প্রচ্ছদগল্প : দূরুত্ব : আবুল বাশার শেখ



দূরত্ব
আবুল  বাশার শেখ

বিরক্তি একটা ভাব নিয়ে বন্ধু মোমিনকে বার বার মোবাইলে কল দিতে ছিলেন হাফিজ। বেশ কয়েক বার রিং হলেও ওপার থেকে ধরলো না কেউ। দু’একবার নাম্বারটা ব্যস্তও দেখালো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। এতে করে বিরক্তির পরিমাণটা দ্বিগুণ বাড়লো। যোগাযোগ করাটা আর হলো না। উপকার করে বন্ধুর কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেলে সত্যিই খুব খারাপ লাগে। বিরক্তির রেশে বেশ কয়েক দিন এভাবেই কেটে গেলো। বাড়ির একটা কাজের জন্য টাকাটা খুব প্রয়োজন। নিজের আয় করা টাকা থেকে বন্ধুকে ধার দিয়েছিল। টাকাটা নেয়ার সময় বলেছিল কয়েকদিনের মধ্যেই দিয়ে দেবে। খুব বেশি প্রয়োজন পরেনি তাই এতোদিন সে টাকাটা চায়নি। নিজে থেকেই বেশ কয়েকটি তারিখ দিয়েছিল মোমিন নিজে। কিছুদিন আগে মোবাইলে তারিখ করেছিল তিন মাস পরে টাকাটা অবশ্যই দিয়ে দিবে। তিনমাস পেরিয়ে ছয় মাস হয়ে গেল তারপরও টাকা দেয়ার খবর নেই। এসব কিছু চিন্তা করে বেশ রাগ হলো মোমিনের উপর। বিষয়টি তার কাছে মোটেই ভালো লাগলো না যার কারণে মনের ভেতর বন্ধুর প্রতি বিরূপ একটা ধারণাও কাজ করতে লাগলো। যেহেতু টাকাটা খুব প্রয়োজন তাই লোক মারফত বন্ধুর অফিসের টেলিফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করে ফোন দিলেন। রিসিপশন থেকে একজন সুরেলা কণ্ঠের এক মহিলা ফোন ধরলেন। হাফিজ তার কাছে মোমিনের পারসনাল মোবাইল নাম্বারটা চাইলেন কিন্তু অপরিচিত বলে অনুমতি ছাড়া নাম্বার দেয়া যাবেনা বলে জানিয়ে দিলেন ফোন রিসিপকারী। তিনি মহিলাকে বললেন- তাহলে অনুগ্রহ করে লাইনটা ট্রান্সফার করে মোমিন সাহেবের কাছে দেন। মহিলা লাইনটা ট্রান্সফার করে দিলে ওপার থেকে মোমিন বন্ধু হাফিজের গলা চিনতে পারলেন। যেহেতু অফিসের নাম্বারে ফোন তাই প্রথমেই মোমিন তার বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন, যাতে করে হাফিজ তাকে তেমন কিছু না বলতে পারে।
হাফিজ বললেন- তোর টাকা দিতে সমস্যা হতেই পারে তাই বলে তোর মোবাইল নাম্বারটা বন্ধ রাখতে হবে কেন?
না দোস্ত, বন্ধ না, আমি তোকে টাকাটা দিতে পাচ্ছিনা বলে তোর নাম্বারটা আমার নাম্বারে ব্লক করে রেখেছি। যার কারণে তোর এখানে বন্ধ দেখাচ্ছে, এ জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
‘আচ্ছা মানুষ কি শুধু টাকার জন্যই ফোন দেয়! অন্য কিছুর জন্য কি তোকে প্রয়োজন পরতে পারেনা! তুই টাকা দিতে পাচ্ছিস না সেটা সোজাসোজি বললেই হতো। এতো তারিখ করার কিইবা প্রয়োজন ছিল! যা হোক নাম্বারের ব্লক খোলে দে তারপর তোর সাথে কথা বলি।
‘ঠিক আছে দোস্ত, আমি পরে তোর সাথে কথা বলি এখন অফিসে একটা জরুরী কাজ করছি তো।
‘ঠিক আছে কাজ কর, অফিস শেষ করে আমি তোকে কল দেবো রিসিপ করিস।
‘ঠিক আছে।
দীর্ঘদিন পর বন্ধু মোমিনের সাথে কথার আদান প্রদানে কিছুটা যেন স্বস্তি আসলো। হাফিজ খুব পরিশ্রমী একজন মানুষ। সারা দিনের অফিস শেষ করে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসেন সন্ধ্যায়। শুরু হয় আরেক ব্যস্ততা। এতোসব ব্যস্ততার ভেতরেই ঠিক সাতটায় মোমিনের মোবাইলে কল দিলেন। মোমিন কল রিসিপ করলেন খুব নরম গলায়। এবার হাফিজ বললেন- দোস্ত আমরা একসাথে ছোট থেকে বড় হয়েছি। লেখাপড়া শেষ করে দু’জন ভিন্ন জায়গায় চাকুরি করছি। হয়তো একে অপরের সব খবর জানিনা। সত্যি করে বলতো তোর সমস্যা কি? তুই তো এমন কাজ করার কথা না!
‘ঠিক কথাই বলেছিস আমি এমন ছিলাম না। জীবন বাস্তবতায় আজ আমি যেন এক পরাজিত সৈনিক হয়ে যাচ্ছি কেননা অনেক ক্ষেত্রে কথা দিয়ে কথা রাখতে পাচ্ছিনা। দিন দিন চলার পথ যেন ছোট থেকে আরোও ছোট হয়ে যাচ্ছে।
‘এমন হওয়ার কারণ কি? খোলে বলতো!
‘দেখ দোস্ত আমরা একসাথে দীর্ঘদিন লেখাপড়া করেছি যার কারণে তুই আমার অনেক কিছুই জানিস। অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে। কারণ আমার পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। এক বাবার উপার্জনে চলছে সব কিছু। আমার পরিবারের সদস্য বলতে বর্তমানে সাত জন। গ্রামের বাড়িতে থাকে বাবা-মা আর এক বোন। শহরে আমি, আমার স্ত্রী আর দুই সন্তান। সবার দায়িত্ব এখন আমার কাধে। বোনটা লেখাপড়া করছে। বাবা-মাও তেমন কিছু করতে পারেনা। গ্রামের বাড়িতে যেটুকু জমি আছে সেটুকুতে চাষ বাস করে আর প্রতি মাসের বেতন থেকে আমার দেয়া তিন হাজার টাকা দিয়ে কোন মতে সংসার চালিয়ে নেয়।
‘কেন তোর দু’জন বড় ভাই ছিল না! উনারা এখন কি করে?
‘বড় দুই ভাই যে যার মতো সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। ছেলে মেয়েদের নিয়ে তারাও কোন মতে চলছে। তাদেরকে যে কিছু বলবো সে পরিস্থিতি নেই। আমি শিক্ষিত ছোট ছেলে তাই বাবা-মা আর বোনকে ফেলতে পাচ্ছিনা। মায়ার বাঁধনে তাদেরকে সব সময় আগলে রাখতে চেষ্টা করি।
‘তোর সংসারের অবস্থা কি?
‘কি আর অবস্থা! ঢাকা শহরে সাত হাজার টাকার ভাড়া বাসায় কোন মতে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বড় মেয়েটাকে খরচ বেশি বলে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি, সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। তারপরও তার পেছনে প্রতি মাসে খরচ হয় এক হাজার টাকার উপরে। ছোট ছেলে বাচ্চাটাকে বাজার থেকে দুধ কেনে খাওয়াবো তারও সামর্থ নেই। মায়ের বুকের দুধ আর ভাত খাওয়াতে হয় তাকে। সংসারের খাবার খরচ প্রায় ছয় হাজার টাকা। আমি যে বেতন পাই তার থেকে খরচের পর তেমন আর কিছুই থাকেনা। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করলো। তুই বিশ্বাস করবি কিনা তা জানিনা আমি চলার পথে এক কাপ চা পর্যন্ত পান করিনা। বন্ধুরা চা পান করতে বললে মুখে হাসি নিয়ে বলি আমি চা পান করিনা, চা পান করলে আমার গ্যাস হয়। যদিও আমি চা পান করি। একটা কথা আজ তুই আমার চায়ের বিল দিলি কাল তো আমাকে দিতে হবে কিন্তু সেই সামর্থ আমার তো নেই। তাই আমি সব সময় খুব হিসেব করে চলতে চেষ্টা করি। বাজে কোন কাজে আমি একটি টাকাও খরচ করিনা। এতো কিছুর পরও ঠিক মতো চলতে পাচ্ছিনা। অফিসের ভেতরের সহকর্মী ও বাহিরের বন্ধু বান্ধবদের সাথে চলার সময় চেষ্টা করি একটু হাসি মুখে কথা বলে সব কিছু আড়াল করতে কিন্তু আজকে তোর সাথে পারলাম না। বিবেকের দংশনে সব কিছু বলতে বাধ্য হলাম।
‘তা তুই আমার কাছ থেকে এতো টাকা নিয়ে কি করলি?
‘তোর কাছ নেয়া টাকাটা আমি কোন বাজে কাজে খরচ করিনি। ঐ টাকাটা আমার ছোট বোনের কলেজে ভর্তির সময় লেগেছিল। বোনটা লেখাপড়ায় খুব ভালো আর তাইতো ওকে লেখাপড়ায় মানা করতে পারিনা।
‘তোর অন্য ভাইয়েরা কোন হেল্প করতে পারেনা?
‘দোস্ত শিক্ষার আলো না থাকলে যা হয়। বড় দুই ভাই বিভিন্ন কাজ করে কোন রকমে তাদের সংসার চালায়। বাধ্য হয়েই সব কিছু মেনে নিয়েছি। আমার হয়তো একটু কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সবাই তো ভালো চলছে। সত্যি কথা বলতে কি ওদের ধারণা আমি খুব বড় বেতনের চাকুরি করি। কিন্তু আমি যে কত বড় বেতনের চাকুরি করি সেটা শুধু আমিই জানি।
‘দেখ দোস্ত তুই খুব খারাপ করেছিস। তোর এসব কথাগুলো আগেই বলা উচিত ছিল। কথাগুলো খুব ভাঙ্গা গলায় বলতে বলতে চোখ মুছতে ছিল হাফিজ। আরে দোস্ত আমি কি তোর আপনজন নই। তোর বিপদের দিনে যদি আমি পাশে নাই থাকতে পারলাম তবে কিসের বন্ধু!
‘না মানে দোস্ত শোন, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি বিপদের মাঝে জীবন যাপন করছে। এরা না পারছে নিচু শ্রেণীর কাজ করতে না পারছে উচু শ্রেণীর কাজ করতে। এদের মাস শেষে যে বেতন হাতে আসে তা দিয়েই কোন মতে চলতে হয়। যার কারণে পরিবারের কোন সদস্যদেরই আবদার কিংবা সঠিক প্রয়োজন পূরণ করা হয়ে উঠেনা। অফিসে এ বছর যে ইনক্রিমেন্ট হয়েছে তার এরিয়ার কিছু টাকা দেয়ার কথা ছিল কিন্তু আজ দিচ্ছে কাল দিচ্ছে করে প্রায় তিন মাস হয়ে গেল আজও ঐ টাকাটা পেলামনা। ভেবেছিলাম ঐ টাকাটা পেলেই তোর টাকাটা দিয়ে দেবো কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না। যার কারণে তোর সাথে কথা দিয়ে কথা রাখতে পাচ্ছিনা।
‘থাক দোস্ত আপাতত তুই এ বিষয়ে আর চিন্তা করিসনা। আমি দেখি টাকাটা অন্য কোন দিক থেকে ম্যানেজ করা যায় কিনা। তোর যখন সুবিধা হয় তখনই না দিস আর যদি না পারিস তবেও কোন সমস্যা নেই। তবে হ্যা বন্ধুর কাছে কোন বিষয় এতটা লুকিয়ে রাখতে নেই। এতে করে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।
কথা শেষ হলোনা কিন্তু মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ, লাইনটা কেটে গেলো। হাফিজের মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আত্ম বিবেকে বন্ধু মোমিনের বিষয়টি খুব বেশিই যেন দাগ কাটলো। মানুষের সব বিষয় ভালো ভাবে না জেনে কোন কিছুই ধারণা করা মোটেই উচিত নয়। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থাকলে অবশ্যই তার ভালো মন্দ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখা দরকার। নয়তো বন্ধুত্ব মনুষ্যত্ববোধকে ধিক্কার দিয়ে মানবিকতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। হাফিজ পকেট থেকে টিস্যু বের করে মূছে নিলো সদ্য চোখ থেকে বের হওয়া দু’ফোটা নোনা জল।

ভালুকা প্রেসক্লাব, ভালুকা, ময়মনসিংহ।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট