দিপা

 


দিপা

শফিক নহোর



দিপা আমার দুবছরের ছোট। সম্পর্ক ভিন্নতর হলেও সে আমার খেলার সাথী। স্কুলে আমরা দুজন একসঙ্গে যাওয়া আসা করতাম। স্কুল ছুটির দিনে মাটি দিয়ে বিভিন্ন খেলায় মগ্ন থাকতাম সর্বক্ষণ। পুতুলবউ, পলান-টুকটুক, বৌছি, গোল্লাছুট, সাঁতার, বিলের জলে শাপলাফুল তুলে দিপাকে বউ সাজিয়েছি অনেকদিন- তা অগণিত ।

চড়–ইভাতি খেলে সময় পার করতাম। পূজার ভেতর হিন্দু বাড়িতে নাড়–, আর খই, খেয়ে হারিয়ে যেতাম। এ পাড়া থেকে সে পাড়া। ঘুরে বেড়াতাম ইচ্ছামত। নারকেল পাতার চশমা, ঘড়ি হাতে পরে ঘুমিয়ে যেতাম কখন তা টের পেতাম না। সকালে ওঠে যখন দেখতাম আমার ঘড়ি, অথবা চশমা ভেঙ্গে গেছে। অভিমানে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো নোনাজল। নিপুণ কারুকাজ করে ঠিক করে দিত আমার সাধের সেই নারকেল পাতার ঘড়ি, আর চশমা।


‘আজ বন্দি হয়ে গেছে থ্রি জি নেটওয়ার্কের মাকড়সার জালে মিথ্যা প্রেমের মোহমায়ায়। বৃষ্টিতে ভিজে কাঁক হয়ে ফিরে যেতাম বাড়িতে। পেছন ফিরে দিপা বার -বার আমাকে দেখতো। আমি পেছনে ফিরে তাকাতে গিয়ে পরে গিয়েছিলাম কাদার ভেতর ও তা দেখে মুচকি হেঁসে কুটিকুটি হত। পাগলিটা আমার এত খেয়াল রাখতো। মেয়েরা বুঝি একটু খেয়ালি হয় পুরুষ মানুষের তুলনায়। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে বর্ষার দিনে হারিয়ে যেতাম। ভেসে যেতাম দূরে কোথাও। কত রকম মজা যে করতাম। লগি হারিয়ে ফেলেছি একদিন। সে কি -যে কান্না আমি বুক পানিতে নেমে কলাগাছের ভেলা ঠেলে নিয়ে যেতাম কিনারে। বুকে জড়িয়ে ধরে নামিয়ে দিতাম।

বাবার সঙ্গে হাটে যাবার সময় তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাইতে। আমি বাবার ভয়ে তোমাকে একদিন ও নিয়ে যেতে পারিনি। হাট থেকে আসার সময় বাবা, আট আনার তিলে খাজা আর নিমকি কিনে দিত। তা ঠিক-ই রেখে দিতাম তোমার জন্য অর্ধেক।

দিপাদের বাড়িতে ছোট খাটো কাজ করে দিতে হয় আমার তার বিনিময়ে রাতে মা আর ছোট- বোনের খাবার নিয়ে যেতে পারি। মা এবং আমার ছোটবোন তা ভাগ করে খেত। অবশিষ্ট ভাত পানি দিয়ে রেখে দিত পরের দিন সকালে খাবার জন্য। দিপার আবদার ছিল ভিন্নতর । আমি বুঝেও না বোঝার ভানধরে থাকতাম। একদিন রাতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি চিৎকার করে বলেছি, কে রে, কে রে, ভূত? 

দিপা আমার মুখ চেপে ধরে নতজানু হয়ে বলেছিল, আমি দিপা। 

আমি আরও জোরেশোরে চিৎকার দিলাম। দিপা আড়াল হয়ে গেল। ওর মা এসে বলল,

কই কেউতো নেই ?

তোমার কি ভূত বা জিন টিন কিছু ধরে ?

আমি মাথা নেরে না সূচক জবাব দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলাম।

ভোর হলে ছুটে যেতাম দিপাদের বাড়িতে। গোয়াল ঘর থেকে গরু, ছাগল বের করবার জন্য। ছোটখাটো কাজ করতে-করতে স্কুলে যাবার সময় হয়ে যেত। তার পর চিড়া-মুড়ি খেয়ে স্কুলে রওনা দিতাম। পুরো সংসারটা আমার মাথার উপর, ভেতরে নদী ভাঙনের ভয়। এত অল্প বয়সে কি কারো বাবা মারা যায় ? বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। বাবা আমায় ছাড়া একদিন ও একা বিছানায় ঘুমাতে পারতো না অথচ এতো ছোট একটা কবরের ভেতর বাবা কেমন করে আছে? আমাকে একা রেখে। টাকার অভাবে এসএসসি পরীক্ষা দিতে না পারার কষ্ট অন্য রকম। আমি পুরো দমে দিপাদের বাড়ির রাখাল। বেশ কয়েক বছর ধরে। 

দিপা এবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন থেকে সে তার মামার বাসায় থাকবে।

আমার ঠা-া জ্বর, সারারাত কাশি, দম বন্ধ হয়ে আসে। দুই তিনটা কবিরাজ দেখানো হয়েছে। কোন কাজ হলো না। ছোট বোনটা লতার গাছের মত দিন-দিন বাড়ছে ছেলে দেখে বিয়ে দিতে হবে। মা আমার জন্য মনে-মনে মেয়ে দেখে রেখেছে। তার পছন্দ অনুযায়ী আমাকে বিয়ে করতে হবে। এদিকে পৃথিবীর বুক থেকে চলছে আমার বিদায় যাত্রা। আমার শরীর দিন-দিন অগ্রগতি হারাচ্ছে। অবশেষে শহরের ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার বলেছে, আমার ফুসফুসে ক্যান্সার। চিকিৎসার খরচ বহন করবার মত সাধ্য আমার নেই, ছিলোও না কোনোদিন। আমি স্বেচ্ছায় পরাজয় মেনে-নিয়েছি। কিছুদিন পর ঘর বন্ধী হয়ে গেলাম।


পরিচিত লোকজন আমাকে দেখতে আসত। বিভিন্ন খাবার, ফল, বা আমার পছন্দের খাবার কী জানতে চাইত ? মরে যাবার আগে কি? শুধু মানুষ তার প্রিয় খাবার খেতে চায় ? প্রিয় মানুষটি কে দেখতে চায়না ? দিপাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু কাউকে বলতে পারিনি। দিপা আমার প্রিয় একজন। আপনের আপন। ইট পাথরের শহরে মানুষ- মানুষকে সহজে ভুলে যায় দিপা ও নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে গেছে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট