পোস্টমর্টেম

 



পোস্টমর্টেম

আকিব শিকদার 


পোস্টমর্টেম কাকে বলে জানো? 

নীলাদ্রির যে বয়স, সেই বয়সে পোস্টমর্টেম কাকে বলে জানার কথা নয়। অনিমেষ চাচ্চুর প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে তার মাথা নিচু হয়ে গেল। লজ্জাবতি লতায়ের স্পর্শ লাগলে পাতাগুলো যেমন ক্রমান্বয়ে নিচু হয়ে যায়, অনেকটা সেই রকম কান্ড। 

অনিমেষ চাচ্চু বললেন- “মানুষের অপঘাত মৃত্যু ঘটলে সেই মৃত্যুর কারণ জানতে আইনি তদন্তে লাশকে যে কাটা ছেঁড়া করা হয়, সেটাই পোস্টমর্টেম। একবার পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে কী ঘটনা ঘটেছিল, শুনতে চাও?” 

গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে! লোডশেডিং এর রাত থাকলে আর আকাশে চাঁদ থাকলে ছাদে বসে গল্প শোনার মজাই অন্যরকম। যাই হোক, অনিমেষ চাচ্চু যে বিষয়টা বলতে চাচ্ছেন, সেটা তো আর গল্প নয়; তারই জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। তবে বিষয়টা যে ভুতুড়ে হবে, নীলাদ্রি তা অনেকটা আন্দাজ করতে পারছে। কারণ ব্যাপারটা লাশ কাটাকাটি নিয়ে। সে বলল- “কি ঘটেছিল চাচ্চু?” 

আকাশের ঠিক মাঝখানটায় আশ্বিন মাসের চাঁদ, রূপার থালার মতো জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আবছা আলোয় হাতলওয়ালা চেয়ারটায় নড়ে চড়ে বসলেন অনিমেষ চাচ্চু। তারপর বলতে শুরু করলেন- “দিনটা ছিল মঙ্গলবার। অলক্ষণে দিন। নাম মঙ্গল, অথচ পৃথিবীর সব অমঙ্গল যেন এই দিনেই ঘটে। রাত নয়টার দিকে একটা ছাই রঙা পিকআপ এসে লাশ কাটা ঘরের সামনে থামল। লাফালাফি করে দুজন পুলিশ নামলেন গাড়ি থেকে। গাড়ির পেছনের অংশের দরজা খুলে পুলিশ দুজন ধরাধরি করে বের করে আনলেন একটা মৃতদেহ। লাশটা বাঁশের চাটাই দিয়ে শক্ত করে মুড়িয়ে রাখা। নলকূপের মোটা পাইপের মতো দেখতে। তবে লাশটার যে বেশ ওজন আছে, তা বুঝা গেল পুলিশ দুজনের হাঁটার ভঙ্গি দেখে। ভারী জিনিস বহন করলে পা দৃঢ়ভাবে ফেলতে হয়, মুখের চামড়া শক্ত হয়ে থাকে। মৃত দেহটা লাশ কাটা ঘরের বারান্দায় লম্বালম্বি ভাবে রাখা হলো। 

অনিমেষ চাচ্চুর কথা শুনে নীলাদ্রির কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। মানুষের লাশ বলে কথা। বাঘ মরলে সমস্যা নেই, ভাল্লুক মরলে সমস্যা নেই, সিংহ মরলে সমস্যা নেই, কিন্তু মানুষ মরলেই বিপদ। মানুষের মৃত আত্মা নাকি ভূত হয়ে ঘোরাঘুরি করে। অনিমেষ চাচ্চু বলেই চলছেন- “পুলিশ দুজনের একজন চাটাই এর বাধন খুললেন। লাশটা মধ্যবয়সী মানুষের। চল্লিস-পয়তাল্লিশের মত বয়স হবে। দাড়ি সেভ করা, তবে গোঁফ আছে। কুচকুচে কালো মোটা গোঁফ। আম গাছের ডালে ফাঁসি নিয়ে মরে ছিল লাকটা। গলায় দড়ির দাগ লেগে আছে। চোখ দুটা অসম্ভব রকমের বড় বড়। কাঁকরার চোখের মতো কুঠুরির বাইরে বেরিয়ে এসেছে যেন। জিহ্বাটা প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা হয়ে ঠোঁটের উপর দিয়ে ঝুলে আছে, কুকুরের জিব্বা যেমন ঝুলে থাকে। রূপকথার রাক্ষসের মত লাগছে দেখতে। মানুষের জিহ্বা লাল, তবে এ লোকটার জিহ্বা কালো। ফাঁসি নিয়ে মরলে রক্ত জমাট বেঁধে জিব্বা কালো হয়ে যায়। আমি লাশটার দায়িত্ব বুঝে নিতেই পুলিশ দুজন পিকাপটায় চড়ে চলে গেল। তখন লাশ কাটা ঘরে মৃতদেহটার সামনে আমি একা। পোস্টমর্টেম তো আর সন্ধ্যা রাতে করা হয় না, পোস্টমর্টেম করতে হয় মধ্যরাতে। খুব সিগারেট ফুকতে ইচ্ছে করছিল। পকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেট নেই। এদিকে কেউ আসেও না যে তার কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নেওয়া যাবে। ভাবলাম দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনলে মন্দ হয় না। লাশ কাটা ঘর থেকে একটু দূরেই একটা মোদির দোকান আছে। মৃতদেহটাকে চাটাই দিয়ে আগের মত শক্ত করে মুড়িয়ে রেখে দোকানটার দিকে রওনা দিলাম। এক কাপ চা খেয়ে আর দোকানীর সাথে কয়েকটা টুকিটাকি কথা বলে ফিরে আসতে একটু দেরি হলো। সিগারেট ফুকতে ফুকতে লাশ কাটা ঘরের বারান্দায় এসে কী দেখলাম জানো?” 

নীলাদ্রিদের বাসার ছাদে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে নীলাদ্রির। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটা ঢোক গিলে নিয়ে সে ছোট্ট করে জানতে চাইলো- “কী” 

অনিমেষ চাচ্চু বলতে থাকলেন- “বাঁশের চাটাইসহ লাশটা যেন নড়েচড়ে উঠছে। চাটাই এর ভেতর থেকে একটা গুমগুম শব্দ শোনা গেল। শব্দটা মানুষের কন্ঠের মত নয়। ভূত টূত নয় তো আবার! বারান্দায় সুডিয়াম লাইট জ্বলছে, ভূত আসবে কেমন করে! ভূত আলো ভয় পায়। ভূত হোক, আর যাই হোক, লাশটার কাছে ভিড়তে সাহস পেলাম না। লাশ কাটা ঘরের পাশেই সপ্তর্ষিদের বাড়ি। সপ্তর্ষি আমারই মতন লাশ কাটার চাকরি করে। সে প্রতিদিন আমাকে লাশ কাটার বেলায় সাহায্য করে। সেদিনও তার আসার কথা ছিলো। সেখান থেকে এক দৌড়ে ছুটে গেলাম তাদের বাড়িতে। সপ্তর্ষি আমার চেয়ে বয়সে কম, কিন্তু সাহস আছে অনেক। অনেক  দুঃসাহসী কাজ একাই করতে পারে সে। ভূতপ্রেতে ভয় পাওয়া তার সংবিধানে নেই। একটা লম্বা লাঠি হাতে সে লাশটার কাছে গেল। যাবার আগে লুঙ্গিটাকে শক্ত করে নেংটি বেঁধে নিয়েছে, যাতে কোনো সমস্যা না হয়। লাশটার নিরাপদ দূরত্বে ঝুঁকে ধারালো সে। ডান হাতে লাঠিটা নিয়ে বাম হাতে চাটাই এর বাঁধন খুললো মাত্র। অমনি এটট৬কটা খেকশিয়াল পরিমড়ি করে বেরিয়ে গেল চাটাই এর ভেতর থেকে। মরা মানুষের গন্ধ পেয়ে এসেছিল মাংস খাওয়ার জন্য। শিয়ালটার ভাগ্য ভালো, আরেকটু হলে প্রাণ দিতে হতো সপ্তর্ষির লাঠির আঘাতে। রাত বারোটার দিকে শুরু হল পোস্টমর্টেম। গলা পেট পিঠ কেটে পরিক্ষা নিরিক্ষা। পরীক্ষাটা খুব সূক্ষ¥ভাবে করতে হবে। ফলাফলের উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। লোকটা নাকি আত্মহত্যা করেনি। শত্রুপক্ষের কেউ একজন নাকি লোকটাকে গলা টিপে মেরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে। পোস্টমর্টেমের ফলাফলেই বলে দেবে এটা আত্মহত্যা নাকি শত্রুপক্ষের হত্যাকা-ের সাজানো নাটক। পরীক্ষার জন্য লাশটার পেট কেটে কলিজা ও ফুসফুস রেখে দেওয়া হলো। ভোর রাতের দিকে সেই পিকআপে চড়ে কয়েকজন পুলিশ এসে লাশটা নিয়ে গেল।  লাশটার কলিজা ও ফুসফুস রেখে দেওয়াতেই হলো সমস্যাটা। 

অনিমেষ চাচ্চুর বর্ণণা শুনে নীলাদ্রীর খুব ভয় লাগছে। ভয়ে তার চোখের কোনায় পানি এসে গেছে। এক পা দুই পা সরে এসে সে অনিমেষ চাচ্চুর হাতলওয়ালা চেয়ারটার সাথে মিশে দাঁড়িয়েছে। চাচ্চু চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেই চলছেন- “লাশটা চাটাই দিয়ে মুড়িয়ে শক্ত করে বেধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পথে সে বাধন খুলে গেল। পুলিশেরা গিয়েছিল লাশটা পুনরায় মুড়িয়ে দিতে। তারা শোনলো লাশটা কথা বলছে, ‘আমার কলিজা কই? আমার ফুসফুস কই? আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে। কলিজা ছাড়া, ফুসফুস ছাড়া আমি যাব না তোদের সাথে। আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে।’ কী ভুতুড়ে কান্ড! পুলিশেরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল কান্ড দেখে। কিছুতেই তারা লাশটাকে চাটাই দিয়ে মুড়াাতে পারছিল না। ফজরের আজান শোনার পর অবশ্য লাশটা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল।” 

নীলাদ্রির হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। কারেন্ট এসেছে। রাস্তায় সোডিয়াম লাইট জ্বলছে। অনিমেষ চাচ্চু তবু বলেই চলছেন- “তারপর বেশ কয়েক দিন কে যেন লাশ কাটা ঘরটার চারপাশে ঘুরে বেড়াতো। শুকনো পাতা ঝড়ার মতো পায়ের আওয়াজ শোনা যেত। আর শোনা যেত ফিসফিসানু শব্দ, ‘আমার কলিজা কই? আমার ফুসফুস কই? আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে।’  এখনো মাঝে মাঝে একা একা বসে থাকলে শুনি কানের কাছে মুখ এনে কে যেন বলছে, বেশ শব্দ করেই বলছে, আমার কলিজা কই? আমার ফুসফুস কই? আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে।” 

এখন অনিমেষ চাচ্চু সম্পর্কে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনিমেষ চাচ্চু জীবনটা কাটিয়েছেন কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালের পোস্টমার্টেম ইউনিটে কাজ করে। রাত বিরাতে লাশ কাটাকাটিই কাজ। গত তিন মাস ধরে তিনি আর কাজে যান না। এই লাশ কাটাকাটির কাজটা নাকি তার আর ভালো লাগে না। বয়স হয়েছে, শরীর আর কত কুলাবে! তার চেয়ে বড় কথা ইদানিং কী একটা রোগ দেখা দিয়েছে তার। একা একা বসে থেকে বিড়বিড় করে কী সব বলেন তিনি। সেসব কথার কোন অর্থ থাকে না। ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকার রামপুরায় নীলাদ্রিদের বাসায় এসেছেন অনিমেষ চাচ্চু। ডাক্তার বলেছেন রোগটা শারীরিক নয়, মানসিক। অনিমেষ চাচ্চুকে একজন ভালো মনোচিকিৎসক দেখাতে হবে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট