অনন্য এক শব্দচাষী
নির্মলেন্দু গুণ
ইসরাফিল আকন্দ রুদ্র
বাংলা সাহিত্যের কাব্যে যার অতুলনীয় অবদান, কাব্যের ভুবন, কবিদের কবি নির্মলেন্দু গুণ। যার ভাবনায় গড়ে উঠেছে নতুন এক কাব্যজগত। লোকের মুখে মুখে যার কবিতা শোনা যায়, মুঠোফোনে টিউন হিসেবে তাঁর কবিতা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে (কিন্তু রয়্যালটি পায় না তিনি; কবি মূখ্যপুঞ্জি আর বিভিন্ন টকশোতে তা বলেছেন), জন্মদিনে যাকে জানানো হয় কয়েক গন্ডা ফুলেল শ্রদ্ধা সেই নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর কোনো বিশেষণের প্রয়োজন নেই। তিনি কবি, চিত্রশিল্পী অভিনেতাও বটে।
‘আমি বলছিনা ভালবাসতেই হবে’ কবিতাটি প্রেমের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। ‘মানুষ’, ‘হুলিয়া’ তাঁর অমর সৃষ্টি। ‘স্বাধীনতা এ শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো?’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ। তা জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর নবম-দশম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্যের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কালজয়ী কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য ও ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছেন শান্তিনিকেতন। তেমনি নির্মলেন্দু গুণ গড়েছেন ‘কবিতাকুঞ্জ’। সমস্তটা তাঁর স্বাধীনতা পুরস্কার এর প্রাপ্ত অর্থায়নে। তাঁর ভাবনা পৃথিবীর সকল বিখ্যাত কবিদের বই থাকবে সেখানে। তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার দেবার জন্য জোড় দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এর যোগ্য বিধায় আমি দাবি জানিয়েছি। সত্যিই ওনি তাঁর যোগ্য। যেন সুপাত্রে কন্যা দান।
অনেকে যা পারেনা নির্মলেন্দু গুণ সেটি করে দেখিয়েছেন। কবিতার জন্য কাটিয়েছেন ইচ্ছাধীন জীবন । তিনি বিশ্বাস করতেন না যে কবি হওয়া যায়। বড় কবিদের নামের পাশে তাঁর নাম বসবে এমনটা ভাবেনি। প্রথম দিকে গ্রাম্য কবিদের কবিতা সংগ্রহ করতো। তিনি বলেছেন, ‘আমি কবি হতে চাইনি, বরং চেষ্টা করেছি কবি না হওয়ার।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ১৯৪৫ সালের ২১ শে জুন (বাংলা ৭ আষাঢ় ১৩৫২) নেত্রকোনার বারহাটা উপজেলার কাশবন গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর ছেলেবেলা কাটে নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলায়। বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ এবং মা বিনাপানি । বাবা-মার তিন মেয়ে এবং দুই ছেলের মধ্যে নির্মলেন্দু ছোট ছেলে। চার বছর বয়সে মার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা আবার বিয়ে করেন চারুবালাকে। তাঁর একমাত্র কন্যা- মৃত্তিকা গুণ।
প্রথমে মা চারুবালার কাছেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় তাঁর। এরপর তিনি বারহাট্টার করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউটে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। দুই বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পান ১৯৬২ সালে৷ । মেট্রিক পরীক্ষার আগেই নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’৷
মেট্রিকের পর আই.এস.সি পড়তে চলে আসেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে৷ আনন্দ মোহন কলেজ ভাল না লাগার কারণে , তিনি নেত্রকোনা ফিরে এসে নেত্রকোনা কলেজ এ ভর্তি হন। নেত্রকোণায় ফিরে এসে নির্মলেন্দু গুণ আবার ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকা ও তাঁর কবি বন্ধুদের কাছে আসার সুযোগ পান ।
নেত্রকোণার সুন্দর সাহিত্যিক পরিমন্ডলে তাঁর দিন ভালোই কাটতে থাকে৷ ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আই.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মাঝে তিনিই একমাত্র নেত্রকোণা কলেজের ছাত্র ছিলেন ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ ৷ হঠাৎ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় ঢাকায়৷ দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে৷ ঢাকার অবস্থার উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তাঁর নাম ভর্তি লিষ্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া৷ আর ভর্তি হওয়া হলো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ ফিরে আসেন গ্রামে৷ ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বি.এ. পাশ করেন তিনি ৷
বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারের মধ্যে তিনটি বড় পুরস্কার তিনি ইতিমধ্যে অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও তিনি দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. বাংলা একাডেমী পুরস্কার-১৯৮২, ২. একুশে পদক- ২০০১, ৩. স্বাধীনতা পুরস্কার- ২০১৬, ৪. আলাওল সাহিত্য পুরস্কার-১৯৭৫. ৫. লেখক শিবির পুরস্কার-১৯৭২, ৬. বঙ্গবন্ধু পুরস্কার- ১৯৮৩
৭. মুজিব পদক-১৯৮৪, ৮. গৌরিকশোর ঘোষ সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা-২০১০
৯. শান্তিনিকেতন সম্মাননা- ২০১৪, ১০. হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার-১৯৮৮, ১১. কবিতা পরিষদ-২০১১, ১২. আহসান হাবীব পুরস্কার-১৯৮৬, ১৩. খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার- ১৯৯১, ১৪. উইলিয়াম কেরী, কলকাতা-১৯৯৭, ১৫. মহাদিগন্ত, কলকাতা, ২০০৫, ১৬. সিটি ব্যাংক-আনন্দ আলো পুরস্কার-২০০৮, ১৭. আড্ডা টোকিও, জাপান, ২০০৩, ১৮. কথা পুরস্কার, প্যারিস, ২০০৮
১৯. মেলবোর্ন সাহিত্য সংসদ সম্মাননা, অস্ট্রেলিয়া, ২০১১, ২০. সংহতি, লন্ডন, ২০১০, ২১.মার্কেন্টাইল ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার -২০১৮
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : প্রেমাংশুর রক্ত চাই, বাংলার মাটি বাংলার জল, চাষাভূষার কাব্য, পঞ্চাশ সহস্র বর্ষ; ছোটগল্প: আপন দলের মানুষ। ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস: কালোমেঘের ভেলা, বাবা যখন ছোট ছিলেন। তিনি নিজ গ্রাম কাশবনে প্রতিষ্ঠা করেছেন কাশবন উচ্চ বিদ্যালয় (এর পূর্ব নাম ছিল কাশতলা মাইনর স্কুল ), রামসুন্দর পাঠাগার, সারদা বাসুদেব চিত্রশালা এবং শহীদ বেদী ।