সময়ের আখ্যানে ছায়াগুলো সময়ের



 নোনাজলে নীলপদ্ম
সময়ের আখ্যানে ছায়াগুলো সময়ের
ইলিয়াস বাবর

লেখার রচনাকাল ও এর প্রেক্ষিত মোটাদাগে ঐ সময়কে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। সাহিত্যের যেকোন মাধ্যমেরই রচনার সময় বড় একটা ফ্যাক্টর। কেননা, মানুষ সামাজিক জীব, সময়ের সমস্যা ও সম্ভাবনার ভেতর তাকেও যেতে হয়, তার ভাবনাকেও প্রলম্বিত করতে হয়Ñ সময়ের কষ্টিপাথরে। তাছাড়া মানবীয় প্রবৃত্তি এই, ভাবনায় থাকে বর্তমানÑ অতীত আর ভবিষ্যৎ চোরা¯্রােতের মতোন, প্রবলভাবে দৃশ্যমান হতে থাকে বর্তমানই। মিলন বনিকÑ প্রথম পরিচয় গল্পকার, আরো অনেক কাজে নিজেকে সংযুক্ত রাখেন সাহিত্যেরই নানা মাধ্যমে। নোনাজলে নীলপদ্ম তার প্রথম উপন্যাসÑ বৃহৎ ক্যানভাসে সময়কে ধরার, নিজেকে আবিষ্কার ও প্রকাশের সুযোগ। তার বয়স কত? প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি কর্মজীবনে আছেন, সময়ের আর্বতে বদলে গেছে তার কর্মক্ষেত্র। কিন্তু তারও আগে প্রথাগত নিয়মের মতো, তিনিও হয়তো শিক্ষাজীবন শেষে খানিক সময় বেকার ছিলেন। যা নিজের জীবন দিয়ে যায় না, যাতে থাকে না হার্দিক সংশ্লেষ, তাতে প্রথমের আকুতি যুক্ত হবার কথা নয়। একজন কথাসাহিত্যিককে অনেক কিছুর ভেতর দিয়েই যেতে হয়; এক জীবনে ধারণ করতে হয় নানা জীবনের স্বাদ। মিলন বনিক নিজের অভিজ্ঞতা বটেই বর্তমানের পরিপার্শ্বকে মিলিয়ে দেখেন মানবিক আয়নায়Ñ রাহুলের মাধ্যমে। নোনাজলে নীলপদ্ম’র ভেতর দিয়ে মিলন বনিকের যে পর্যটন আমাদেরই বর্তমানতায় তাকে কে অস্বীকার করবে? শিক্ষাজীবন শেষে, সোনালী সময়ে জুতোর তলা খসে যায় চাকরি খুঁজতে গিয়ে। কর্মখালী নাইÑ ঝুলানো দেখে স্বাভাবিক উজ্বলতায় নেমে আসে আত্মহননের চিন্তা! বিষণœ রাতের পর সকাল হলেই আবারো শুরু হয় যুদ্ধÑ দিনশেষে মলিন মুখে ফিরে আসতে হয় ব্যাচেলর বাসার নিঃসঙ্গ খাটে। তাতে লেগে থাকে আশাবাদী ও আশাভঙ্গ হবার গল্প, রটিনের ভেতর থেকেও প্রতিনিয়ত তাকে কুঁড়ে খায় সময়ের কীট। অনাকাঙ্খিত মানবিক বোধের জয়-পরাজয়ের দ্বন্দ্বে আমাদের সামনে জেগে থাকে নোনাজলে নীলপদ্ম।

বেকারত্বের অমোঘ তথ্য সামনে রেখে রাজনীতিবীদেরা কথার খই ফোটান; শিল্পপতি-সমাজপতিদের কণ্ঠে ঝরে হাহাকারÑ অথচ তাদের সময় মেলে না রাহুলদের সিভিটা একটু দেখতে, সুযোগ থাকার পরেও বিদেয় দেয় এক কাপ চা খাইয়ে। হকার হাশেম এদের দুঃখ বোঝে, বোঝে না বড় সাহেবেরা। হলুদখামে জীবনবৃত্তান্ত ভরে দৌঁড়তে হয় সাহেবদের দরবারে; ওদিকে পিতা জগদীশের গর্বিত মুখে উচ্চারণ করে তাদের সন্তানদের ডিগ্রি পাশ দেয়ার খবর, ভবিষ্যতে বড় চাকরি প্রত্যাশার কথা। ঘোষবাবুদের মিষ্টি কথার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসের একটুকু অবসরে সাময়িক শ্রান্তিতে আবারো ব্যস্ত হয়ে উঠে রাহুলেরা। দৌঁড়াতে হয় অফিস টু অফিস। তাতে যুক্ত হতে থাকে প্রেম এবং বন্ধুত্বের গল্প। প্রত্যাখান ও প্রত্যাশার গল্প। চৈতি, অনন্ত, মাহফুজ... জুড়ে থাকে আমাদের যাপনে। কত কথা, কত গান। অনন্তদা জেগে থাকে তার ভাতৃসুলভ মমতা দিয়ে। এ আরেক মায়ার খেলা। এরভেতরই রাহুলের মানে জেগে থাকে টিউশনিবিষয়ক নানা অভিজ্ঞতা ও বাড়ি থেকে লম্বা ফর্দের  বিষয়াশয়। কোন কোন ছাত্রী প্রপোজ করে বসে রাহুলকেÑ যেমনি টিউশনি করতে গিয়ে জড়িয়ে যায় অনেক গৃহশিক্ষক। কেউ পার পায়, কেউ তলিয়ে যায় সময়ের চোরাগর্তে। রাহুল, যে কিনা চৈতির সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ, তাকেই তার ছাত্রী প্রস্তাব না শুধু ইশারাও দিয়ে বসে প্রেমের; এবং তাদেরই মা-বাবা মনেমনে রাহুলকে পছন্দ করে আত্মজাকে। ছোট ছোট বাক্যে মিলন বনিকের শব্দখেলা শেষপর্যন্ত দারুন জমেই ওঠে। তার স্বভাবজাত সুস্বাদু গদ্যভাষা আমাদের নিয়ে যায় মায়ার অকল্পনীয় এক জগতে।

শুধু প্রেম আর মোহেই জীবন থেমে থাকে না। রাহুল বন্ধুদের সাথে মিশেÑ অনেকটা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচতে নিজেকে প্রতিস্থাপন করে ছিনতাইকারী দলের সাথে, যারা তার সাথে আগে থেকেই পরিচিত। সময়ের চামচিকায় রাহুল ভীড় করে অসৎ উপার্জনের পথে। যে ছাত্রী তাকে প্রেম নিবেদন করেÑ সে-ই তার বা তার দলের প্রথম প্রতারনার শিকার। চলতে থাকে এভাবেই, চিনতাই, নেশাÑ প্রভৃতি বিষয়ে জড়িয়ে রাহুল নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকে অন্যরকম দুনিয়ায়। চলতিপথে দেখা হয়ে যায় তারই এক বান্ধবীর সাথে, যে কিনা স্কুলজীবনে ছিল দারুন চঞ্চল। সেখানে যোগ হতে থাকে নানাবিধ ঘটনা। নারীদের পুরুষবিষয়ক বিদ্বেষের গোমরও ফাঁস হতে থাকে বেখেয়ালি মনে। এর ভেতর দিয়ে কথাকার মিলন বনিক তার দেখার দৃষ্টিকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। জগতের বড় বড় ঘটনার সাথে জনসাধরণের সংশ্লেষ বা দেখার আনন্দ থাকলেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা এড়িয়ে যায় সহজেই। সেখানেই একজন মহৎ সাহিত্যিক ডুকতে চেষ্টা করেন। তার দেখার চেষ্টাকে ক্ষুদ্রের ভেতরেও বড় প্রভাবে দেখান মিলন বনিক। একজন নেশাকারের মানবিকবোধ চলে যাবার ব্যাপারটুকু শুকনো জায়গায় জাল ফেলে মাছ ধরার মিছে আনন্দের মধ্যেও একধরনের কৌতুকবোধ চিহ্নিত করান মিলন বনিক। ছোটবোনের মৃত্যুজনিত কারণে রাহুলের শোক ও বেদনাকে সমান্তরালে তুলে এনে তাতে বেকারত্ব আর সংসারের বড়ছেলের দায়বোধের চিত্রকে দৃশ্যমান করেন ঔপন্যাসিক। রাহুল আহত হতে থাকে অথচ তার করার থাকে না কিছুই। কিন্তু একজন বাচ্চা মরে যাবার সময় ছায়াছবির মতোন করে বলে না, তার আকুতির কথা। মিলন বনিক বোধহয় সম্প্রতি  অতি জনপ্রিয় বড়ছেলে নাটকের সমান্তরালে নোনাজলে নীলপদ্ম-এ আনেননি কিন্তু রাহুলের বোনের মৃত্যুক্ষণে যে কথপোকথন আনেন তা অতি নাটুকে হয়ে যায়, এমনকি এ নাটুকেপনা বজায় থাকে রাহুলের হাসপাতালে ভর্তিকালীন কথাপরম্পরায়ও।
নোনাজলে নীলপদ্ম’র কোন চরিত্রকেই প্রধান না ধরলেওÑ যদিওবা রাহুল নায়কের চরিত্রে দিব্যি মানিয়ে নেয় নিজেকে; সেখানে সময়কেই চরিত্র বলে ধরে নিতে পারে যেকোন পাঠক। তার নানাবিধ কারণও আছে। বেকারত্বের সামাজিক ও রাষ্ট্রীক প্রেক্ষিতে মিলন বনিকের এ কাজকে উল্লেখযোগ্য হিসেবেই চিহ্নিত করতে পারি আমরা। সময়ের সবচেয়ে বড় বিষবৃক্ষ নিয়ে যে আখ্যান ও তার ডালপালাÑ তা মিলন বনিক দেখাতে সক্ষম হয় নোনাজলে নীলপদ্মে। কিন্তু তার ব্যক্তিজীবনের সময়কে তিনি বোধহয় ডিঙিয়ে যেতে পারেননি! তা এভাবেই, রাহুল বিভিন্ন অফিসে যান, তার সিভি বিভিন্ন দফতরে জমা দেন কিন্তু আজকের দিনে বেকারেরা সিভি জমা দিতে সহজেই দফরে দৌঁড়ান না, সিভি জমা দেন অনলাইনে, মেইলে। আরো মজার বিষয়, এখনকার তরুণ চাকরির খবর পড়েন, তারচে বেশি লগ ইন করেন অনলাইনের বিভিন্ন চাকরির সাইটে। এটা আসলে সময়েরই দাবী, প্রযক্তির ডাকে সাড়া দেয়া। এখানেই সম্ভবত মিলন বনিকের দৃষ্টিপাতে কিছুটা ঊনতা দৃশ্যমান হতে পারে। তারচেয়ে বড় কথা, নোনাজলে নীলপদ্ম হয়ে উঠে আমাদেরই নগরযাপন, পার্থিব চাওয়া-পাওয়া, বেকারত্ব, প্রেম, হতাশা থেকে নেশার দিকে ছুটে চলা ইত্যাদিকে দারুণভাবেই আনেন আলোচ্য কথাকার। শেষপর্যন্ত রাহুলÑ হোক তা হাসপাতালের বেড়ে, সেখানেই তার চাকরিপ্রাপ্তির খবর পান, এবং ইতিবাচক শেষ দিয়েই আমাদের মাত করেন মিলন বনিক। সাহিত্যের কাজ প্রধানত আশাজাগানো, তা-ই একেবারে শেষে এসে দেখান নোনাজলে নীলপদ্ম-এÑ এজন্যই ঔপন্যাসিক মিলন বনিককে শ্রদ্ধা।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট