গল্প- প্রতিজ্ঞা



প্রতিজ্ঞা
জিন্নিয়া সুলতানা

আপনার কি কি প্রশ্ন আছে বলতে পারেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি প্রস্তুত আছি- এক শ্বাসে বলে গেলো উর্মি।
সুনীল মিটমিটিয়ে হাসছে শুধু।
তা দেখে উর্মির খুব রাগ হচ্ছে,কিন্তু সে রাগটা প্রকাশ করলো না।
কারণ সে জেনেশুনেই এসেছে এখানে।যে আচরণ ই করা হোক তার সাথে, সে চুপ করে মেনে নেবে।

কি দেখছেন এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে?- উর্মি অবাক হওয়ার ভাব ধরে বললো।
- দেখার জন্যেই তো এসেছি, দেখতে দেবেন না? সুনীল এখনো সেই মিটমিটিয়ে হাসছে।
- আচ্ছা দেখেন,কিন্তু দেখা শেষ হলে বলবেন।
- হ্যাঁ বলবো, আপনি জানতে চান না আমি কি দেখছিলাম?এটা দেখছিলাম যে হেরে যাওয়া মানুষ গুলি দেখতে কেমন হয়।
- সরি! আপনি কি বুঝালেন আমি ঠিক বুঝলাম না।এবার উর্মি সত্যি অবাক হয়ে গেল।
- আপনি উর্মিলা খান, পড়াশুনা শেষ করে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করা ছিল আপনার এম্বিশন। কিন্তু আর দশটা মেয়ের মতোন আপনিও শেষমেশ পুতুলের মতো বিয়ের পাত্রী হয়ে আমার সামনে বসে আছেন।নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সব রকম অপ্রস্তুত প্রশ্নের জবাব দিতে।
- হু,এতে তো আর দশটা ছেলের মতোন আপনিও খুশি হওয়ার কথা।
- তাই দেখছিলাম ,একটা মানুষ কত সহজে নিজের স্বপ্ন থেকে সরে আসতে পারে, কত সহজে হেরে যায়।
- সুনীল সাহেব,আপনি কি আমাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে এসেছেন?আমি কিন্তু এখন সত্যিই বিরক্ত হচ্ছি।
বলে দিলেই পারেন যে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি।
- না উর্মিলা, আপনি দেখতে অনেক সুন্দর, স্মার্ট শিক্ষিত, কথাও বলেন সুন্দর।
আপনাকে অপছন্দ করার মতোন কোনো সুযোগ নেই।
- তাহলে আমি কি বাবাকে বলে দিতে পারি আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে, বিয়ের ব্যবস্থা করতে?
- না,বলতে পারেন না। কারণ আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।
- মানে? - উর্মি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।
- আরে এত রাগ করছেন কেন?বসেন বসেন। আমি তো এখনো পুরো কথা বলেই শেষ করিনি, - সুনীল আবার হাসতে লাগলো।
- আমার মনে হয় না আপনার সাথে আমার আর কোনো কথা বলার দরকার।
-কিন্তু আমার মনে হয়,আমার মনে হয় আপনার সাথে আমার অনেক কথা বলার দরকার।
- সুনীল সাহেব,আপনি হেয়ালিপনা না করে ঠিক কি বলতে চান পরিষ্কার করে বলেন প্লিজ।
- আমি চাইনা আপনি এখন ই বিয়ে করে নেন, সেটা আমি হই অথবা অন্য কেউ হোক।
- তাহলে আমি কি করবো? আর আপনি কেন চান না? বুঝলাম না।
- কেন চাইনা সেটা না হয় অন্যদিন বলি?
এখন যা বলার দরকার তাই বলছি শুনুন।
আপনি বিয়ে করবেন অবশ্যই,তবে এখন ই নয়, চাকরী পাওয়ার পর, নিজের একটা আলাদা পরিচয় পাওয়ার পর।
আর সেই চাকরী টা আমি দেবো।
- আপনি আমায় নিয়ে মজা করছেন? নাকি করুণা?নাকি অন্য কোনো কিছু? কোনো ডিল?
- এসবের কোনো কিছুই করছিনা আমি উর্মিলা।কিন্তু আমি মন থেকে চাই আপনি একটা ভালো চাকরী করে নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করেন,যাতে সারা জীবন আপনাকে বাবা স্বামী বা ছেলের পরিচয় পরিচিত হতে না হয়।
এটাই তো আপনার সপ্ন তাই না?
- হ্যাঁ।
- ঠিক আছে। আমি আপনাকে সময় দিলাম , বাসায় গিয়ে নিজের সাথে বুঝাপড়া করে নেন।যদি মনে করেন যে আমার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল,তাহলে আমাকে কল করবেন। নাম্বার আপনার বাবার কাছে আছে।
উর্মিলা সারা রাত ধরে চিন্তা করে ঠিক করলো সে সুনীলের কথায় রাজি হয় যাবে,যদি সুনীল এটা থেকে কোনো সুযোগ নিতে না চায়।
এটা করা ছাড়া নিজের জন্যে তার কাছে আর কোনো অপশন নাই।
উর্মিলা আর সুনীল একটা ক্যাফে তে সামনা সামনি বসে আছে।
উর্মিলা ই প্রথম বলে উঠলো,
- আমি আপনার গল্পটা শুনতে চাই।
- গল্প? - সুনীলের চোঁখে মুখে অবাক হওয়ার স্পষ্ট ছাপ।
- হ্যাঁ গল্প, এসবের অন্তরালে যে গল্পটা রয়ে গেছে আমি তাই শুনতে চাই।
- উর্মিলা আপনি সত্যিই অনেক বুদ্ধিমতী, যতটা সবাই জানে তার চেয়েও বেশি।
সবাই যা বুঝতেই পারে না আপনি তা খুঁজে বের করতে পারেন।
- আচ্ছা,আমার প্রশংসা না হয় পরে শুনি?
সুনীল চেঁয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো,
গুধুলির আলো ছায়ায় এখানে পরিবেশটা অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে, দু তলা ভবনের খোলা ছাদের উপর ক্যাফে।
সুনীল ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার অনেক দূরে, যে আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
আপনি তাহলে শুনতে চান আমার গল্প।
গল্পটা ছিল এরকম,
অনেক দিন আগে এরকম ভাবে আমি একটি সূর্য ডুবতে দেখেছি।
যাকে আর কখনো উদিত হতে দেখা যায় নি।
নাহ্, ওটা মোটেও আকাশের সূর্য ছিল না।
সূর্যটা ছিল আমাদের পরিবারের।
পরিবারের একমাত্র মধ্যমনি ছিল আমার বড় বোন ইলা।
পরিবারের অন্য সদস্যদের ভালো থাকার জন্যে সেই ছিল যথেষ্ট।
আপনি জানেন আমরা তিন ভাই।
কিন্তু তখন আমরা ছিলাম ভাইবোন মিলে চার জন।
বাবার অল্প বেতনের ছোট চাকরিতেই আমাদের সংসার বেশ চলে যেত।
মা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও ইলা আপুই আমাকে কুলে পিঠে করে মানুষ করেছে।
মজার কথা কি জানেন?
ইলা আপু আমার চেয়ে ৮ বছরের বড় হলেও সে আমাকে ভাইয় বলে ডাকতো।
ছোট বেলা থেকেই দেখে এসেছি সে একাই কিভাবে সংসার সামাল দিতে পারে।
এজন্যে মা বাবা তাকে নিয়ে অনেক বেশি গর্ববোধ করত।
তখনো আমি বাস্তবিক অর্থে অনেক ছোট, বাস্তবতার কিছুই বুঝিনা।

একদিন আপু আমার কাছে এসে বলল-  ভাইয়া আমি রুদ্রকে ভালবাসি। তুই কি মা বাবা কে রাজি করাতে পারবি?
রুদ্র ভাইয়াকে আমি চিনতাম। বাবার অফিসেই ভালো একটা পোষ্টে কাজ করতো।
মাঝে মাঝেই বাসায় আসত বাবার সাথে।
তাই বাবা মাকে রাজি করাতে আমার তেমন কষ্ট হয়নি।
দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়েটা হয়ে গেল সহজেই।
সে জন্যে আপু অনেক খুশি হলেও আমার এখনো মনে পড়বে, বিদায় বেলায় আপু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনেক বেশি কেদেছিল।
সব কিছু ঠিক ভাবেই চলছিল, কিন্তু এক বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন খবর এলো আপু আর নেই।
আমার মনে হলো আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে।
আমি যখন আপুর নিথর দেহের পাশে দাঁড়ানো, হঠাৎ মনে হল আপুর শক্ত হয়ে যাওয়া হাতের মুঠোয় কিছু একটা আছে।
হাতের মুঠো খুলে দেখলাম একটা ছোট্ট কাগজ।
হাতে নিয়ে দেখি আমাকে লিখা তার শেষ চিরকুট।
আমার আদরের ভাইয়া,
আমি তোদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোদের কে কিছু বলার মতোন মুখ আমার নেই। তবে আমার মত যেন আর কাউকে এভাবে অসময়ে চলে যেতে না হয়, যাওয়ার বেলায় আমার একটাই চাওয়া তোর কাছে।
-তোর ইলা আপু
আপনার জানতে ইচ্ছে করছে না?
কেন কিভাবে আমার বোন মরে গেলো!
হ্যাঁ, ইলা আপু আত্মহত্যা করেছিল।
আমি অথবা আমাদের পরিবারের অন্য কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ওই পরিবারে আমার বোনকে কী অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
প্রতিনিয়ত তার শ্বশুড় বাড়ির লোক মানুষিক ও শারীরিক ভাবে তাকে অত্যাচার করেছে সে বিয়ের সময় বা বিয়ের পর কোনো যৌতুক নিতে পারে নি বলে।
অথচ আমাদের কষ্ট হবে বলে সে কিছুই জানায় নি।
ওদিকে আপু বেশি পড়াশুনা করতে পারেনি,তাই তার নিজেকে সাপোর্ট দেয়ার মতন কোনো শক্তি ছিল না।
আর আমাদের পরিবার ও তখন তেমন একটা সচ্ছল ছিল না যে তাকে অবিরত যৌতুক দিতে পারবে।
তাই আপু আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে নিজেই সব কিছু ছেড়ে চলে যায়।
সেদিন থেকেই প্রতিজ্ঞা করি, অন্তত একটা মেয়েকে হলেও তার নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করতে সাহায্য করবো, যাতে আর কারো জীবন আমার বোনের মতোন না হয়।
আজকে দেখেন আমার বাড়ি গাড়ি সব আছে।
দুই ভাই বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা করছে।
অথচ আমাদের মাঝে আমার ইলা আপু নেই।
সারাক্ষণ এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আমি আমার মায়ের মতন বোনকে বাঁচাতে পারিনি।
কাঁধে কারো হাত পড়তেই সুনীল ফিরে তাকিয়ে দেখলো উর্মিলা অশ্রুসজল চোঁখে তার পাশে দাঁড়িয়েছে।
সুনীলের মনে হল অনেক দিন পর ইলা আপুর মতোন অসম্ভব মায়া ভরা চোখে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট