বেদের মেয়ে স্বর্ণা

 



বেদের মেয়ে স্বর্ণা

শহিদুল ইসলাম লিটন


সালমা একাদশ ২য় বর্ষের ছাত্রী। লেখাপড়ায় যেমন ভাল ঠিক তেমনি স্বভাব চরিত্র ও খুব ভাল। দেখতে খুব সুন্দর সে সর্বদা পর্দা পুষিদা বজায় রেখে চলাফেরা করে। পার্শ্ববর্তী গ্রামের ছেলে হৃদয় সালমার সাথে একই কলেজে পড়ে। তার স্বভাব চরিত্র বেশ ভাল নয়। সে সালমাকে বেশ কয়েকবার প্রেমের প্রস্তাব দিলে সালমা তা প্রত্যাখান করে। সালমা একদিন খুব সুন্দরভাবে হৃদয়কে বুঝিয়ে বলে দেখ হৃদয় আমি একজন নারী। একদিন আমাকে কারো না কারো জীবন সঙ্গীনি হতে হবে। প্রেম সবার জীবনে আসে ঠিকই কিন্তু তা অনেক বিচার বিশ্লেষণের বিষয়। তোমাকে আমার পরিবারের সবাই ভালভাবে চিনে বিধায় তারা কোনদিন আমাকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে রাজী হবে না। আর আমিও আমার পরিবারের অমতে কোনদিন কাউকে জীবন সঙ্গী করতে পারবো না। এটাই আমার শেষ কথা সুতরাং তোমাকে অনুরোধ করে বলছি-আমাকে তুমি কোনদিন বিরক্ত কর না। হৃদয় সালমার মনের শেষ কথা শোনে মনে মনে চিন্তা করে, সালমা এটা তোমার শেষ কথা হলে কি হবে, আমার হৃদয়ে যে সব সময় তোমার কথা, তোমার কল্পনা, তোমার মায়াবী চেহারার প্রতি”ছবি আমাকে পাগল করে রেখেছে।

আমি জানি আমার হৃদয়ের মূল্য তোমার অন্তরে আন্তরিক ভালবাসার মর্যাদা কোনোদিন পাবে না। কিন্তু প্রতিটি মুহুর্তে তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমার হৃৎপিন্ড থেকে যে রক্ত ঝরছে। আমি কি একটি অবাস্তব স্বপ্ন অন্তরে লালন করে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবো। নির্বোধের মত চিন্তা না করে বরং আমি আরেকদিন শেষবারের মতো সালমার সামনা-সামনি হবো। তাকে বলব- সালমা আমার জীবনের সব ভুলকে পরিহার করে আমি সুন্দর জীবনে ফিরে আসবো। তোমার ভালবাসার পরশে আমি একজন খাঁটি মানুষ হতে চাই। অনুগ্রহ করে আমাকে ফিরিয়ে দিওনা সালমা। সালমা হৃদয়কে বলে দেখ হৃদয় তুমি তো আমাদের গ্রামেরই একজন। হাজার হাজার মানুষের চোখে, হৃদয়ে অংকিত রয়েছে তোমার কু-কর্মের ইতিহাস। গ্রামের প্রতিটি মানুষের সাথে তোমার আমার বসবাস। গ্রামের প্রতিটি মানুষ তোমাকে কতটুকু ভালবাসে তা কি একবার ভেবে দেখেছো। মানুষের অগণিত ঘৃণা আর পাপের কালিমা বহন করে কাটছে তোমার প্রতিটি দিন। যেহেতু এই গ্রাম তোমার আমার জীবনের শিকড়। আমাকে কেন্দ্র করে আমার পরিবারের যে আশা আকাঙ্খা তাদের অবমূল্যায়ন করে আমি কি করে তোমাকে গ্রহণ করবো?

এই গ্রামে তুমি যাদের হৃদয়ে আঘাত করেছো, ঝরিয়েছো চোখের পানি, তুমি কি এতো সহজে পারবে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে। আজ তোমার বোধশক্তি জাগ্রত হয়েছে, তুমি সুপথে ফিরে আসতে চাও আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। তবে হঠাৎ যদি বনের ভিতর থেকে কোন অজানা ফুল গোলাপের মতো সৌরভ বিলায় তাকে কি সহজে কেউ গোলাপ হিসাবে মেনে নিতে পারবে। তা যে অনেক ভাবনা চিন্তার বিষয়। সালমা মনে মনে বলে আমি তো জানি তোমার অতীত ইতিহাস। পবিত্র প্রেমের জালে আটকে কত মেয়ের সাথে করেছো নিষ্ঠুর আচরণ। সালমার মুখ থেকে এই ধরণের বেদনাদাযক কথা-বার্তা শোনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে হৃদয়। মনে মনে ভাবে সালমার চিত্ত জয় করা তার পক্ষে সহজে সম্ভব নয়। তাই একদিন সে সালমাকে অপহরণ করে বিবাহ করার সিন্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা মতো কলেজ থেকে ফিরার পথে সে সালমাকে অপহরণ করতে চায়। তিনজন বন্ধু মিলে জোর করে একটি ট্যাক্সিতে তুলতে চাইলে সালমা জোরে চিৎকার দিলে আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে।

অপহরণে ব্যর্থ হলে সে সালমাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। সে দৃশ্য অতি কাছ থেকে অবলোকন করে এই গল্পের নায়িকা বেদের মেয়ে স্বর্ণা। স্বর্ণা গ্রামের পার্শ্ববর্তী নদীর ধারে ঝুপড়ির মধ্যে বসবাস করত। সে অত্র স্থানে অনেকদিন থাকার সুবাধে সালমা ও হৃদয়কে ভালভাবে চিনতো। সালমাকে অপহরণের কারণে সালমা বাদী হয়ে আদালতে মামলা করে। আসামী হয় হৃদয়। হৃদয় এই মামলা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য উকিলের পরামর্শ মোতাবেক স্বর্ণাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। সে একদিন স্বর্ণার কাছে গিয়ে বলে-স্বর্ণা তুমি এই মামলার রাজ স্বাক্ষী এই নাও ২০ হাজার টাকা। তুমি আমার কথা মতো আদালতে গিয়ে বলবে আমি সালমাকে ছুরিকাঘাত করিনি। স্বর্ণা মনে মনে ভাবে এইতো সুবর্ণ সুযোগ অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার। সে টাকা হাতে নিয়ে তাকে বিদায় দেয়, আর বলে আমি আদালতে গিয়ে তোমার কথা মতো বলব। আসামী পুরোপুরি নিশ্চিত যে, তার শাস্তি হবে না। তারিখ মতো স্বর্ণা আদালতে হাজির হয়। উকিলের জেরা মোতাবেক স্বর্ণা সঠিকভাবে স্বাক্ষী দিয়ে হৃদয়কে আসামী হিসেবে আদালতে সনাক্ত করে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে হৃদয়ের মাথার উপর। একি করল মেয়েটি। উকিল সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন সম্পূর্ণ মামলা যেন গুড়েবালি। তিনি মেয়েটিকে ছোট লোক বলে গালি দিলেন।

আর বললেন কত টাকা পেয়েছো বাদীর নিকট থেকে বলে অপমান করলেন। মেয়েটি বলল বাবুজি এক ভিন্ন সমাজ থেকে এসেছি আমি যেখানে এই ধরণের পরিস্থিতির কারণে আজ পর্যন্ত বিচারের জন্য আমাদেরকে খুব একটা আইন আদালত ঘাটাতে হয় না। সীমাবদ্ধ আশা আকাঙ্খার মধ্যে কাটে আমাদের জীবন যাপন। আমাদের বিচার ব্যবস্থা, আমাদের নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সামান্য কোন ঝগড়া-ঝাটি হলে আমাদের সর্দারই তা সমাধান করে দেন। আজ যখন পরিস্থিতি বাধ্য করেছে আমাকে এখানে আসার তাই ভাবলাম একটি স্বাক্ষী দিয়ে আপনাদের সমাজে একটি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করে যাই। এই মামলায় হৃদয় আমাকে বিশ হাজার টাকা দিয়েছে। আমি তার কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা নিয়েছি। আমার নিকট তার দেওয়া টাকা আমি প্রথমে আদালতের কাছে জমা রাখতে চাই। পরবর্তীতে আমার বক্তব্য হল আমি যদি এই টাকা না রাখতাম তাহলে হৃদয়ের মনে দুর্বলতা থাকত এবং সে পলাতক থাকত। সে ভাবত এই মামলা থেকে সে বাঁচতে পারবে না। তাই আমার ধারণা আদালত অতি সহজে তাকে আজ উপস্থিত পেত না। বাবুজি আপনার এই বড় বড় বইয়ে কি লিখা আছে তা জানি না। আমি এত কথার মারপ্যাঁচও বুঝিনা। শুধু জানি একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর প্রতি যে কেউ অন্যায় ও জুলুম করলে তা আমার শক্তি সাহস ও জ্ঞান দিয়ে প্রতিবাদ করবো। বাঁচতে হলে টাকার প্রয়োজন ঠিকই। তাই জীবন নির্বাহের স্বার্থে অনেক সময় সত্য মিথ্যা একাকার করে মানুষকে ভুলিয়ে এমনকি কিছু প্রতারণা করে টাকা রোজগার করি ঠিক, কিন্ত তারও একটি সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষের উপকার না হোক কিন্ত জীবনের মারাত্মক কোন ক্ষতি হোক এমন কোন কাজ করি না।

আমাদের কথায় মানুষের মনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আসলে ঝাঁড় ফুকের বিনিময়ে খুশি হয়ে কেউ কিছু টাকা পয়সা দেয়, তাতো খুব সীমিত। কিন্ত তারও একটি ক্ষেত্র আছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এমন কি যেখানে মানুষ তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এমন কোন কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা সৃষ্টিকর্তাতো একজন আছেন। পরকালে তার দরবারে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। উকিল সাহেব আপনি আমাকে ছোট লোক বলে গালি দিয়াছেন। আপনি একজন আইনের লোক আপনার একজন মক্কেলকে বাঁচানো আপনার পেশাগত দায়িত্ব। আমি শুনেছি আপনি একজন এই শহরের নামী দামী উকিল। বেশ সুনাম ও প্রভাব প্রতিপত্তি আছে আপনার। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, আজ যদি সালমার স্থলে আপনার কোন মেয়ে বা ভগ্নি হতো আর সেখানে যদি আমি আপনার মামলার স্বাক্ষী হতাম তাহলে কেউ আমাকে এইভাবে ছোট লোক বললে আপনি নিশ্চয় প্রতিবাদ করতেন। উকিল সাহেব মেয়েটির কথা শোনে লজ্জায় মাথা নিচু করেন। স্বর্ণা বলে আমি যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে এই মামলায় অপরাধীকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। আপনি যদি একবার তাকে বলতেন তুমি যে, জঘন্য কাজ করিয়াছো আমি তোমাকে  খুব ঘৃণা করি। আপনার এই মৌন ঘৃণাটুকু অপরাধীকে তার অপরাধ প্রবণতা থেকে কিছুটা হলেও নিবৃত রাখত। অপরাধীর মনে অনুশোচনা জাগ্রত হত। শাস্তির ভয়ে অনেকে অপরাধ থেকে দূরে থাকত। আপনি তো একজন আর্থিকভাবে পুরোপুরি স্ব”ছল। দামি দামি সিগারেটের ধোঁয়ায় যে অর্থ ব্যয় হয় তা খরছ না করে এই ধরণের হীন মামলা হাতে না নিতেও পারতেন।

উকিল সাহেব অসৎ আনন্দের চেয়ে পবিত্র বেদনাই মহৎ। স্বর্ণা আদালত থেকে বের হয়ে সোজা চলে যায় এক অজানা গন্তব্যের দিকে। স্বর্ণা তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য আর কোনদিন ফিরে আসবে না আমাদের এই সমাজে। স্বর্ণা লোভ ও স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে একটি পক্ষপাতহীন সুন্দর বিচার উপহার দিয়ে অগণিত পাঠকের মনের মুকুরে বেঁচে থাকবে চিরকাল এই গল্পের মাধ্যমে।


গ্রাম: চান্দাই পশ্চিম পাড়া

উপজেলা: দক্ষিণ সুরমা, জেলা: সিলেট।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট