অনাদির বসন্তকাল



অনাদির বসন্তকাল
মোস্তাফিজুল হক

বিধবা সালেহা বেগম ছেলের সংসারে সুখেই আছেন। তবু তাঁর প্রায় দেড়যুগ আগের কথা মনে পড়ে যায়। তখন অনাদি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। একদিন মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরেই বলতে লাগলো-
“মা, আর শীত ভালো লাগে না। স্যার বলেছেন, সবচেয়ে মজার ঋতু বসন্ত। এ কারণেই নাকি বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়।”
অনাদি প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “মা, বসন্তকাল কবে আসবে?”
মা জবাবে বলতেন, “এই তো আর ক’দিন পরেই বসন্ত আসবে। দেখছিস না, প্রকৃতি নতুন পত্রপল্লবে সেজে উঠছে। শীত তার হিমেল বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছড়ানো বন্ধ করেছে প্রায়।”
“মা, বসন্তে কি শীত একেবারেই চলে যায়?”- অনাদি জানতে চায়।
ওর মা জবাবে বলে, “শীত চলে গেলেও হিমেল বায়ু প্রবল ধাক্কা দিয়ে মাঝে মাঝে গায়ে কাঁপন তোলে। দুপুরের রোদ বেশ উত্তাপও বিলিয়ে দেয়। ঝলমলে বসন্ত আরো দুই সপ্তাহ পরে শুরু হবে, মা। আর এজন্যই সূর্যের আলো শীত থেকে মুক্তি পেতে ধীরে ধীরে তেজী হয়ে উঠছে।”
“মা, শীতটা যে কবে যাবে, একদম ভাল্লাগে না! বিছানা ছেড়ে উঠতেই মন চায় না। গোসল করতে ইচ্ছে করে না, খেতেও ভালো লাগে না।”
“হ্যাঁ মামণি, ঠিকই বলেছিস। এইতো শীত ফুরোলো বলে অলসতা কাটিয়ে মানুষ কাজের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠছে আর বিছানা ছেড়ে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে। অপরূপ মৌসুমী ফুল আর ফলের ঘ্রাণে বসন্ত যে অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত!”
“মা, বসন্তে কী কী ফুল ফোটে?”
“বসন্তে শিমুল, পলাশ, রুদ্রপলাশ, ভাঁটফুল, পলকজুঁই, মাদার, মহুয়া, অশোক, আকড়কাঁটা, শাল, ক্যামেলিয়া, স্বর্ণশিমুল, হিমঝুরি, গামারি, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, ঘোড়ানিম, মণিমালা, মহুয়া, বাতাবিসহ কত কি ফুল ফোটে! আম, লিচু, জামের মুকুলে ছেয়ে যায় গাছপালা।”- অনাদির মা মেয়ের প্রশ্নের জবাবে একদমে এতগুলো ফুলের নাম বলে দিলেন।
আজ ক’দিন থেকেই মেয়েটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কথাবার্তা বলছে।
ঋতুরাজ বসন্ত দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রকৃতি এখন ফুলের রাজ্য, ভরা বসন্ত মৌসুম। যেদিকেই চোখ যায়, শুধু ফুল আর ফুল। অনাদি সময় পেলেই ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে। শিমুল বনে মনের সুখে নেচে বেড়ায়। বাড়ির আঙিনায় চিরসবুজ লম্বাটে পাতার চাঁপাগাছ। চাঁপাতলায় বসে পুতুল খেলে। বর ও কনের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে সামান্য ফাঁকে সূর্যমুখী ফুলের খেতে প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়ায়।


আজ আবার সেই ভরা বসন্ত মৌসুম! হালকা হলুদ চাঁপাফুলের গন্ধে অনাদির মায়ের বুকে চাপাপড়া মেয়ের মুখের উচ্ছ্বল হাসি গুমরে গুমরে কাঁদছে! বাতাসে হুহু করে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাবিফুলের ঘ্রাণ! এ যেন অনাদির মুখের মধুর বোল!

এদিকে জানলার পাশেই নাগকেশর ফুলের সমারোহ। এফুলের মতোই ধবধবে ফর্সা ছিল মেয়েটা। ওর গোলাকার মুখ, গায়ের রঙ আর নাগকেশর ফুলের পাঁপড়ির রঙ যেন একই। ফুলটা শুধুই সুন্দরী আর সুগন্ধিই নয়, বেশ কাজেরও। অনেক ঔষুধি গুণ আছে। ঠিক তেমনই ছিল অনাদি। ওর কথা ভেবে ওর মা যেন মনেমনে অরণ্যের অগ্নিশিখা হয়ে ফুটে উঠতে চায়। যেন তাঁর শহিদ স্বামীর মতোই রুদ্রপলাশ হয়ে সমাজ থেকে সমস্ত কলুষিত আত্মাকে দূরীভূত করতে চায়।

সূর্যের তেজ নিয়ে অনাদির বাবা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেন। অনাদি তো সেই বীর যোদ্ধার মেয়ে। অথচ নিষ্পাপ সেই মেয়ের কোমলদেহ ক্ষুধার্ত নেকড়েরূপী নরপশুরা রক্তাক্ত করেছে! অনাদি নরপশুদের লালসার শিকার হয়ে দেড়যুগ আগে ঘুমিয়ে গিয়েছে; তাও আবার সূর্যমুখী ফুলের মাঠে! তাই আজও যেন অনাদির মা’র চোখে ঘুমিয়ে আছে অনাদির বসন্তকাল, আর তাঁর চোখের গভীরে ফুটে আছে দ্রোহের রুদ্রপলাশ!


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট