এক স্বতন্ত্র কাব্যধারা নির্মাণপ্রয়াসী কবি মহাদেব সাহা



এক স্বতন্ত্র কাব্যধারা নির্মাণপ্রয়াসী কবি
মহাদেব সাহা

রাহাত রাব্বানী

‘কবির কী আছে আর/ভালোবাসা ছাড়া,/সমস্ত উজার করে/হাতে একতারা।’, ‘তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর/এই মুখে কবিতা ফুটবে না,/এই কন্ঠ আবৃত্তি করবে না কোনো প্রিয় পঙক্তিমালা’, ‘একবার তোমাকে দেখতে পাব/এই নিশ্চয়াটুকু পেলে-/বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতারে পার হব ভরা দামোদর’, ‘করুণা করেও হলে চিঠি দিও,খামে ভরে তুলে দিও/ আঙুলের মিহিন সেলাই/ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,/এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও’ এসব হচ্ছে মহাদেব সাহার প্রেমজ উচ্চারণ। প্রেমজ শব্দ উচ্চারণ সহজ হলেও প্রেমের কবিতা লিখা সহজলভ্য নয়। অত্যধিক জটিল। একইভাবে কবিতার মাধ্যমে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলা আরো কঠিন। এই কঠিন কাজগুলোই অতি সহজে করেছে ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহা। মহাদেব সাহাকে বলা হয় প্রেম, প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের কবি। প্রেম ও প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পান জীবনের অন্যরকম মাদকতা।

প্রেম ও প্রকৃতি মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার মনে মানুষের প্রতি প্রেমবোধ জাগ্রত হয়না, থাকেনা মানুষের প্রতি ভালোবাসা- সে সাধারণত প্রকৃতির কাছে যেতে পারেনা। নারী প্রকৃতিরই অন্যতম এক অংশ। দুটোর মধ্যেই সৌন্দর্য,আকর্ষণ ও মুগ্ধতা আছে। আছে হৃদয়ের টান, আকুতি ও উচ্ছ্বাস। যে যত বেশি নারীকে ভালোবেসেছে, বুঝতে পেরেছে- সে ততবেশি প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়েছে। তবে নারী প্রেমের চেয়ে মানবপ্রেম কখনো কখনো সবকিছুকে ছাপিয়ে কবিসত্তাকে মহিমান্বিত করেছে।

প্রেমের পাশাপাশি কবি মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ করেছেন স্বদেশ প্রেম,স্বজাতি চেতনাও। ওঠে এসেছে বিদ্রোহ। তারই উজ্জ্বল প্রমাণ: ‘ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস’, ‘গর্জে ওঠে বাংলাদেশ’,‘তোমাকে কেন করে না বিদ্রোহী’, ‘কোথা সে প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ’-কবিতাগুলো। তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠেছে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাদেব সাহার কন্ঠে একবার স্বরচিত কবিতা শুনেছিলেন। পরম আদরে চুমো খেয়েছিলেন কবির কপালে। আশীর্বাদ করেছিলেন মহাদেব সাহা অনেক বড় কবি হবেন। স্রষ্টা তাঁর আশীর্বাদ ফেলেনি। মহাদেব সাহা কবি হয়েছেন, শুধু কবি নন, হয়েছেন-বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি।

মুজিবুরের আশীর্বাদপুষ্ট কবি মহাদেব সাহার কবিতায় বারবার ওঠে এসেছে মুজিবের নাম। লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা ও সেই নির্মম ট্র্যাজেডির অশ্রুসজল পঙক্তিমালা। প্রাসঙ্গিক বিষয় যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে যে দুজন কবি প্রথম কবিতা লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন; কবি মহাদেব সাহা তাঁদের একজন । মুজিবকে নিয়ে লিখা তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে- ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’, ‘তোমার বাড়ি’ উল্লেখযোগ্য।

কৈশরে লেখালেখির শুরু হয় কবি মহাদেব সাহার। প্রেম, বিরহ, স্বদেশ ভাবনা, নিসর্গসহ জাগতিক জীবনের নানা অনুষঙ্গকে উপজীব্য করে কবি মহাদেব সাহা এখনো চলমান রেখেছেন তাঁর কাব্যচর্চা। বিরল কাব্যপ্রতিভা নিয়ে আপন মহিমায় নির্মাণ করেছেন রোদেল আলো ঝলমলে তাঁর কবিতার পৃথিবী। তাঁর কবিতায় ভেসে আসে ভিন্ন এক জগত। যে জগত অতি চেনা হয়েও অচেনা, কাছের হয়েও দূরের, ধোঁয়াশার আড়ালে থেকেও অতিসাধারণ, যার কারণে তাঁর কবিতা আলাদাভাবে শনাক্তযোগ্য। আর একারণেই তাঁর প্রতিটা কবিতাই পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী। তাঁকে নিয়ে কবিতা পাঠকেও আগ্রহও বিস্তর। তাঁর গ্রন্থসংখ্যা দেড়শতাধিক।

এক স্বতন্ত্র কাব্যধারা নির্মাণপ্রয়াসী কবি মহাদেব সাহার রয়েছে সরল মন, উদার ও মানবিক  দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর কবিতায়ও এসবের সফল প্রতিফলন লক্ষ্যণীয়।

অত্যন্ত নির্মোহ এই কবি তাঁর নীতি থেকে সরে দাঁড়াননি নূন্যতম। এরশাদ শাসনামলে সাংবাদিকদের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে মহাদেব সাহাকেও এ জমি নেওয়ার অনুরোধ করলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ইচ্ছে করলে গড়তে পারতেন-বাড়ি, গাড়ি। কিন্তু তিনি কবিতাকেই করেছেন চিরসাথী। কাব্যপ্রতিভার জন্য লাভ করেছেন-একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, কবি সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার, কপোতাক্ষ সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। জানা মতে-কবি তাঁর সব বই, সম্মাননা, পুরস্কার বাংলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘরকে দিয়ে দিয়েছেন। এবং তাঁর যাবতীয় উপার্জন গরীবদের মাঝে বিতরণ করেছেন। এ পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন জার্মানি, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা,উজবেকিস্তান।

কবি মহাদেব সাহা ১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এক ছায়াঘেরা পাখিডাকা প্রকৃতির সুন্দর-মনোরম পরিবেশে আঁকা ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গদাধর সাহা এবং মাতা বিরাজমোহিনী। স্ত্রী নীলা সাহা এবং দুই পুত্র: তীর্থ ও সৌধ।

আগামী ০৫ই আগস্ট কবি মহাদেব সাহার ৭৫তম জন্মবার্ষিকী। কবিকে জন্মবার্ষিকীর আগাম শুভেচ্ছা। সৃষ্টিকর্তার নিকট কবির সুস্থ্যতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। এদেশের জন্য, এদেশের মাটি-জল-বৃষ্টির জন্য, কবিতার জন্য কবি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুক। সেই সাথে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ কবি তাঁর জীবনের শেষ সময়টুকু যেন তাঁর প্রিয় দেশের আলো-বাতাসে বসে কবিতা লিখতে পারেন সেই লক্ষ্যে কবিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। উল্লেখ্য যে, কবি মহাদেব সাহা গত আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে নিজ দেশের ফুলের ঘ্রাণ,পাখির গান, মেঘ, বৃষ্টি হৃদয়বন্দী করে কানাডার শীতলতম এক শহরে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। এ অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসন। আমরা জানি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাহিত্যের অনুরাগী একজন। নিজেও লেখক। বিশেষ করে কব্যানুরাগী। তাই মহাদেব সাহার পাঠক এবং গুণগ্রাহী হিসেবে এ আমাদের দাবি না, বিশ্বাস-মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্মোহ কবি মহাদেব সাহাকে তাঁর প্রিয় দেশে ফিরিয়ে এনে কবিতা লেখার পরিবেশ করে দিবেন। কবি আবার তাঁর প্রকৃতি তুলে আনবেন কবিতায়।

কবি, আপনি ভালো থাকুন। আপনাকে এদেশ ভুলে থাকেনি। আমরা আপনাকে ভুলিনি। আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন- কবিতায়, আমাদের মাথার উপর ছাদ হয়ে। আমরা আপনাকে ভুলবো না। ভালোবাসা ভুলা যায় না। ভালোবাসি দাদা, অনেক বেশি।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট