শহীদুল জহির বাংলা গদ্য সাহিত্যে নব্য ধারার প্রবর্তক- ---মীম মিজান




বাংলা গদ্য সাহিত্যে যিনি স্বল্প অথচ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি হলেন শহীদুল জহির। তিনি ১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভূতের গলিতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তার নাম ছিল মোহাম্মদ শহীদুল হক। তার পিতা এ কে নুরুল হক ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা ও মা ছিলেন গৃহিনী। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার হাশিল গ্রামে। তার দাদা জহিরউদ্দিন (সম্ভবত তিনি তার জহির নামটি তার দাদার কাছ থেকে নিয়েছিলেন) ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও তার দাদী জিন্নাতুন নেসা। তার নানা ছিলেন সিরাজগঞ্জের আমলাপাড়ার আজিমুদ্দিন আহমেদ ও নানি হামিদা বেগম, যাদের কাছে তিনি প্রায়ই বেড়াতে যেতেন। শহীদুল জহির তার স্কুলজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকার ৩৬ রাঙ্কিন স্ট্রিটের সিলভারডেল কেজি স্কুলে, পরবর্তীতে ঢাকা, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ, সাতকানিয়া ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলে পড়েছেন। সাতকানিয়া মডেল হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করেন ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ও বারমিংহাম ইউনিভার্সিটিতেও পড়ালেখা করেন। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে সহকারী সচিব পদে যোগ দেন। ২০০৮ এ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব পদে কাজ করে গেছেন।

শহীদুল জহির ছিলেন চিরকুমার। প্রসঙ্গত বলতে হয়, গল্পকারের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’ মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে । অবশ্য তখন গল্পকার শহীদুল হক নামে লিখতেন। তিনি তার পরবর্তী গ্রন্থ ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় থেকে শহীদুল জহির নামে লেখেন। তিনি ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হসপিটালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। ক্ষণজন্মা এ সাহিত্যিক ছিলেন প্রচার বিমুখ। পঞ্চান্ন বছর বয়সের জীবনে চেষ্টা করেছিলেন নিজের চিন্তা ভাবনাকে তার সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে তুলে ধরতে। শহীদুল জহির তার জীবদ্দশায় মাত্র ৬ টি বই প্রকাশ করেছেন । সেগুলি হলো, ১. পারাপার, ১৯৮৫ - ছোটগল্প সংকলন; ২. জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, ১৯৮৮–প্রথম উপন্যাস; ৩. সে রাতে পূর্ণিমা ছিল,১৯৯৫- উপন্যাস; ৪. ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প , ২০০০ -  ছোটগল্প সংকলন; ৫. ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প , ২০০৪ - ছোটগল্প সংকলন ও ৬. মুখের দিকে দেখি , ২০০৬ - উপন্যাস। তার কিছু প্রকাশিত বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। তার মৃত্যুর পর আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু , ২০০৯- উপন্যাস এবং ছোটগল্প ও উপন্যাস নিয়ে দুই খ-ের বই প্রকাশিত হয়েছে । তিনি কিছু ইংরেজি গল্পও অনুবাদ করেছেন।
তিনি বাংলা কথা সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখার জন্য কাগজ সাহিত্য পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৫ পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ও জেমকন সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ।
বাংলা কথা সাহিত্যে নব্যধারার ¯্রষ্টা শহীদুল জহিরের চরিত গল্প ও উপন্যাসগুলি অন্যান্য সব সাহিত্যিকের থেকে স্বতন্ত্র। কামারুজ্জামান জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘শহীদুল জহিরের গল্পে চমৎকার কিংবা আঁতকে উঠার মতো ঘটনাই ঘটে; এমনকি আমাদের শঙ্কিত হওয়াও ক্রমশ বর্ধনশীল হয়।’



বলা হয় যে লাতিন আমেরিকার লেখকদের লেখার জাদু-বাস্তববাদের ছোঁয়া তার লেখায় রয়েছে। এবং তাকে বাংলাদেশের গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলা হয়। তিনি স্বীকার করেছেন যে দুইজন সমসাময়িক ঔপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দ্বারা তিনি প্রভাবিত। তার কিছু গল্পের কাহিনী মার্ক্সবাদের দৃষ্টান্ত বহন করে। তার অনেক গল্পে তিনি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ব্যবহার করেছেন।
শহীদুল জহিরের গল্পের উপজীব্য প্রথমত নারী-পুুরুষের ভালবাসা, প্রেম, তারপর সমাজ এবং রাষ্ট্রচিন্তা। এর বাইরে কে থাকে ? নাঙ্গা দরবেশবৃন্দ ছাড়া। এবং সাধারণ মানুষ যেহেতু দরবেশ নয়, তারা তাই ভালবাসে অথবা ভালবাসার জন্য আকুলিবিকুলি করে, তারা নির্ঘাত পোড়ে এবং পোড়ায়- এ এক উম্মাদনা জীবৎকাল ব্যাপী মানুষের। তারপর অস্তিত্বের সঙ্গে লেগে থাকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সূত্রাবলী।
তিনি তার গল্পভাষা বা গদ্যশৈলীও মানবজীবনের গন্ধ নিয়েই তৈরি করতে চান। অনেক শব্দই তিনি মানুষের জীবনযাপন থেকে গ্রহণ করেন। লৌড়ানো, ফালাফালি, চাপা খায়া ইত্যাদি অবলীলায় ব্যবহার করে থাকেন; কুত্তা, বিলাই, ইন্দুর ইত্যাদি শব্দও তিনি ব্যবহার করছেন। এতে মানুষের জীবনটাকে আরও আস্থায় আনতে চান বলেই মনে হয়। শহীদুল জহিরের গল্পে স্মৃতিকাতরতা তুমুলভাবেই লক্ষ করা যায়--তবে তার এ নস্টালজিক বিষয় খুব বেশি বর্ধনশীল হয় না।

আহম্মদ মোস্তফা কামাল বলেছেন, ‘তাঁর সৃষ্টির পরিমাণগত দিক খুব বেশি না হলেও গুণগত দিক অসাধারণ। অসাধারণত্বের বিষয়টি নানা দিক থেকে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।’ ঘটনার বহুরৈখিক বর্ণনা, বুননশৈলী, শেকড়স্পর্শী অনুসন্ধান, প্রতিটি বিষয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে উপলব্ধিপূর্বক তা সুসংগঠিত করা, পূর্ণাঙ্গতা-এ সবই তাঁর সৃষ্টিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবে যখন ইরানের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও ছোটগল্পকার সাদেক হেদায়াতকে অধ্যয়ন করি তখন দেখি সাদেক হেদায়াত(১৯০৩-১৯৫১) যে রকম পরাবাস্তববাদ তুলে ধরেছেন তার সাহিত্যে ঠিক ততটা না হলেও প্রায় একই রকম পরাবাস্তববাদ তুলে ধরেছেন শহীদুল জহির তার সাহিত্যে। তিনি তার গল্পে পরাবাস্তববাদী পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেকে আলাদা করে তুলেছেন সমসাময়িক অন্য সাহিত্যিকদের থেকে। এই যেমন, ‘এই সময়’ গল্পে বাবুলের স্ত্রী অজ্ঞান অবস্থায় সেলিমকে প্রসব করে এবং মৃত অবস্থায় নার্সরা তার সন্তানকে দুগ্ধ পান করায়। দুটি ঘটনায় বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব। কারণ প্রসব প্রক্রিয়া কোনো অজ্ঞান রোগীর কারও অজ্ঞাত অবস্থায় সম্ভব নয়। নারীর দুগ্ধ নির্গমণও একটা জৈবিক প্রক্রিয়া। অন্য একটিউদাহরণ হলো, ‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মামুন মিঞা বালক বয়সে করাতকলে কাঠের ভূষি আনতে গিয়ে চোরাই সারের ট্রাকে করে চট্টগ্রামে পাচার হয়ে যায় এবং সেখানে শিশু আসমানতারার খরগোশ হিসেবে খাঁচায় বন্দী অবস্থায় নতুন জীবন শুরু করে! শহীদুল জহিরের উপন্যাসে এ রকম অভিনব ঘটনা অহরহ ঘটে। প্রশ্নটা সেখানে নয়, অন্য জায়গায়। যে মামুন চট্টগ্রামে পাচার হয়ে যায়, সেই একই মামুন একই সময়ে তার পুরান ঢাকার বাড়িতে ফিরে আসে এবং তার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ বহমান থাকে। অর্থাৎ একই ব্যক্তি দুই ভিন্ন বাস্তবতায় দুজন ভিন্ন মানুষ হিসেবে বড় হতে থাকে। ভিন্ন বাস্তবতার কারণে তাদের জীবনযাপন ও মানসগঠন আলাদাভাবে গড়ে ওঠে। ঢাকার মামুন কোমল স্বভাবের, পড়াশোনা শেষ করে একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, জুলির প্রেমে কাতর হয়ে থাকা যুবক; আর ওদিকে সাতকানিয়ার মামুনের বহুদিন পর্যন্ত খাঁচার মধ্যে এক বন্দী জীব হিসেবে বড়ো হওয়া, যৌবনপ্রাপ্ত হলে কামুক ও হিংস্র এক মানুষে পরিণত হওয়া, একাধিক খুন ও অবাধ যৌনতা, চোরাচালান ও অস্ত্রবাজি; আর আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা মানুষ। প্রশ্ন হলো, লেখক হিসেবে তিনি একই ব্যক্তির দুটি সমান্তরাল জীবন দেখালেন কেন? এর কারণ কি এই যে একটি মাত্র ঘটনার সামান্য ওলটপালটেভূষি আনতে গিয়ে ফিরে আসা ও না আসার পার্থক্যে একজন মানুষের জীবন আমূল বদলে যেতে পারে? নাকি একই মানুষের দুটো সমান্তরাল জীবনযাপন করার ইসলামিক মিথের আধুনিক ব্যবহার করে দেখালেন লেখক? এটি আসলেই এক পরাবাস্তবতার উজ্বল দৃষ্টান্ত। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যাবলী লক্ষণে শহীদুল জহিরকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের একজন নব্য ধারার প্রবর্তক বলা অত্যুক্তি হবেনা যে নব্য ধারাটি তার সমসাময়িক বা পূর্ব কোনো সাহিত্যিকের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি।


শহীদুল জহির জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না, সেটি হওয়ার কোনো ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। বরং নিজেকে দাবি করতেন ‘ডিমান্ডিং লেখক’ হিসেবে; যিনি পাঠকদের কাছে প্রত্যাশা করতেন চিন্তার সক্রিয়তা। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ দিয়ে ক্রমাগত বিদ্ধ করে গিয়েছেন সুশীল সমাজ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বেনিয়া বাণিজ্য প্রবণতাকে। সারা জীবন ধরে বিরামহীনভাবে গভীর সংবেদন নিয়ে তিনি আমাদের জীবনের ছবি এঁকে গিয়েছেন এবং এসব বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কথাকার।
___________________________________________________________________________

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
ইহাই প্রথম পোষ্ট