নিভৃত গলিতে





নিভৃত গলিতে                             
হাসান মাহাদি

জীবনটা নিজের তাই জীবনের সকল দায়-দায়িত্ব নিজের উপরই বর্তায়। এই কথাটার মানে বুঝতে বুঝতে মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। এখানে নানা প্রান্তের নানান পরিবেশ ও সমাজ  থেকে অসংখ্য জীবনের সমারোহ ঘটে।
একেক জনের একেক রকম জীবন। একেক সমাজের প্রতিনিধি। এদের সাথে চলা ফেরা করতে করতে একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি যে, জীবনের মধ্যে বৈচিত্রতা থাকলেও একটা জায়গায় মিল আছে। সেটা হচ্ছে, সবারই টিকে থাকতে সংগ্রাম করতে হয়। আর এভাবেই আস্তে আস্তে সেই কথার মানেটা বুঝে গিয়েছি। জীবনটা যেহেতু নিজের সংগ্রামটাও নিজের। আর যখন এই জীবনটা কোনো মধ্যবিত্তের কিংবা নিন্মবিত্তের হয় তাহলে আর কোনো কথাই নেই। আজকের সমাজ কেনো আদি কাল থেকেই ‘সংগ্রাম’ শব্দটা শুধুমাত্র সমাজের উল্টো পিঠে বসবাসকৃত এই মানুষগুলোর জন্যেই সত্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম দিন থেকেই আমার সেই সংগ্রামটা শুরু হয়ে গেছে।
শহরের রাস্তায় যখন নামি তখন প্রতিটি কদম আমাকে ভেবে চিনতে ফেলতে হয়। হিসাব কষে কষে প্রতিটি পয়সা খরচ করতে হয়। দু’টাকার লেকচার শীটের ফটোকপি কিনতে গেলেও জীর্ণ মানি ব্যাগে বারবার তাকাতে হয়। মেসে মিল সংখ্যা কমাতে মাসের অনেক সকাল-দুপুর কেটে যায় অনাহারে।  কিংবা একটা পাকুরা আর সিংগারায় কেটে যায় সারাদিন।
ঢাকা শহরে একবেলা খাবার আর একটু মাথা গুঁজে টিকে থাকার জন্য আমার মতো জীবনগুলোর অন্যতম উপায় টিউশনি। প্রথম এসেই টিউশনি যোগার করা অনেক কষ্ট সাধ্য। সেই জায়গা থেকে প্রভুর মেহেরবানিতে আমি সফল। পড়াতে যাই। হেঁটে যাই। রাস্তার ধূলিগুলো আমার বন্ধু হয়ে গেছে। সন্ধ্যার ক্ষুধাগুলো সহনীয় হয়ে গেছে।
পরপর তিনদিন ছাত্রকে ‘ভার্বের’ সঙ্গা পড়াতে পারি। সকল বিরক্তি আর বদ মেজাজি ভাবগুলো নির্বাক দীর্ঘশ্বাসে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ছাত্রের মায়ের টহলদারি আর বেশি পড়ানোর তাগাদা মূলক অনুরোধে এখন আর বির্বত বোধ করি না। সব কিছু সয়ে গেছে।
এই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে গিয়ে যেমন অনেক তিক্ততার মোকাবেলা করতে হয় তেমনি কিছু মধুর অনুভূতি অনুভব হয়। যেগুলো শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও একটা গল্প লেখার সাহস যোগায়।
এইতো সেদিনের কথা। পড়াতে এসেছি। ছাত্রের বাসার সামনে একটা মানি ব্যাগ পরে থাকতে দেখলাম। ব্যাগটা তুলে বাসায় নিয়ে গেলাম। ব্যাগটা আমার ছাত্রের বাবার। টাকার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কাগজ-পত্রও ছিলো। আমি ব্যাগটা ফিরিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর উনি আমাকে কিছু বখশিস দিতে চাইলেন। আমি খুবই নমনীয়তার সাথে ফিরিয়ে দিলাম। কিন্তু নিজের প্রতিবাদটুকু প্রকাশ করলাম না। কিছুদিন পর খেয়াল করলাম আমার ঝুলন্ত টিউশনিটা টিকে গেছে। এখন ছাত্রের মায়ের তাগাদা আসে না। নাস্তা আসে। আমি জানি এর কারণ কি।

আজ টিউশনি ছেড়ে দিয়েছি। কারণটা ওনারা জানতে চেয়েছিলেন। সত্যটা বলিনি। আমার টাকা দরকার ঠিকই।  কিন্তু ব্যক্তিত্ব ও সততাকে কোনো কিছুর সাথে বিনিময় করতে আমি রাজি নই। আমি জানি আমার সামনে সারা মাস পরে আছে। রুমের ভাড়া, খাবারের টাকা আর লেকচার শীট কেনার মতো টাকা  আমার কাছে নেই। আরেকটা টিউশনি খোজার জন্য আমাকে অনেক হাঁটতে হবে। তারপরও কেনো যেন পুরান ঢাকার এই লাল মোহন স্ট্রীটে আজ প্রথমবারের মতো তীব্র দূর্গন্ধের পরিবর্তে স্নীগ্ধতা অনুভব করলাম। এই শহরে এইরকম অনেক নিভৃত গলি রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে আমার মতো অগণিত স্বপ্নচারীরা ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে স্বপ্ন দেখে। আর এরকম একেকটা  অনুভূতি নিয়ে শত অপ্রাপ্তির মাঝেও হাজারো গল্পের ছঁক আঁকে।
অনার্স ১ম বর্ষ, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।






শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট