রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ
(গত সংখ্যার পর)
মেয়েটা তখন দিশেহারা হয়ে সোজা না যেয়ে হাতের বাঁ পাশে এমপি মহোদয়ের ভাতিজা মকবুল আহাম্মদের একান্ত সহযোগি শাহিন আলম ওরফে ঠেরা শাহিনের ওয়ার্কশপে আশ্রয় নেয়। ঠেরা শাহিন তখন তার শালা কাদেরকে নিয়ে লোডশেডিংয়ের কারণে অবসর সময় পেয়ে মেশিনের নানা যন্ত্রপাতি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করছিলো। ঠিক এ-সময় ওয়ার্কশপের গেইটের কাছে একটা শব্দ হয়। দুজনেই উঠে গিয়ে দেখে আট-নয় বছরের একটি মেয়ে তাদের গেইটের ভেতরে ঢুকে কুকুরের ভয়ে জবুথুবু হয়ে কাঁপছে। তারপরের ঘটনা আমরা কল্পনায় আনতে পারি না। কেবল কান্না শুনতে পাই। শহরের কান্না। স্বাধীনতার কান্না। স্মৃতিসৌধের কান্না। ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’—এমন একটা কান্নার স্বর শহরের গলি-ঘুঁজিতে ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় কান্নাটাকে থেমে আসতে হয়। তখন আমাদের কাছে মনে হয়, মেয়েটার লাশ পড়ে আছে শীতলক্ষ্যার তীরে শাদা কাশ বনের ভেতর, কখনো মনে হয় ম্যানহোলের ভেতর দিয়ে ময়লা-আবর্জনার সাথে ভেসে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গার দিকে কিংবা তার লাশ ফোর কালারের ছবি হয়ে বেরিয়ে আসছে পত্রিকার পাতায়।
কল্পনার দৃশ্য কল্পনাতেই মিশে যায়। কোথাও হদিশ মেলে না মেয়েটার। অন্যদিকে আমাদের কল্পনার জোরও এক সময় কমে আসে, তখন একদিন শুনি বোবা বাতাসের কণ্ঠ খুলে গেছে। জুলাইয়ের সাতাশ তারিখ রাত সাড়ে বারো কি একটার দিকে ওয়ার্কশপের ভেতর ঠেরা শাহিন আর তার শালা কাদেরের মাঝে টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে কাদেরের মুখ থেকে একটা গোপন কথা বন্দুকের গুলি হয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। যার আওয়াজে দুজনেই হতবাক। দুজনেই সতর্ক দৃষ্টি মেলে এদিক-ওদিক তাকায়। না, কেউ নেই। এতো রাতে আশেপাশে কেউ থাকার নয়। পরিবেশ নিরাপদ পেয়ে দুজনেই তওবা কাটে। জীবন থাকতে আর কোনোদিন এমন বোকামো করবে না। কিন্তু বাতাস? বাতাস বসে থাকে না। জীবনে এই প্রথম কণ্ঠে কথার অনুরণন পেয়ে নাচতে থাকে। তাক ধিনা ধিন করতে করতে মুন্সি বাড়ির মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে সোহেলের রুমে গিয়ে হুচুট খেয়ে পড়ে। যদিও সোহেল তখন ইডেন মহিলা কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার ঝিনুকের সাথে মেসেঞ্জারে চেটিং করছিলো, ...ফাইনালের জন্যে টিকেট কাটবো কি?...মিরপুর স্টেডিয়ামে...অপু বলেছে তার সাথে জান্নাতও নাকি যাবে... তারপর শেফু আপার কথা বলো, ক্যামু দেয়ার কথা ছিলো, ডাক্তার কী বলে? চলবে কি, নাকি এ যাত্রাই...জানো, শাদা বেডে আপাকে নিথর-স্তব্ধ অবস্থায় দেখার পর থেকেই ভেতরটা যেনো কেমন করতে শুরু করে দিয়েছে...মাসুদ ভাইয়া কোথায়? সরকার কিন্তু পাগল হইয়া গেছে, বইললো একটু সাবধানে থাকতে...বিকেলে অনিতার সাথে দেখা...ওদের বাসার নিচতলার খোরলটায় নাকি সাপ ঢুকেছে, শুনেছো কিছু?...তা অবশ্য ঠিক বলেছো, সারাদেশেই...গতকাল তো স্টেডিয়ামেও একটা ঢুকে পড়েছিলো, ক্যামেরায় ধরা পড়লো বলেই না রক্ষা...এই একটা পিক দাও না...উঁ হুঁ এটা নয়, বুকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না...এভাবেই স্বাভাবিক কথাবার্তা শেষ করে ওরা যখন ক্রমশ অর্গাজমের দিকে এগুচ্ছিলো, ঠিক তখনই কাদেরের মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া গুলিটা তার কানে গিয়ে শট করে। সঙ্গে সঙ্গে তার কান ফেটে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। তারপর কী ব্যাথা! সে-রাতে এক ফোটাও ঘুমুতে পারেনি। সকাল হতেই বিষয়টা পারুলের বাপ আবদুল করিমকে জানায়। তারপর ঘটনাটা কী হতে পারে, সহজেই অনুমেয়।
আবদুল করিম কসাই না হলেও কসাইয়ের সহযোগী। প্রতিদিন গরু-ছাগলের গলা কাটতে কাটতে তার মন তো এমনিতেই পাথরের মতো শক্ত, তার উপর মেয়ে হারানোর শোক। সব মিলিয়ে আমাদের কাছে বিষয়টা বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো মনে হলো। আড়াই হাত লম্বা ছুরি হাতে তেড়ে যাচ্ছে সর্বহারা নায়ক আর জান বাঁচাতে মহল্লার অলি-গলি দিয়ে পালাচ্ছে কুখ্যাত ভিলেন গোষ্ঠি। দৃশ্যটা পূরবী কিংবা প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হলে আমরা হাততালি দিয়ে নিজেদের ক্ষোভ-উত্তেজনাকে প্রশমিত করতাম। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। পেছনে আইনের কালো অক্ষরগুলো দাঁড়ানো। যদিও এসব অক্ষর ভগবান-ভগবতিদের দেখলে তাবিজ দেখা সাপের মতো ফণা গুটিয়ে থাকে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃশ্য। আমাদের কোথাও উনিশ-বিশ হলে সাথে সাথে উদ্যত ফণায় ছোবল মারতে মহূর্ত সময় নেবে না। সে ভয়েই আমরা আবদুল করিমকে আধ-পথে থামিয়ে দিলাম। বললাম, ক্ষ্যামা দাও করিম ভাই। আজাইরা মাথা গরম করো না। যে গেছে, গেছেই। সে আর ফিইরা আইবো না। এখন একজনের লাগি পরিবারের সবাইরে হারাইবার চাও নাকি? অপর দিকে মোয়াজ্জেম হোসেন আগ-পাছ না ভেবে তার ছেলে সোহেলকে বকাবকি শুরু করে দিলো। যে কারণে সোহেলের জীবনটা একটা হুমকির মধ্যে পড়ে।
তখন উভয় কূল রক্ষা করতেই আমাদের কেউ হয়তো থানায় গিয়ে মামলা করার জন্য আবদুল করিমকে পরামর্শ দেয়। কিন্তু আবদুল করিম থানায় যায় না। ভয় পায়। পুলিশ-উকিল-হাকিম এসব নাম শুনলেই নাকি তার ডর লাগে। বলে, আমি মুকখো মানুষ। তানিদের লগে কীভা কথা কইতে হয়, আমি তো কোনো ভাও খুঁইজা পাই না। টেহা-পয়সারও কাজ-কারবার। কত জানি লাগে— ইতস্তত করতে থাকে সে। তখন ভিড়ের ভেতর আরেকজন বলে ওঠে, করিম ভাই, বাদ দেও এইসব। তুমি গরিব মানুষ। দেন-দরবার বা মামলা-মুকদ্দমা কইরা তলা খুঁইজা পাইবা না। এইসব বড় লোকদের কাজ-কারবার। দুনিয়াডা তোমার-আমার লাগি না। আমাদের লাগি পরকাল। সেখানে আল্লা নিশ্চয়ই তাদের বিচার করবে। এখন আল্লার মাল আল্লা নিয়া গেছে। এই মনে কইরা চুপ মাইরা থাকো।
বস্তির শেষ মাথায় আবদুল করিমের ডেরার সামনে দাঁড়িয়ে মহল্লা বাসিরা যখন এসব বলাবলি করছিলো, ঠিক তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিলো, যান্ত্রিক শহরের সবকটা তার বুঝি গিটারের মতো একসঙ্গে হেসে ওঠেছে। আমি তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছুই দেখতে না পেয়ে আবার যখন তাদের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছি, এমন সময় আবার হাসির শব্দ। তখন আমার কিছুটা ভয় হয়। ভয়ে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন কাঁপতে থাকি। তখন কী আর করা। বাসায় ফিরে নিজের অক্ষমতা চিবুই। তবে একবার ইচ্ছে হয়েছিলো, রেণু বলি। আরিফদেরকে ডাক দিই। আর কিছু না হোক একটা মানববন্ধন তো করতে পারি। পরে মনে হলো, সবটাই অরণ্যে রোদন হবে। কিছুলোক জড়ো হবে বটে, হয়তো কজন সাংবাদিকও ক্যামেরা উঁচিয়ে আসবে। রিপোর্টও হবে। রাস্তার শান্তি রক্ষার্থে ছুটে আসবে পুলিশও। তারপর তোতা পাখির মতো কিছু মুখস্থ কথা বলেই সবাইকে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করবে। কিছু হবে তো দূরের কথা, আমাদের চিৎকার-নড়াচড়া পুলিশ থানায় যাওয়ার আগেই হাওয়ায় উড়ে যাবে, যেভাবে নদীর এপারের ঢেউ ওপারে পৌঁছার আগেই মিশে যায়।
এসব ভেবে একবারে চুপ হয়ে গেলাম। ধরি মাছ না ছুই পানি’র মতো প্রগতি দেখাতে মাঝে মাঝে পার্টির অফিসে যাই। টুকটাক কথা বলি। সবশেষে আগামিদিনের কিছু করণীয় বুঝে নিয়ে চলে আসি। বাকি সময় ফেসবুক-টিভি-পত্রিকায় খরচা হয়। বই-টই ইদানিং পড়তে ভালো লাগে না। মনে হয়, পৃথিবীর কোনো লেখাই আমাদের উপযোগী নয়। বাঙালির চরিত্রের কাছে এসে যেনো সব মার খেয়ে বসে আছে। কি দর্শন কি সাহিত্য কি ইতিহাস। কোনো কিছুই যেনো এখানে এসে হালে পানি পাচ্ছে না। দর্শন-সাহিত্য মাঝে-মধ্যে চিড়িক দিয়ে উঠলেও ইতিহাস একেবারেই নিষ্প্রভ। যার লেখাই পড়েছি, মনে হয়েছে মধ্যযুগের দোভাষী পুঁথি বুঝি। অলৌকিকতার ভোঁস ভোঁস ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।
আমার মতো সবাই চুপ থাকলেও মৃত্যুদানব বসে থাকে না। মঞ্চে যমবাড়ির দৃশ্যের মতো পুরো মহল্লা কালচে-নীল আলোয় ঢেকে যায়। জমাবদ্ধ কালো রঙের ছোপের মতো কী যেনো মহল্লার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পায়চারি করে। কেউ বলে, এগুলো অক্টোপাস। দেখো না কীভাবে আট পা ছড়িয়ে পিল পিল করে বিল্ডিংএর দেয়াল থেকে দেয়ালে বিচরণ করে। কেউ বলে, অক্টোপাস নয়, শিলপাঞ্জি। যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দেয়াল টপকায়, তা কিছুতেই অক্টোপাস হতে পারে না। এক মাওলানা শোনায় ভিন্ন কথা, এগুলান শিলপাঞ্জি-বান্দর-ভাল্লুক কিছুই না, এগুলান হইছে গিয়া ইজুজ-মাজুজ। আমি তো দেখতাছি, শুধু দেয়াল টপকাইতাছে না, জিবলা দিয়া লেইতাছেও। আমার তখন কী হয় বুঝতে পারি না। দেখি আমাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। কোথাও খুঁজে পাই না। অন্তর্বাসের ভেতর বুকের বল্কলে, নাভীর নিচে, বার্থরুমের বড় আয়নায়, ড্রেসিং ট্রেবিলের সামনে, কিচেনের কৌটায় কৌটায়, বিছানায়, ভেন্টিলেটরের ফাঁক-ফোকরে, সোহাস-রেণুর সঙ্গমদৃশ্য দর্শনের লোভে ঝুলবারান্দায় রেলিং ধরে একঠাঁই দাঁড়ানো, কোথাও না। তখন পরিচিত গ-ি পেরিয়ে আমি বটতলার ওরশে ছুটি। সেখানে আবুল চাচা বায়স্কোপ দেখায়। মুখে গান আর হাত-চটির চেট্টর চেট্টর ছন্দে দর্শক ভেড়ানো চেষ্টা চালায়, কিন্তু দর্শক আসে না। তারা মজা পায় না। এন্ড্রোয়েড মোবাইল যুগে কাঠবাক্সের ভেতর পোস্টার দেখার সময় নাই তাদের। আমি আমাকে খুঁজতে বায়স্কোপের গোল আয়নায় চোখ রাখি। তখনই আবুল চাচা খুশিতে তার চিরাচরিত নতৃনামা শুরু করে দেয়। তখনই দেখি শাদা কাপড়ে আঁকা দৃশ্যগুলো সিনেমার রিলের ছবির মতো সব জীবন্ত হয়ে ওঠছে। দেখি শি জিন পিং এক অলীক পার্লামেন্টকে চাষ করে আজীবন প্রেসিডেন্ট হয়ে যায়, পুতিনের মিরমিরা হাসিই বলে দিচ্ছে মৃত্যুর আগে অবসরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, মিয়ানমারের অলৌকিক শক্তি, মহাসাগর থেকে বাতাসের জাহাজ বেয়ে আসে তামিল-আর্তনাদ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলদের দানবীয় পদশব্দ—এসব দেখতে দেখতে কখন যেনো আমার কথা ভুলে যাই। তখন কেবলি ঘুম। আমি ঘুমাই। একসময় ভোর হয়। শহরের পিঠে রোদের ফিসফিস কথা। দরজা খুলে বাইরে পা রাখতে যাই, তখনই দেখি, আমি একটা দুঃসংবাদ নিয়ে ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে...অনুমান নির্ভর প্রাণিরা অদৃশ্য ইঙ্গিতে তথ্য-প্রযুক্তির যান্ত্রিক মেশিনের মতো হুকুম তামিল করে গেছে। মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে সোহেলকে খুন করে চিতা ঘাটের নামায় ফেলে রেখে গেছে। ঘুম থেকে ওঠেই দুঃসংবাদটা শুনতে হলো। মনে হলো, এই বুঝি গান্ধি জী’র চরকার মতো ঘুরতে ঘুরতে পড়ে যাবো। নিজেকে কোনো রকম সংযত রেখে ভাবতে লাগলাম, কে করে থাকবে কাজটা। আমার জানামতে তার তো কোনো শত্রু থাকার কথা নয়। সে কারোর কাঁচা আইলে পা দিয়েছে, এমন কথাও শুনিনি কোনোদিন। মাথার মগজ তখন কাজ করে না। দৌড়ে যাই নদীর পাড়। গিয়ে দেখি চিতা ঘাটের নামায় মাথাবিহিন একটা লাশ পড়ে আছে। মাথা না থাকলে কার লাশ, চেনা বড় দায়। কিন্তু বাইশ আঙুলি লোকের লাশ চিনতে কারোর কষ্ট হওয়ার কথা নয়। মোয়াজ্জেম হোসেনেরও কষ্ট হয়নি। তার সাথে যোগ হয়েছে লাশের পরনের জামা-কাপড়। বিশেষ করে বাঘ কালারের গেঞ্জিটা। দুদিন আগে ওয়েস্ট-ইন্ডিজের সাথে বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজ খেলা দেখতে গিয়ে ছিলো মিরপুর স্টেডিয়ামে। তখনই স্টেডিয়ামের আউট-সাইড থেকে গেঞ্জিটা কিনেছিলো সোহেল। আমরা তখন লাশটাকে খুঁটে খুঁটে দেখতে থাকি। তখনই ধরা পড়ে, কোপের ধরনটা বাম হাতের কাজ। আর আমাদের মহল্লায় কে যে বাওয়া একটা দুধের বাচ্চাকেও জিজ্ঞেস করলে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দেবে। এখন কী করা যায়? বিষয়টা ভাবতে ভাবতেই খবর পেয়ে পুলিশ চলে আসে। আমরা তখন পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, এটা বাম হাতের কাজ। আমরা এর বিচার চাই। বাওয়াখুনি’র ফাঁসি চাই।
(চলব)