ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৮




জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
বাবা ফিক করে হেসে দিল। মা বলল, হাসির কথা বললাম?
এ ক্ষেত্রে কথাটা হাসিরই হয়ে গেছে।
হাসির হবে কেন?
চন্দ্রার বনের ত্রাস তিনজন বনদস্যু পিস্তল তাক করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
তারপর?
তারপর যা বলার বলল, যা করার করল।
কী বলল? কী করল?
বলল-ঐ মান্দার পুত, যা আছে বাইর কর।

মাজেদা আবার হি হি করে হেসে উঠল।
মা বলল, এই মেয়ে এমন হি হি করছে কেন? এখানে কি হুমায়ূনের হাসির নাটক হচ্ছে?
বাবা বলল, তারপর আমাদের সেলফোন, মানিব্যাগ সব ছিনিয়ে নিল।
তারপর?
তারপর ঘটনা মোড় নিল এক অসাধারণ নাটকীয়তায়।
নাটকীয়তায়!
হু।
কী রকম নাটকীয়তা?
খাওয়া শেষ করো। সে এক বিরাট ইতিহাস। বলতে সময় লাগবে।
যে মা কিছুই শুনবেন না, সে এখন বিরাট আতিহাস শোনার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু বাবার আর কোনো তাড়াহুরা নেই। তার কথা-বলবো, সব বলবো। ধীরে-সুস্থে বলবো। আমরা বনে যে কয়জন ছিলাম সবাই এক সাথে হয়ে তারপর বলবো। একা একা বলতে গেলে অনেক ঘটনা, অনেক কথা ফসকে যেতে পারে।
থাকার মধ্যে তো ছিল শুধু হাসান। বাপ-বেটা গুছিয়ে বলতে পারবে না?
শুধু হাসান ছিল না। ওর ছোট ভাই নিলয়ও ছিল। ব্রেফ বয়। ডাকাতদের সামনে আমি যখন কথার খেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না, সে তখন বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল-ছোটদের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে হয়।
বাবা হাসানকে ফোন করল, হাসান, তুমি কী করছো এখন?
একটা বই পড়ছি স্যার।
কী বই?

বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’।
অসাধারণ একটা বই। বি.এ পাস করা এক যুবক অনেক কষ্ট করেও একটা চাকরি যোগার করতে পারে না। শেষে পূর্ণিয়া জেলায় এক জঙ্গল মহালের বন্দোবস্তের দায়িত্ব নিয়ে সেখানে চলে যায়। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট লেগেছে সেখানে থাকতে। এক সময় সেই লবটুলিয়া বা আজমবাদের জঙ্গলকেই ভালবেসে ফেলে-ভালবেসে ফেলে জঙ্গলের অশিক্ষিত, হতদরিদ্র মানুষদের।
স্যার, এই বইয়েও জ্যোৎস্নার একটা অসাধারণ বর্ণনা আছে, আপনি বোধহয় সেটা খেয়াল করেননি।
না না, সে রকম তো কিছু মনে পড়ছে না।
স্যার, আমি আপনাকে একটা অংশ পড়ে শোনাচ্ছি-
একদিনের কথা জীবনে কখনো ভুলিব না। মনে আছে সেদিন দোলপূর্ণিমা। কাছারির সিপাহীরা ছুটি চাহিয়া সারাদিন ঢোল বাজাইয়া হোলি খেলিয়াছে। সন্ধ্যার সময়ও নাচ-গানের বিরাম নাই দেখিয়া আমি নিজর ঘরে টেবিলে আলো জ্বালাইয়া অনেক রাত পর্যন্ত হেড অফিসের জন্য চিঠিপত্র লিখিলাম। কাজ শেষ হইতেই ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখি, রাত প্রায় একটা বাজে। শীতে জমিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছি। একটা সিগারেট ধরাইয়া জানালা দিয়া বাহিরের দিকে উঁকি মারিয়া মুগ্ধ ও বিস্মিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করিল তাহা পূর্ণিমা-নিশীথিনীর অবর্ণনীয় জ্যোৎস্না।
হয়তো যতদিন আসিয়াছি শীতকাল বলিয়া গভীর রাত্রে কখনো বাহিরে আসি নাই কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হউক, ফুলকিয়া বইহারের পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না রাত্রির রূপ এই আমি প্রথম দেখিলাম।
দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। কেহ কোথাও নাই, সিপাহীরা সারাদিন আমোদপ্রমোদের পরে ক্লান্ত দেহে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। নিঃশব্দ অরণ্যভূমি, নিস্তব্দ জনহীন নিশীথরাত্রি। সে জ্যোৎস্নারাত্রির বর্ণনা নাই। কখনো সে রকম ছায়াবিহীন জ্যোৎস্না জীবনে দেখি নাই। এখানে খুব বড় বড় গাছ নাই, ছোটখাট বনঝাউ ও কাশবন-তাহাতে তেমন ছায়া হয় না। চক্চকে সাদা বালি মিশানো জমি ও শীতের রৌদ্রে অর্ধশুস্ক কাশবনে জ্যোৎস্না পড়িয়া এমন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করিয়াছে, যাহা দেখিলে মনে কেমন ভয় হয়। মনে কেমন যেন একটা উদাস বাঁধনহীন মুক্তভাব-মন হু-হু করিয়া ওঠে, চারিধারে চাহিয়া সেই নীরব নিশীথরাত্রে জ্যোৎস্নাভরা আকাশতলে দাঁড়াইয়া মনে হইল এক অজানা পরীরাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছি-মানুষের কোনো নিয়ম এখানে খাটিবে না। এইসব জনহীন স্থান গভীর রাত্রে জ্যোৎস্নালোকে পরীদের বিচরণভূমিতে পরিণত হয়, আমি অনধিকার প্রবেশ করিয়া ভালো করি নাই।
তাহার পর ফুলকিয়া বইহারের জ্যোৎস্না কতবার দেখিয়াছি-ফাল্গুনের মাঝামাঝি যখন দুধলি ফুল ফুটিয়া সমস্ত প্রান্তরে যেন রঙিন ফুলের গালিচা বিছাইয়া দেয়, তখন কত জ্যোৎস্না শুভ্র রাত্রে বাতাসে দুধলি ফুলের মিষ্টি সুবাস প্রাণ ভরিয়া আঘ্রাণ করিয়াছি-প্রত্যেকবারেই মনে জ্যোৎস্না যে এত অপরূপ হইতে পারে, মনে এমন ভয় মিশ্রিত উদাস ভাব আনিতে পারে, বাংলাদেশে থাকিতে তাহা তো কোনোদিন ভাবিও নাই। ফুলকিয়ার সে জ্যোৎস্নারাত্রির বর্ণনা দিবার চেষ্টা করিব না, সেরূপ সৌন্দর্যলোকের প্রত্যক্ষ পরিচয় যতদিন না হয় ততদিন উপলব্ধি করা যাইবে না-করা সম্ভব নয়। অমন মুক্ত আকাশ, অমন   নিস্তব্ধতা, অমন নির্জনতা, অমন দিগ্দিগন্ত বিসর্পিত বনানীর মধ্যেই শুধু অমনতর রূপলোক ফুটিয়া ওঠে। জীবনে একবারও সে জ্যোৎস্নারাত্রি দেখা উচিত, যে না দেখিয়াছে, ভগবানের সৃষ্টির একটি অপূর্ব রূপ তাহার নিকট চির-অপরিচিত রহিয়া গেল।
অংশাটা পড়া হলে বাবা স্তব্দ হয়ে রইল। সেলফোন কানে ধরা কিন্তু কিছু বলেন না।
হাসান বলল, স্যার, আমি হুমায়ূন আহমেদের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-মৃত্যুর পর আপনাকে যদি কারও সাথে সাক্ষ্যাত করতে বলা হয় তাহলে আপনি কার সাথে সাক্ষ্যাত করতে চাইবেন? হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন-আমি বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে সাক্ষ্যাত করতে চাইবো।
বাবা বললেন, আমিও মরণের পর বিভূতি বাবুর সাথে সাক্ষ্যাত করতে চাই। তার আগে তাঁর বইপত্র আরও মনোযোগে পড়তে হবে। এই ভাসা ভাসা পাঠ নিয়ে তার সামনে গেলে মুখ থাকবে না।
স্যার, আপনি ফোন করেছেন কী মনে করে?
তুমি কি এখনই আমার বাসায় আসতে পার-নিলয়সহ?
পরবো, কিন্তু কেন?
অন্তরের মা চন্দ্রার বনে আমাদের জ্যোৎস্না আস্বাদের অনুভূতি জানতে চাচ্ছে। আমার মনে হয়, তোমরা থাকলে ভালো হবে। তুমি ব্যাপারটা যেভাবে বোঝাতে পারবে, আমরা সেভাবে পারব না। শত হলেও তুমি বাংলায় মাস্টার্স।
আমি আসছি স্যার। পনেরো মিনিটের মধ্যে নিলয়সহ আমি এসে পড়ছি।
ওরকম নিশ্চয়তা দিয়ে কথা বলো না। ঢাকা শহরের ঐতিহাসিক জ্যামের কথা নিশ্চয় তোমার জানা আছে। তাড়াহুরোর কিছু নেই। তুমি     ধীরে-সুস্তে আসো। আমরা আয়োজন নামি। চা-কফি, টোস, ডিমভাজি, পরাটা।
সবাই বসেছে কার্পেটে গোল হয়ে। প্রথমে বাবা, তারপর অন্তর আর নিলয়, তারপর মা, মা’র পাশে হাসান। মাঝখানে ফ্লাস্কে চা, কফি, টোস, ডিমভাজি, পরাটা। মা বাবাকে ধমকের সুরে বলল, তুমি কি নামাজ পড়তে বসেছো?
বাবা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। শুরুতেই ভ্যাবাচ্যাকা। বাবা বলল, নামাজ পড়তে মানে?
নামাজের ভঙিতে বসেছো কেন? বৈঠকি ঢঙে বসো।
বৈঠকি ঢঙে?
পদ্মাসন হয়ে বসো।
বাবা সবার বসা দেখল। তারপর পদ্মাসন হয়ে বসল। মা বলল, এবার শুরু করো। হাসান, তুমি বলো বনে তোমরা কেমন জ্যোৎস্না উপভোগ করলে?
অসাধারণ ম্যাডাম।
ম্যাডাম! আমি কি তোমার বস, না বসের স্ত্রী? ওসব ডাক শুনতে আমার ভালো লাগে না। আমি সাধারণ গৃহিনী। ‘আপা’ ডাক শুনতে আমার ভালো লাগে। মিষ্টি মধুর ডাক।
জি ম্যাডাম।
তুমি কি কখনো কাউকে ‘আপা’ ডাকোনি?
ডেকেছি ম্যাডাম।
কাকে?
আমার বড় বোনকে।
এখনও ডাকো নিশ্চয়।
না, এখন আর ডাকা হয় না।
কেন?
ডাকলে কোনো সাড়া পাব না বলে।
সাড়া পাবে?
হু, এখন সে সব আদোর, স্নোহ, ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে....।
কী হয়েছিল ওর?
আমি তখন ক্লাশ নাইনে, আপা এইচ.এস.সি ফাইনাল দেবে। খুব পড়াশোনার চাপে ছিল। পরীক্ষার কিছুদিন আগে হঠাৎ একদিন পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাল। কপাল কেটে গেল। তারপর প্রায়ই খিচুনি হতে থাকে। অনেক আগে থেকেই মাথা ব্যথা ছিল। এলাকার ডাক্তারের কাছে গেলে এসপিরিন জাতীয় ওষুধ দিত। খেলে উপশম পেত। শেষে খিচুনিটা এমন পর্যায়ে গেল যে, প্রতিদিনই হতে থাকে। কখনো দিনে ২/৩ বার। ঢাকায় এনে সিটি স্ক্যান করে ধরা পড়ল ওর ব্রেনে ছয়টা টিউমার। জরুরি টিউমার অপসারনের জন্য অপারেশন করা হল। সেই অপারেশনেই ভিটেবাড়ি ছাড়া সব চলে গেল। তারপর বিক্রি হল ভিটের ঘর। এবং সবশেষে ভিটেবাড়ি। যে হাসপাতালে ওর চিকিৎসা হচ্ছিল সেখানে রাখতে পারলে হয়তো ও বেঁচে যেত। কিন্তু কপর্দকহীন বাবা সেখানে রাখতে পারলেন না। আপাকে ট্রান্সফার করা হল সরকারি হাসপাতালে। সেখানে একটা বেড যোগার করতে লেগে গেল মাস। ফ্লোরে পড়ে থেকে আপা প্রায় মৃত। যখন বেড পেল তখন আর তার ভেতর বেঁচে থাকার কোনো শক্তি নেই। নূন্যতম চিকিৎসা সেবা না পেয়ে আপা মরে গেল।
পরিবেশ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। কোথা থেকে যে দুঃখের রাগ-রাগিনী উঠে আসে! আসলে প্রতিটা মানুষের মাঝেই লুকিয়ে আছে কিছু তীব্র দুঃখ। অনেক কিছু চাপা দিয়ে রাখা যায়। দুঃখ বোধহয় চাপা থাকে না। সুযোগ পেলেই বের হয়ে পড়ে।
বাবা চাইছিল আলোচনাটা যেভাবে এগোবার সেভাবেই এগিয়ে যাক। বাবা কাপে চা ঢালল। সবার হাতে এক কাপ চা তুলে দিল। নিলয় চায়ের কাপ নিল না। বলল, না, আমি এখন চা খেতে পারব না। আমার আপার মুখ মনে পড়েছে।
হাসান বলল, তোর আপার মুখ মনে পড়বে কীভাবে? সে তো মরে গেছে তোর জন্মের আগে।
নিলয় কিছু বলল না। কিছু কিছু মুখ হয়তো না দেখেও মনে করা যায়।
বাবা শব্দ করে চায়ে চুমুক দিল। মচমচ শব্দ করে টোস্ট বিস্কুটে কামড় দিল। আর সবাইও চা খেতে লাগল। পরিবেশটা পরিবর্তন হল। মা বললেন, হাসান, জঙ্গলে জ্যোৎস্না কেমন উপভোগ করলে? যা বলার সত্যি বলবে, কিছু বানিয়ে বলবে না।
আমার খুব ভাল লেগেছে আপা। অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে ইউনিক।
ইউনিক মানে কী আঙ্কেল?
হাসান তাকাল অন্তরের দিকে। বলল, তুমি বোধহয় ইংরেজিতে কিছুটা উইক। ক্লাশ এইটে  পড়ো, তোমার ইউনিক শব্দের অর্থ জানা থাকার কথা। পরে ডিকশনারি থেকে খুঁজে নেবে। আর প্রতিদিন ডিকশনারি থেকে বিশটা করে নতুন শব্দ শিখবে।
নিলয় বলল, দাদা, ইউনিক মানে কি অসাধারণ?
ঠিক আছে, অসাধারণ, অদ্বিতীয় এরকম।
বাবা নিলয়ের পিঠ চাপড়ে বলল, ব্রেভ এন্ড ব্রিলিয়ান্ট বয়।
অন্তর রক্তিম মুখ করে বলল, আরও কিছু দিন থাকো, তোমার খেতাবের অভাব হবে না।
মা বলল, যদি আমার গালে একটা মশা কামড় দেয় এবং সেটা তাড়াতে গিয়ে ঠাস করে গালে চড় খাই সেটাও কিন্তু ইউনিক ব্যাপার।
সেটা নেগেটিভ সেন্সের ইউনিক, আমারটা পজিটিভ....।
সত্যিই কি জঙ্গলে জ্যোৎস্না রাতের আলাদা কোনো ইফেক্ট পেয়েছো? যেমন-শেষ রাতটা ভৌতিক ধরনের। বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ। গাছপালাকে কি জীবন্ত মনে হয়েছে?
জি।
খুলে বলো।
আপা, কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা একান্তই নিজের। মনের সবটুকু অনভূতি মুখে প্রকাশ সম্ভব না। লেখক হলে দু/চার পাতা লিখে আপনাকে পড়তে দিতাম।
এ কথা তো মানবে যে, কোনো গুন্ডাপান্ডার সম্মুখিত তোমরা হওনি, তাহলে সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যেত।
কি যে বলেন! চন্দ্রা বনের ত্রাস-সরকারের পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসী এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সামনে। পিস্তলের ট্রিগারে আঙুল রেখে বলল, ঐ মান্দারপুত, যা আছে বাইর কর, নইলে দিমু ফালায়া।
মাজেদা হিহিহি করে হেসে উঠল।
বাবা বলল, এই মেয়ে খুব সহজ কথায় হাসতে পারে। এটা একটা ভালো গুণ। আর হাসি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
অন্তর বলল, এই জন্যই তো মাজেদা আমাদের সবার চেয়ে সুস্থ থাকে, শুধু মাঝে মাঝে সিনাত ঝরে, তখন টিস্যু পেপারের দরকার হয়।  
মা এসব কথায় কান না দিয়ে বলল, হাসান, তুমি আমার সাথে মজা করছো না তো?
এখানে মজা করতে আসিনি আপা। স্যার আমাকে ডেকে এনেছেন সত্যি ঘটনা যথার্থ বর্ণনা করতে। হুমায়ূন ফকির, জাফর ফারাবি আর হাবীব ফরাজী এই তিনজন মূর্তিমান যম হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সামনে।
তোমাদের টাকা, মানিব্যাগ দেবার পর তারা কি চলে গেল?
না, তারপরই তো ঘটল অবিশ্বাস্য সব ঘটনা।
কী রকম অবিশ্বাস্য ঘটনা?
এ পর্বটা স্যার বললে ভাল হবে। ওদের যা কথা হবার তা স্যারের সাথেই হয়েছে। স্যারের কথায়ই ওরা ম্যানেজ হয়েছে।
মা তাকাল বাবার মুখে। বাবা যেন কিছুটা উৎফুল্ল হল। হয়তো ভেবেছিল, মা হাসানের কাছ থেকেই সবটা শুনে নিবে, তার আর কিছু বলা হবে না। বাবা বলল, তার আগে ডিম ভাজি আর পরাটা খেয়ে নাও। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা পরাটা। হ্যাঁ, আমার মনে হয় এই ঘি-টা খাঁটি।
বাবা পরাটা খাওয়া শুরু করে দিল। হাসানও একটু পরাটা ছিড়ে মুখে দিল। বাবা বলল, হাসান, তুমি কিন্তু ভাত খেয়ে যাবে।
ডিম-পরাটা খাবার পর আবার ভাত খেতে পরব?
তার মানে তুমি আর রাতে ভাত খাবে না?
নাহ!
তুমি দেখছি তোমার আপার মতো। আমি যত কিছুই খাই না কেন, রাতে আমাকে ভাত খেতেই হবে, না হলে ঘুম আসবে না। মনে হবে কিছু খাইনি, পেট খালি।
পরাটা খাওয়া শেষ হলে চা হল। চা শেষ করে বাবা চোখ বন্ধ করে দুলে দুলে গাইতে লাগল-

জ্যোৎস্না মাখা চাঁন্দি রাইতে
আমার পরান করে অঁাঁইঠাঁই
এই দুনিয়ায় আমি আবার
মানুষ হইতে চাই।
মা রেগে উঠল, তোমার কাছে গান শুনতে চেয়েছি?
এখন যা শুনবে এই গানের সাথে তার সম্পর্ক আছে।
বলো, কী হল সেই গুন্ডাদের সাথে?
ওরা আমাদের সেলফোনের সীম ফেরত দিতে চাইল। আমি বললাম, সীমটা তত জরুরি না। আমাদের শ’দুয়েক টাকা দিলে ভাল হয়। ঢাকায় ফিরে যাব। এ কথা শুনে ওরা ভীষণ অবাক হল। ডাকাত দলের সর্দার বলল-তোরা ঢাকা থিকা আইছোস! এই রাইতের বেলা ঢাকা থিকা আইসা জঙ্গলে বইসা আছোস যে?
আমরা জ্যোৎস্না দেখতে এসেছি।
জ্যোৎস্না দেখতে! ঢাকায় জ্যোৎস্না নাই?
......এভাবে বাবা পুরো ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করল। বাবা খুব খুশি। এতটা সময় নিয়ে এবং এমন মনোযোগে এর আগে মা কখনো তার কথা শোনেননি। যে কোনো কথাই বাবাকে সংক্ষিপ্ত করে বলতে হয়েছে।
সবটা শুনে মা কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। বাবার কথা সবটা বিশ্বাস করতে পারছে কি পারছে না তা বোঝা যাচ্ছে না। সবার দৃষ্টি মা’র মুখে। তার মন্তব্য শোনার ইচ্ছা।
মা বলল, ওরা তোমাদের কিছু নেয়নি বা আটক করে টাকা-পয়সা দাবী করেনি নিছক জ্যোৎস্না দেখার জন্য তা ভাবা ভুল। নিশ্চয় এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে।
হাসান বলল, আপা, বর্তমান সময়ে মানুষকে বিশ্বাস করা কঠিন। তারপরও কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতে হয়। না হলে এই শব্দটার কোনো প্রয়োজনই থাকে না। তারা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী তা ঠিক। তারপরেও বলবো, তারা মানুষ। তাদের ভেতর কখনো না কখনো মনুষত্ব জেগে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের সাথে যে ব্যবহার করেছে তাতে তাদেরকে অবিশ্বাস করা অন্যায়।
হতে পারে তাদের সবটাই অভিনয়।
তাদের গানটার কথা ভাবুন। তারা আবার মানুষ হতে চায়। তারা আবার মায়ের কোলে শিশু হতে চায়। তারা মায়ের কোলে শুয়ে গান শুনতে চায়। গান শুনতে শুনতে নতুন জনম পেতে চায়। গান গাইতে গাইতে আমি তাদেরকে কাঁদতে দেখেছি। সে কান্নাটা অভিনয় হতে পারে না। আমরা আগামী পূর্ণিমায় আবারও যাব।
অন্তর বলল, মা, ওনারা তোমাকেও সাথে নিতে বলেছে।
অন্তরকে সাপোর্ট দিয়ে নিলয় বলল, জ্বি আপা, তারা আপনাকেও নিয়ে যেতে বলেছে।
এটাই তাদের আসল ফাঁদ।
অন্তর বলল, মা, বাবা তাদেরকে কথা দিয়ে এসেছে যে, পরের বার তোমাকেও সঙ্গে নেবে।
তোর বাপ যদি সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে কথা দিয়ে আসে যে, পরের বার তোর মাকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে, তাহলে তুই তোর মাকে যেতে দিবি? তোর বাপ যদি মানুষ খেকো কুমিরকে কথা দিয়ে আসে যে, পরের বার তোর মাকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে, তাহলে তুই তোর মাকে যেতে দিবি?
মা, তুমি তাদেরকে বাঘের সাথে তুলনা করছো কেন?
বাঘের চেয়ে ভয়ঙ্কর এই দেশে আর কিছু নেই বলে।
ওরা মানুষ।
না, ওরা মানুষ না। ওরা মানুষের জগত থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে।
অন্তর আর মায়ের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। বাবা বলল, আমি যে তোমাকে নিয়ে যাবই এমন কথা দেইনি। বলেছি, নেবার চেষ্টা করব।
ঐ হল।
হাসান, ওরা যেন কী একটা উদাহরণ দিল।
বাবা তাকাল হাসানের মুখে। হাসান মা’র মুখে তাকিয়ে বলল, আপা, ওরা বলল, কুকুর মানুষকে কামড়াতে পারে আবার প্রভূর জন্য জীবনও দিতে পারে।
[ক্রমশ...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট