চৈত্রের দুপুরে



চৈত্রের দুপুরে
জুয়েল আশরাফ

২০২১ সাল।
চৈত্র মাসের ঝাঁঝাল রোদের দুপুর।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে রিকসাটা ধীর গতিতে এগোচ্ছে। রিকসাচালক স্থানীয় হাই স্কুলের গণিত বিভাগের শিক্ষক। যাত্রী একজন আমেরিকান তরুনী। বিস্তীর্ণ মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছে তারা। এই মাঠে অল্প দিন পরেই বৈশাখের মেলা বসবে। গত বছর করোনার মহামারীতে সারা দেশে বিয়েশাদি-বৈশাখের অনুষ্ঠানসহ সব নিষিদ্ধ ছিল। এ বছর জমজমাট মেলা হবে।
পিচঢালা রাস্তা না হলেও কাঁচা রাস্তায় অসুবিধে হচ্ছে না লিলিয়ানার। দু পাশের দৃশ্য দেখে মায়া হচ্ছে। মাটির মায়া, গাছের মায়া, পথের মায়া, ছায়ার মায়া। সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষের মায়া। লিলিয়ানা বিস্ময়ে লক্ষ্য করল তার চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও গড়াচ্ছে না। গড়াবে, জায়গা  মত পৌঁছে যাবার পর শুধু জল নয় রক্তও গড়াবে। রক্ত গড়ানোর কথায় মনে পড়ল, ইবরাহীম বলেছিল- কেয়ামতের দিন আফসোস করা মানুষগুলির চোখ থেকে যখন জল আর বের হবে না এরপর চোখ থেকে বেরোবে রক্ত!
স্টিশনে পৌঁছে সে কেঁদে ফেলল। রিকসাওয়ালা মানুষটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভাড়া দেয়া হয়ে গেছে। তার কান্না দেখতে দাঁড়িয়েছে। অসম্ভব রূপবতী বিদেশী মেয়েরা কীভাবে কাঁদে- এই দৃশ্য দেখে যাবে।
মানুষটি ইংরেজীতে বলল, আপনার ব্যাগ ছেড়ে এসেছেন।
সে ভুলেই গিয়ে ছিল তার সাথে একটা ব্যাগ রয়েছে। রিকসা থেকে নামতে যাবার সময় এত বড় জিনিসটার কথা মনে পড়ল না! লিলিয়ানা স্পষ্ট বাংলায় বলল, আমি বাংলায় কথা বলি। বুঝতেও পারি। আপনি আমার সাথে বলুন বাংলা।
মানুষটি অল্প হাসল। সে জানে, তার বাংলা উচ্চারণের কারণেই মানুষটির হাসি পাচ্ছে। যখন থেকে সে বাংলা শিখে বলতে চেষ্টা করছিল এবং সাত বছরে অনর্গল বাংলা বলছিল, ইবরাহীমও হেসে উঠতো আর বলতো- ‘তোমার বাংলা উচ্চারণ আমার দেশের মানুষের উচ্চারণ থেকে অনেক রোমান্টিক আর শ্রুতিমধুর। শুনলেই কান আরাম পায়।’
মানুষটি বলল, আপনি কোথায় যাবেন?
-ঢাকায়।
-ঢাকার ট্রেন আসবে দুপুর তিনটায়।
সে বুঝল দীর্ঘ সময় আগে এসে পড়েছে।
মানুষটি বলল, আমার নাম জামান। আমি এখানকার হাই স্কুলের শিক্ষক। আমার সহকর্মীর সঙ্গে বাজি লাগিয়েছি, যাত্রী উঠিয়ে এক ঘন্টায় যার কম আয় হবে শ্রেণীকক্ষের সমস্ত ছেলেমেয়েদের তার খাওয়াতে হবে। আমার সহকর্মী এক ঘন্টায় আয় করেছে সত্তুর টাকা। আমার এক ঘন্টা শেষ হতে পনেরো মিনিট বাকি। আমার আয় হয়েছে পঁচিশ টাকা। বোঝাই যাচ্ছে বাজিতে আমি হেরে গেছি। সহকর্মীর শ্রেণীকক্ষের সবাইকে আমারই খাওয়াতে হবে।
মানুষটির কথা পুরোপুরিভাবে বোঝা গেল না। শুধু বোঝা গেল তিনি স্বুলের একজন শিক্ষক। স্কুলে পড়ানো রেখে রিকসা কেন চালাচ্ছে বোঝা গেল না।
-আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?
-খাদিজা।
ইবরাহীমের দেয়া নামটি বলল লিলিয়ানা। তার আসল নাম কাউকে সে বলে না।
-আপনি আমেরিকান?
-হ্যাঁ। নিউ ইয়র্ক।
-কোথায় গিয়ে ছিলেন?
-ইবরাহীমের বাড়ি। ইবরাহীমের কবর দেখতে এসেছি।
-পাশের গ্রামের ইবরাহীম? গত বছর আমেরিকা থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এসে অল্প দিনেই মারা গেল যেই ইবরাহীম?
লিলিয়ানা শ্লেষ্মাজড়িত গলায় বলল, হ্যাঁ।
মানুষটাকে বিস্মিত হতে দেখা গেল। বলল, ইবরাহীম মরে গেছে এক বছর হলো। কবর দেখতে সূদুর আমেরিকা থেকে এসেছেন?
-হ্যাঁ।
আপনার সাথে ওর কি সম্পর্ক?
-বন্ধু।
মানুষটির চোখ দেখে লিলিয়ানা বুঝতে পারল, বন্ধু-সম্পর্ক কথাটা বিশ্বাস যোগ্য না। সাত সমুদ্র পারি দিয়ে শুধু বন্ধুর খাতিরে এতদূর কেউ আসবে না। ইবরাহীমদের বাড়িতেও কেউ বিশ্বাস করে নি। একটা গোপন ব্যাপার রয়েছে। সেটা বুঝতে ইবরাহীমের পরিবারসহ আশেপাশের লোকজন দুদিন খুব চেষ্টা করছিল। গ্রামশুদ্ধ লোক তাকে দেখার জন্যে ভিড় করেছে। দুদিন ইবরাহীমদের বাড়িতেই সে ছিল। রোজ ইবরাহীমদের পারিবারিক কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতো। এই গ্রামের সবকিছুই যেন লিলিয়ানার চেনা। দশ বছরে নিজের গ্রামের এত বর্ণনা ইবরাহীমের মুখ থেকে শুনেছে সে! শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে আছে গ্রামের দৃশ্যপট। চলে আসার সময় ইবরাহীমদের বাড়ি থেকে গাড়ি ঠিক করে দেয়া ছিল, এবং স্টিশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবার লোকও ঠিক করা ছিল। সঙ্গে কেউ আসুক সেটা সে চায় নি। একাই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে এবং কিছুদূর এসে গাড়িটাকেও সে ছেড়ে দিল, শুধু একটা রিকসার জন্য।
ইবরাহীমের মুখে এই যানবাহনটির কথা বহু শুনেছিল সে। মাঝে মাঝে নেটে সার্চ দিয়ে ছবিতে দেখাত ইবরাহীম। প্রিয় যানবাহন। প্রিয় মানুষের প্রিয় যানবাহনে চড়ে সে স্টিশনে চলে এসেছে
রিকসাচালক মানুষটি রিকসা থেকে ব্যাগটি নামিয়ে তার সামনে রেখে দিয়ে বলল, ছায়ায় গিয়ে বসুন। এ পাশটায় রোদ অনেক।
-ধন্যবাদ
-এই টাকাটা রাখুন। আপনি আমার দেশের অতিথি। তাছাড়া আমি পেশাদার কোন রিকসাচালক নই। এক ঘন্টার বাজির রিকসাচালক।
অনিচ্ছাস্বত্ত্বে টাকাটা নিল লিলিয়ানা। মানুষটি বলল, আপনার ভ্রমণ আরামদায়ক হোক।
-ধন্যবাদ।
মানুষটি সৌজন্যসহকারে বিদায় নিল। সে বসে থাকল রোদমাখা শরীরে। স্টিশনে কৌতূহলী মানুষগুলি যাওয়া-আসায় তাকে দেখে যাচ্ছে। একসময় হুইসেল বাজিয়ে এলো ট্রেন। ব্যাগ হাতে নিল। ব্যাগের ভেতর ইবরাহীমের ছোটবেলার জিনিসপত্র। দুদিন ইবরাহীমের যাবতীয় জিনিস সংগ্রহ করে এনেছে সে। কিছুই ছেড়ে আসেনি। ছেড়ে আসতে পারেনি। মায়া করে জিনিসগুলি সাথে করে এনেছে, সাথে করেই চলেছে। বুকের পাঁজরে এই মায়া বয়ে বেড়াতে হবে অনেককাল।
দ্বিতীয়বার হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলল।

নবাবগঞ্জ, ঢাকা।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট