। তারা এসে আপনাদের দেখলে আমাকে বকবে। মনে করবে আমি আজেবাজে লোক ঢুকিয়েছি। গার্ডের কথা শুনে তারা আর দাঁড়াতে পারল না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কিছুদূর গিয়ে একটা যাত্রী ছাউনি পেল। মানুষ গিজগিজ করছে সেখানে। তারপরও কোনোরকমে গিয়ে দাঁড়াল। মুষলধারে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। অন্তত মোবাইলটা রক্ষা করতে হলেও এখানে দাঁড়াতে হবে। এতক্ষণ খুব কষ্টে মোবাইলটাকে শুকনো রেখেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানিতে তলিয়ে গেল সামনের রাস্তা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে তাদেও পা ডুবে গেল। একঘণ্টা পর বৃষ্টি কমলে রিকশাওয়ালা বলে, আমি যাব না মামা। সব ডুবে গেছে, পানির মধ্য দিয়ে যাত্রীসহ রিকশা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সফর আলী বলল, এত পানির মধ্যে আমি কীভাবে যাব? একটু নামিয়ে দেন না। রিকশাওয়ালা বলল, যেতে পারি, যদি দুইশো টাকা ভাড়া দেন। সে বলল, সে কী! আপনার সাথে না আমার একশো টাকার চুক্তি হলো? রিকশাওয়ালা বলল, সেটা বৃষ্টির আগে। এমন পানির মধ্যে যাওয়ার চুক্তি হয়নি। সে বলল, তাহলে আর নাহয় বিশ-ত্রিশ টাকা বেশি নিতে পারেন। তাই বলে একশো টাকাই বেশি? রিকশাওয়ালা বলল, গেলে যান, না গেলে পঞ্চাশ টাকা দেন। আমি চলে যাই। আরও কত যাত্রী আছে যাওয়ার জন্য। অবশেষে দুইশো টাকা ভাড়া দিয়েই যেতে হলো তাকে।
কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়েও সুবিশাল এক লাইন ধরে অবশেষে উত্তরবঙ্গের ট্রেনের একটা টিকিট কাটতে সক্ষম হয় সফর আলী। বড় মনিটরে ট্রেনের টাইম শিডিউল ও প্লাটফর্মের নম্বর দেওয়া। সে মনিটরে ট্রেনের নাম দেখতে পেল কিন্তু প্লাটফর্ম নম্বর তখনও দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ ট্রেন এখনও প্লাটফর্মে ঢোকেনি। ট্রেন ছাড়তে আরও প্রায় এক ঘণ্টা দেরি। তাই সে ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছিল। ছোট থেকেই তার মনটা একটু কাব্যিক। মাঝে মাঝে ছন্দ মেলাতে পছন্দ করে। হঠাৎ তার মনে নতুন দুটো লাইন এসে গেল। সে আস্তে আস্তে গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করতে লাগল-
“এই শহরে মানুষ থাকে
কেমনে থাকে, কেমনে থাকে?”


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট