ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১৭





[গত সংখ্যার পর]
আমি বলি, ‘পারবেন। সাধারণ মানুষ এসব পারে। আপনি তো বিএ পাস।’
হঠাৎ করে রুবীর একটি কথা মনে হয়। যাবার সময় বলেছিল, ‘উর্মি, আমি তোর জন্য পৃথিবীর যেকোনো কাজ করতে পারি।’
আমি ওকে কিছুই বলতে পারিনি। আমার চোখ ভরে জল এসে গিয়েছিল।

১৫.৮.১৯৯০

গত ক’দিন আগে শেরাটন হোটেল বিদেশিদের সঙ্গে কনফারেন্স ছিল নারী নেত্রীদের। শহীদ জননী ব্যতীত নারী  নেত্রীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বৈরাচার তাড়ানো অভীপ্সা নিয়ে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে তা তারই অংশ। নিউজিল্যান্ডের তরুণ জার্নালিস্ট জুডি এল আমাকে বলে, ‘তোমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললে কেন? অকৃতজ্ঞ নেশন।’
আমি কিছু বুঝে বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি ওর মায়াবী চোখের তারায় আমার দিকে ঘৃণা ছুড়তে থাকে। ভাবখানা এমন, শেখ মুজিবের হত্যাকা-ের সব দায়ভার আমার।
আমার খুব খারাপ লাগছিল। তাই তো। এ প্রশ্ন আমার? কেন? আমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললাম? যে মানুষটি একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক এক খ- ভূখ-ের জন্ম দিয়েছেন। হাজার বছর ধরে বাঙালি জনগোষ্ঠীর লালিত সংগ্রামকে যুদ্ধের ময়দানের দিকে নিয়ে গেছেন। অস্ত্রহীন জাতিকে বজ্র হুঙ্কারে বাঙ্কারে পাঠিয়েছেন। জন্ম হয়েছে নতুন ভূখ-, একটি পতাকা। দীর্ঘ জীবনব্যাপী মানুষের চাওয়া-পাওয়া-আশা-আকাক্সক্ষার গভীর স্পর্শের বাতাবরণে জেলখানার অন্ধসেলে সহস্র রজনীর নিঃসঙ্গতার কষ্টকে বরণ করেছেন। অসীম মানবপ্রেমের মহান পুরুষকে বুলেটের আঘাত ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। আহ!
জার্নালিস্ট জুডিকে বলি, ‘আমি দুঃখিত। আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেব না।’
জুডি বলে, ‘কাউকে তো দিতে হবে।’
‘আগামী প্রজন্ম জবাব বের করে তোমার নিকট পৌঁছে দেবে। আমি শুধু তাদের সঙ্গে থাকব।’
আমার খুব কষ্ট হতে থাকল।
কথা হারিয়ে যেতে থাকে। শূন্য হৃদয়জুড়ে মমতার নহর বইতে থাকে। যা বিদেশি এক তরুণী আঁচ করতে পেরে বলে, ‘আই এম রিয়েলি সরি। নেশন ব্লিডিং হোল।’
কনফারেন্স থেকে ফিরে ভালো ঘুম হয়নি আমার। কেবলি একটা ক্ষীণ ক্ষত থেকে বেদনা ঝরতে থাকে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার লাইন মনে পড়ে, ‘শুধু তোমার জীবনই তুচ্ছ, পিতা।’
চিলির বিপ্লবী নেতা আলেন্দের বন্ধু পাবলো নেরুদা তার মৃত্যুদিনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন এভাবে, ‘একজন নিঃসঙ্গ মানুষকে যখন কতিপয় মানুষ বহন করে নিয়ে যায়, ঝড়-জলের মধ্যে দিয়ে তখন নেরুদার মনে হয়েছিল প্রকৃতি কাঁদছে। আর চিলির অসংখ্য মানুষ অনুভব করল চিলির মানুষের পরম বান্ধব কী ভয়াবহ বেদনার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করে চিলির আত্মা আজ সর্বগৃহে পৌঁছে গেছে।’ তেমনি বঙ্গবন্ধুর আত্মা প্রোথিত রয়ে গেল বাংলার আকাশ-বাতাস-বৃক্ষ লতায়। ঘাতক চিরকাল নিপতিত মহাকালের আস্তাকুঁড়ে।
প্রিয় মুজিব, আমি আপনার জন্য শোকগাঁথা লিখে যাব আর মহাকালের পরম্পরায় একজন দেশপ্রেমিকের আত্মা খুঁড়তে খুঁড়তে আবিষ্কার করব, ভালোবাসা।’

৩.১০.১৯৯০

সকাল সকাল অফিসে এসে বেবী আপা আমাকে তার রুমে ঢেকে নিল। বেবী আপাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের মধ্যে তার কপালে ঘামের স্বেদবিন্দু।
‘উর্মি, তুমি কিছু কি জানো?’
‘কী আপা?’
আমান উল্লাহ আমান নাকি তিন কোটি টাকা এরশাদের কাছে থেকে গ্রহণ করেছে। চিনি চোর অতি বিপ্লবী কাজী জাফর আহমদ দালালের ভূমিকা পালন করছে।’
আমি শান্ত কণ্ঠে বলি, ‘বাতাসে সেসব কথাই ভেসে বেড়াচ্ছে। হতে পারে সবকিছু।’
‘ওর দলতো মাল্টিকেলাস। আদর্শহীন। আকস্মিক ডিগবাজি দিতে পারে। সামরিক হাত দিয়ে যে আদর্শের জন্ম হয় তা মানুষের  চাওয়া পাওয়া বুঝতে পারে না। যুদ্ধের সময় যারা বিপরীতে ছিল তাদের প্রতিষ্ঠা করার প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে। নইলে শাহ আজিজের মতো চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী চরিত্রকে প্রধানমন্ত্রী করত না। গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিত না।’ বেবী আপার কণ্ঠস্বর ঈষৎ উত্তেজিত।
ইতোমধ্যে জাকির সাহেব জরুরি ফাইল নিয়ে এলেন। চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘কোলকাতার হিউম্যান রাইটার্স’-র ফাইলটা উর্মিকে বুঝিয়ে দেবেন। নোট দেবেন। উর্মি ওদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করবে। আমাদের অবস্থানে স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে, সীমান্ত হত্যা মানবিক অপরাধ। আই অ্যাম সরি জাকির, তোমার অফিসের কাজে মন কমে গেছে।’
আমি লক্ষ করলাম ‘আতঙ্কে’ জাকির সাহেবের চোখ, মুখ অন্যরকম মনে হচ্ছে। অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে আড়াআড়ি  তাকালেন।



‘উর্মি এক সপ্তাহের মধ্যে জাকিরের কাছে থেকে কাজগুলো বুঝে নেবে।’ বেবী আপার কণ্ঠ উচ্চকিত।
‘তেরেসা আশ্রমের মানসী দাশকে নোট পাঠাবে। লিখবে, তিনি যেন আমাদের পক্ষ নিয়ে একটি বিবৃতি দেন। দীপু না থাকাতে এ সব নিয়ে আমায় ভাবতে হয়।’
‘উর্মি, তোমাকে দীপু কিছু লেখেনি?’
‘না আপা। মিতালী দিদিকে টেলিফোন করেছিলেন। ভালো আছেন। প্রাথমিক কাজগুলো সেরে আপনাকে ফোন করবেন।’
জাকির সাহেব স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। আমার রুবীর কথা মনে হলো। রুবী কী সুন্দর করে আঞ্চলিক ভাষায় গাল দিতে পারে।
‘ওর মা-বোনের খোঁজ নিও। মঞ্জু তোমাকে সাহায্য করবে।’
‘গতকাল গিয়েছিলাম। ভালো আছে। আসমা খুব কান্নাকািট করে।’
বেবী আপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
এতক্ষণ পর আমার খুব খারাপ লাগছিল। পৃথিবীতে সব কষ্টের উষ্ণতা একরকম। একই প্রবাহের মধ্য দিয়ে মরমে পশিয়া যায়।
‘উর্মি, দীপুকে দিয়ে হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-র অনুবাদ তোমাকে পাঠিয়ে ছিলাম। ফজলে লোহানী সাহেবের অনুবাদ করেছেন। পড়েছ?’
‘জি আপা। ম্যান মে বি ডিসট্রয়েট, নট ডিফিটেট।’
‘গুড। তোমার এইচএসসি-র ফাইনাল কবে?
‘মার্চে।’
‘আচ্ছা। আমি ডলির কাছ থেকে সব জেনে নেব।’
ঠিক তখন আমার চোখ ভরে জল এল। বেবী আপার মাতৃমুগ্ধ মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। জানালা দিয়ে এফডিসি দেয়ালের দিকে তাকাই। নারকেলের চিরল পাতায় রোদ খেলা করে।

৭.১২.১৯৯০

ঢাকার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। বাতাসে গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। এরশাদ শীঘ্রই পদত্যাগ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল। আর্টস ফ্যাকালটির বকুলতলায় এরশাদের দানব আকৃতির কুশপুত্তলিকায় ছাত্র-জনতা জুতাপেটা করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। রামপুরায় গুলিবিদ্ধ কিশোরের লাশ নিয়ে মিছিল বিটিভি আক্রমণ করেছিল। বিটিভিতে বন্যাপ্রেমিক এরশাদের গান প্রচার করছে। স্বৈরাচারের পক্ষে ঘনঘন সাফাই গাইছে ব্যারিস্টার মওদুদ গংরা। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল থেকে জাপা নেতাদের পলায়নের সংবাদ আসছে।  ছাত্র-জনতা তিন দিন ধরে ঘরে ফেরে নাই। রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। বিডিআর-পুলিশ ছাত্র-জনতার সঙ্গে। সেনা প্রধান জেনারেল মো. নাসিমের ভূমিকা এরশাদের অনুকূলে নেই। সব মিলিয়ে পদত্যাগের গুঞ্জন অমূলক নয়।
গতকাল সন্ধ্যা বেলা বেবী আপা টেলিফোন করলেন।
‘তুমি ফার্মগেট থেকে রিকশা করে টিএসসিতে চলে আসো। চামেলীকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো। আমরা ওখানে সারারাত অবস্থান নেব। শীতবস্ত্র ছাড়া রাস্তায় বের হইও না।’
চামেলী আপা ঘুমকাতুরে মানুষ। সন্ধে লাগার সাথে সাথে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আমি যখন পড়াশোনা শেষ করে ঘুমের প্রস্তুতি নিই  তখন একবার ঘুম ভাঙে। আলোর দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে আবার ঘুমিয়ে যান।
বেবী আপার টেলিফোনের কথা জানাতেই খেয়ে দেয়ে শীতবস্ত্র গায়ে জড়িয়ে চামেলী আপা বলেন, ‘আমি রেডি, উর্মিলা। বাকিটুকু তোমার দায়িত্ব।’
আমি সেলোয়ার-কামিজের সঙ্গে সোয়েটার জড়িয়ে মাথায় নাইকের ক্যাপ পরে নিই। পায়ে কেড্সের সঙ্গে গরম মোজা।  চামেলী আপার ঝুলন্ত ব্যাগে আমার পার্টস ঢুকিয়ে  দেই। যাতে ঠেলাঠেলির মধ্যে পার্টস হারিয়ে না যায়। বাইরে ডিসেম্বরের কনকনে শীত। তেজগাঁও রেল লাইন বরাবর তাকালে কিছু দেখা যায় না। জমাট কুয়াশা লেগে আছে। নারকেল বীথির চিরল পাতা বেয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে শিশির ফোঁটা। দীপু ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। সুইডেনের হিমশীতে সে কি কষ্ট পাচ্ছে? বঙ্গীয় আদম সন্তান। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষ। অত শীতের সঙ্গে পরিচয় নেই। কষ্ট তো পাবে। তারপর আস্তে আস্তে সয়ে যাবে। চিঠিতে লিখবেন, ‘দেবী, শীতকে আমি জয় করেছি। শুধু দেবীর একটি ঈষৎ উষ্ণ হাত লোমকূপে স্পর্শ চায়।’ আমি হয়তো অভিমান করে চিঠির উত্তর দেরিতে দেব। অভিমান করে আমার গার্জিয়ানশীপের দায়িত্বহীনতার উল্লেখ করে চিঠিতে গাঢ় চুম্বন রেখায় খুঁজে ফিরবে অমিত সুখ। করুণ শব্দের গাঁথুনিতে লিখবেন, ‘দেবী, আমি কাঙাল? তৃষ্ণায় সারা বুকে মরুভূমি-হাহাকার। জল ভিক্ষা চাইছি।’ বুক থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, ‘আহা, দীপু ভাই। এ জনমে যার প্রথম চুম্বন বয়ে বেড়াচ্ছি।’
রিকশা ফার্মগেটে আসতেই দেখি লোকে-লোকারণ্য। হাজার হাজার মানুষ স্লোগানে মুখরিত। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ। রাস্তা জনতার দখলে। রিকশা ছেড়ে দিয়ে চামেলী আপাকে বলি, ‘হেঁটে যেতে হবে।’
চামেলী আপা খুব বিস্ময় নিয়ে বলেন, ‘জীবনে এরকম দেখিনি।’
আমি বলি, ‘তাতে কী! আমিও মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি।’
বাঁধভাঙা জনতার জোয়ার ঠেলে শাহবাগ মোড়ে যখন পৌঁছাই তখন রাত পৌনে নয়টা বাজে। হাজার হাজার নর-নারীর কণ্ঠস্বরে উত্তাল শাহবাগ। এর মাঝে খোলÑকরতাল দ্রিমিকি দ্রিমিকি বাজছে। প্ল্যাকার্ড হাতে একজন এগিয়ে আসে। ওর হাতে শিল্পী কামরুল হাসানের সর্বশেষ ছবি, ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে।’ যাদুঘর পেরোতেই ভরাট কণ্ঠে কবিতার পঙ্ক্তিমালা ভেসে এল। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পড়ছেন, ‘জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো  শকুন।’ কবি মোহন রায়হান পড়ছেন, ‘ইথাকা ইথাকা এখন জেলে।’ কবি বদরুল হায়দার পড়ছেন, ‘শাহবাগ ঘুমায় না। শাহবাগ ছুটি হলে কবিতার রাজধানী হয়ে পড়ে তুমিহীন।’ [চলবে]





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট