ভ্রমণকাহিনী : পর্ব : ০১ : মুর্শিদাবাদ- পথে প্রান্তরে ইতিহাস



মুর্শিদাবাদ 

পথে  প্রান্তরে  ইতিহাস

মাজরুল ইসলাম


মুর্শিদাবাদ নামকরণ ঘিরে নানা মত প্রচলিত আছে। জেলা হিসেবে মুর্শিদাবাদ-এর জন্ম ১৭৮৬ সাল। কিন্তু তার আগে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী ছিল। মুর্শিদকুলী খাঁর আগে এই জেলার নাম ছিল মুখসুদাবাদ। তারও আগে ছিল মাসুমাবাজার। এই জেলার নামকরণের  ৩১৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমান মুর্শিদাবাদ দেশ, উপমহাদেশ ও বিশ্বের পর্যটকদের হাতছানি দেয়। মুর্শিদাবাদ এক সময় প্রধান তিনটি শাসন ব্যবস্থার রাজধানী ছিল। বাংলার স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ, মহীপালের রাজধানী মহীপালে এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী  মুর্শিদাবাদ ঐতিহাসিক নগরীতে ছিল। ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হলে যেমন ঢাকার গৌরব ক্ষীণ হতে থাকে তেমনি মুর্শিদাবাদের লালবাগ শহরের চরম শিখরে পৌঁছায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর রণাভিনয়ের পরে বঙ্গের সৌভাগ্যলক্ষীর বিপর্যয় ঘটে। ১৭৬৫ সালে ক্লাইভ নবাবদিগকে শাসন কার্য থেকে অপসৃত করেন। এবং পেনশন প্রদান করেন। এই সময়ে নবাবদের ‘নবাব’ উপাধি মাত্র থাকে। এই উপাধিও ১৮৪৫ সালের পর উত্তরাধিকারী অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নবাবরা কেউ স্বাধীনভাবে কেউ আবার পুতুল নবাব সেজে প্রায় ৫০/৬০ বছর বাংলা বিহার উড়িষ্যা শাসন করেছেন। সেই সময় থেকে মুর্শিদাবাদ তথা লালবাগ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে ঐতিহাসিক বাড়ি, অসংখ্য মসজিদ, মন্দির,মঠ, গির্জা, আখড়া ও প্রাসাদে পরিপূর্ণ ছিল। গুপ্ত-হত্যা, হাসি- কান্না, রাজা-প্রজা, এবং স্থাপত্য মুর্শিদাবাদের ভূমি। মুর্শিদাবাদ জেলার বুক জুড়ে রয়েছে মন-হরন পর্যটন কেন্দ্র। নবাবী আমল থেকে এখানকার ভূমিথথ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। পদে পদে ঐতিহাসিক স্থান, নিদর্শন ও চিহ্ন ছিল। তবে পরিতাপের বিষয় হল কিছু কিছু স্থাপত্য টিকে থাকলেও পূর্বের অনেক স্থাপত্য বর্তমানে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে।

ইতিহাস এমন একটি বিষয় যা জাতীয় জীবন চেনার বা সংশোধনের একমাত্র উপায়। ইতিহাস প্রাণ কিছু ব্যক্তি জেলার ইতিহাস লিখে জেলার কল্যান সাধন করেছেন। কিন্তু আজও বোধহয় মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি। এই জেলার প্রতিটি ধুলিকণার সঙ্গে অসংখ্য হিন্দু-সাধক, মসুলমান-পিরের করুন ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত হয়ে আছে।              

যে স্থান সুদীর্ঘ কাল ধরে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী পরিগণিত ছিল, তার বিস্মৃত বিবরণ জানার কার না ইচ্ছে হয় ? বিশেষতঃ মুর্শিদাবাদের তিনশো বছরের অধিক ইতিহাস নিয়ে চর্চার যথেষ্ট অবকাশ থেকে গেছে। পুরাকীর্তি, পুরানো পুঁথি, প্রাচীন মুদ্রা, দেবদেবীর মূর্তি, শিলালিপি থেকে আমরা আমাদের প্রাচীন জাতীয় জীবনের সন্ধান পেতে পারি।

২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বলা যেতে পারে মুর্শিদাবাদ জেলার আয়তন ৫৩২৪ বর্গ কি.মি.। আনুমানিক জনসংখ্যা ৫৮৬৬৫৬৬৯ জন।


বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের একটি জনবহুল পর্যটন শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে সমমৃদ্ধ এই শহরের জনপ্রিয়তা কেবল তার প্রাচীন প্রকৃতির জন্য নয়। বরং বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষীর প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প নিদর্শন বিস্ময়কর উদাহরণ হয়ে এই শহরের ইমারতগুলি আজও মরে বেঁচে আছে। এই জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত। ভৌগোলিক দিক দিয়ে এজেলার অবস্থান বিচিত্রময়। পুর্বে অধুনা বাংলাদেশ, দক্ষিণে নদীয়া, উত্তরে মালদা এবং পশ্চিমে বীরভূম। ভাগীরথী নদী জেলাকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। উভয়েরই সদর শহর বহরমপুর। বহরমপুর, লালবাগ, কান্দি, জঙ্গিপুর ও ডোমকল। একেবারেই কৃষি প্রধান জেলা। আরও একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ হল ভারতের যে ক’টি জেলা মাত্র সংখ্যা লঘু অধ্যুষিত তারমধ্যে মুর্শিদাবাদ একটি। জেলার কৃষকরা বেশির ভাগই সংখ্যালঘু মুসলমান। এই জেলার অসাম্প্রদায়িক জেলা বারে বারে সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেছে। যেমন, ১৯৮৫ সালে কাটরা মসজিদের ঘটনা কেন্দ্র করে একই সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ শহিদ হলেও জেলা জুড়ে শান্তির বার্তা দিয়েছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনার পর মুর্শিদাবাদ ছিল ঘটনাবিহীন। ১৭৫৭ সালের আগে ভাস্কর্য পন্ডিতের নেতৃত্বে এই জেলা কয়েক বার লুণ্ঠিত হবার কথা সর্বজনবিদিত। ১৭৫৭ সলের পর প্রকৃত অর্থে চেহেলসেতুনের খাজাঞ্চিখানা লুণ্ঠন করে গেছে ইউরোপীয় দেশের বণিকের ছদ্মবেশে আসা দস্যু ও ইংরেজরা। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধজয় থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ থেকে কয়েকশো বজরা ভর্তি সোনা, স্বর্ণমুদ্রা রুপোরমুদ্রা, অন্যান্য দামি সামগ্রী স্বদেশে পাচার করে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০ সালে এই তিন বছর কোম্পানি পুতুল নবাব মীরজাফরের নিকট থেকে উপোঢৌকন বাবদ আদায় করে ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা মীরজাফর এছাড়াও কোম্পানির কর্মচারীদের দিতে বাধ্য হয়েছিল নগদ ভাতা ও পুরস্কার দানের নাম করে ৫৯ লক্ষ টাকা। পরের পাঁচ বছরে আরও ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। এছাড়াও কোম্পানির বাড়তে লাভ ৮ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা, ভূমিরাজস্ব বাবদ ৫৬ লক্ষ টাকা।

জনশ্রুতি আছে, মুর্শিদাবাদ শহরে ছোট বড় মিলে ৫৭০ টি মসজিদ ছিল। এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ছিল ২৯৬ টি। লালবাগ শহরে পাঁচটি বাউলির খবর পাওয়া গেলেও চারটি স্থান নির্নয় করা যায়, একটির স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। যেগুলোর স্থান নির্নয় করা যায়। যথা বিডিও মোড়, বনমালীপুর, চকমসজিদ ও কাঠগোলা। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলায় সাতটি গোলার খবর পাওয়া যায়, যথা- ভগবানগোলা, লালগোলা, সুপরিগোলা, আজিমগঞ্জগোলা (ডোমকল), চরবলণগোলা, গোলাবাড়ি ও কারাগোলা। ইংরেজরা এই শহরকে লন্ডনের চেয়ে সুন্দর, জনবহুল এবং সমৃদ্ধ বলেছে। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে শাহেন শাহ ফারুকশিয়রের নিকট থেকে রাজস্ব আদায়ের সনদ পেলে তারা কাশিমবাজার, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে কুঠি গড়ে এবং তখন থেকে একটু একটু করে লালবাগের গৌরব হারাতে বসে। তার পরও যেটুকু ছিল ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীতে ৮/১০ ঘণ্টার পুতুল খেলা হয় এবং সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর আরও শেষ হল।

সপ্তম শতাব্দীর শুরুতেই গৌড় রাজ্যকে এক প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম পরাক্রান্ত রাজ্য গৌড়ের অধিপতি মহারাজ শশাঙ্ক বাংলার ইতিহাসে প্রথম সার্বভৌম নরপতি ছিলেন। তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ তাঁর সময়েই গৌরবের চরম সীমায় পৌঁছে ছিল।


কর্ণসুবর্ণ: ৬০০-৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বলাবাহুল্য বাংলার প্রথম স্বাধীন মহারাজা শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ন। প্রাচীন রাজ্যের মধ্যে কর্ণসুবর্ন সুবিশাল বলে মনে করা হয়। প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটি বা কর্ণসুবর্ন বিশেষ স্মরণীয় স্থান। এমন কি ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়াদের বেশ বড়সড় রেশমের কুঠি ছিল। এই স্থানকে স্বাস্থ্যনিবাস মনে করা হত। কোম্পানির আমলের সাহেবরা এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতেন। ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ থেকে খনন করে প্রচুর ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া  গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পোড়া মাটির সীলমোহর। যার গায়ে উৎকীর্ণ ধর্মচক্র- প্রতীকের নিচে দু’লাইন লিপিতে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের উল্লেখ আছে।  রাঙামাটির বেশির ভাগ ভাগীরথী গ্রাস করছে। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ এসেছিলেন। তিনি দু’হাজার বৌদ্ধ শ্রমিকের বসবাস ছিল বলে বর্ণনা করেছেন। কর্ণসুবর্নে গুপ্ত বংশীয় রাজারা বহুদিন রাজত্ব করেছিলেন। এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ সুপ্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষের স্তুপ থেকে বহু প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গেছে। খননকার্য চালালে এখনও হয়তো বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যেতে পারে। [ক্রমশ]




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট