শিশুটি কি মুক্তিযোদ্ধা ছিল ?



শিশুটি কি মুক্তিযোদ্ধা ছিল ?
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। উত্তাল জনসমুদ্র।

সেখান থেকে কালজয়ী এক উচ্চারণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।’

এরপর ২৫ মার্চ হানাদাররা চালালো অপারেশন সার্চ লাইটের নামে গণহত্যা। রক্তাত্ত হলো বাংলার আকাশ, মাটি আর পানি । চোখ দিয়ে শুধু দেখা যায় লাশ আর লাশ। শহীদদের পবিত্র লাশ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলো যে মানুষেরা.. সেই মুখগুলি, তাদের কল্পনা আর বাস্তবতা থমকে দাঁড়ালো।
কিন্তু থমকে দাঁড়ালোনা সময় । বাংলার দামাল ছেলেরা।
মুক্তিযুদ্ধ চলছে ।
একদল লড়ছে সম্মুখ যুদ্ধে । আরেক দল উদ্বাস্তের বোঝা মাথায় নিয়ে লড়ছে জীবনযুদ্ধে ।
চৌধুরী পরিবার । পরিবারে মা, বাবা । চাচা, দাদি। আরেকটা শিশু। নিষ্পাপ চাঁদের মতো শিশু । খুব আদর করে তার নাম রেখেছে স্বাধীন । পরাধীন দেশে জন্ম কিন্তু মা বাবা স্বাধীনের মধ্যে দেখেছে স্বাধীনতার অপূর্ণ স্বপ্ন, বিশ্বাস আর বাস্তবতা । খুব বেশিদিন হয়নি মাতৃগর্ভ থেকে বের হবার । হামাগুড়ি দেওয়া শেষ করে এক পা দু’পা করে চলা শুরু করেছে । মায়ের মায়াবী চোখ পর্যবেক্ষণ করে সন্তানকে । পড়িস না বাবা, একটু দেখে চল সোনা । যাদু আমার । আমার বাপ্ ।
খান সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে । পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারছে । কি শিশু, কি নারী, কি বৃদ্ধ কোনো মাফ নেই । এর সাথে লোভ, লালসা আর অত্যাচার । পাকিস্তানী জান্তার কালো হাত নারীর স্বপ্নকে অভিশপ্ত করেছে প্রতিমুহূর্তে । বাবার স্বপ্ন । মায়ের স্বপ্ন । বোনের স্বপ্ন। ভাইয়ের স্বপ্ন। ভেঙে চুরমার হয়েছে নিমিষেই ।
স্বাধীন জন্মের পর থেকেই খুব কাঁদতো । কেন কাঁদতো হয়তো কেউ জানতোনা । কিন্তু সময়ের ঘড়ির কাটা জানতো। পরাধীনতার আর্তনাদ শিশু স্বাধীনকেও আষ্টে পিষ্টে চেপে ধরেছিলো । মুক্ত জানালা । মুক্ত বাতাস । মুক্ত জীবন । সবকিছু হাতড়ে বেরিয়েছে হয়তো অবুঝ স্বাধীন অবচেতন মনে ।
স্বাধীন কাঁদে আর কাঁদে । কি এক প্রচন্ড ক্ষুধার আর্তনাত তাকে তাড়িত করে বেড়ায় । স্বাধীনের স্বাধীনতা পাবার ক্ষুধা।
স্বাধীনদের গ্রামে হায়েনাদের দল খুব তাড়াতাড়ি আসবে বলে খবর ছড়িয়ে গেলো । কেউ কেউ বললো ওরা গ্রামে ঢুকে পড়েছে। চারিদিকে নিরস্ত্র মানুষের আতংক আর হাহাকার ।
একদল লোক গ্রামের মেঠো পথ ধরে রওয়ানা হয়েছে ভারতের দিকে । সবাই বলছে ওরা রিফ্যুজি । কিছুই নিতে পারেনি তারা । কেউ উদোম গায়ে, কেউ ঘটি বাটি হাতে, কেউ বুড়ো মা বাবাকে কাঁধে তুলে, কেউ সন্তানকে ঘাড়ে উঠিয়ে ছুঁটে চলেছে পাশের দেশে । প্রতিবেশীদের দেশ । কিন্তু পৌঁছাতে পারবে কিনা কেউ জানেনা । এখানে ওখানে কাপুরুষ পাকি জান্তারা লুকিয়ে আছে । সাথে জুটেছে এদেশের কিছু বেজন্মা । আগাছা কিংবা পরজীবী । সবার দৃষ্টি বাঙালিদের উপর ।
চৌধুরী বাড়ির আশেপাশের লোকজন স্বাধীনের কান্নায় ভীত হয়ে পড়লো । এতো চিৎকার দিয়ে একটা শিশু কাঁদতে পারে সেটা না শুনলে বোঝা কঠিন ।
ভয়টা এজন্য বাচ্চাটার কান্না শুনে খান সেনারাদের হাতে মরতে হয় কিনা । প্রতিবেশীদের কেউ কেউ স্বাধীনের মাকে বললো বাচ্চাটার শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলুন । ওর জন্য কি আমরা মরবো । আপনার বয়স তো বেশি না বেঁচে থাকলে আরো বাচ্চা কাচ্চা হবে । একজনকে মেরে ফেলে যদি আমরা সবাই বাঁচতে পারি সেটা তো পাপ বলা যায়না ।
একেকজনের একেক মত । এক জীবন থেকে আরেক জীবন যেন মতামতের ভিতর দিয়েই চলে যায় ।
কিন্তু মা । মা তো মা’ই । মায়ের অন্তর শুধু মা জানে আর কেউ জানেনা । একটা শুন্যতা । সেখান থেকে একবিন্দু রক্ত । সেই রক্ত থেকে মায়ের ভিতরে তিলে তিলে বড় হতে থাকে আরেক জীবন । মা যাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে । এরপর নাড়ির বন্ধন । এ যেন গড়বার ভাঙবার নয় ।
কথাটা শুনে মা কাঁদে আর কাঁদে । মায়ের কান্না যে কতটা আপন, কতটা একান্ত তা হয়তো কেউ বুঝবেনা । সন্তানের দিকে তাকান মা । আধু আধু বুলি, মা, মা, মা.....। মায়ের মন কম্পিত হয় । যেমন কম্পিত হয় পৃথিবী, মাটি যখন নড়েচড়ে উঠে ।
বাচ্চাটাকে মেরে ফেলুন, ফেলুন বলছি , অসহায় কিংবা জীবনের স্বার্থপরতায় যখন মানুষ চেঁচিয়ে উঠে । মা সন্তানের মুখটা আলতোভাবে চেপে ধরে। নিজের কাপড়ের ভিতরে ঢেকে রাখে সন্তানককে । যেন কেউ আর ঐ খারাপ কথাটা বলতে না পারে ।
মা কখনো পারেনা তার সন্তানকে মেরে ফেলতে । মায়ের ভিতরের জীবিত সত্তার নাম সন্তান । মা সবাইকে মুখের উপর বলে দেয়, আমার জীবন থাকতে আমার যাদুর কোনো ক্ষতি হতে দিবোনা । মায়ের জেদের কাছে সবাই হার মানে ।

স্বাধীনের বাবা কিছুদিন মুক্তিযুদ্ধে যাবে বলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল । শরীরটা রোগা রোগা । শরীরে পরিশ্রমের দাগও পড়েছে । মুখটা একটু দেবে গেছে । চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে ।
মা আর বউয়ের পীড়াপীড়িতে আর যুদ্ধে যাওয়া হয়নি কিন্তু তা বলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা থেমে যায়নি ।
চৌধুরী পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিবে । হায় বিধাতা নিজের দেশ, মাটি ছেড়ে আজ যেতে হবে বন্ধুদের দেশে।
শরণার্থীর অনেক বড় দলের সাথে তারা যোগ দেয় । এরপর খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেটে চলা । ক্লান্ত শরীর । অভুক্ত পেট । মন ভেঙে যায় ক্ষনে ক্ষনে কিন্তু স্বপ্ন আর আশা ভাঙ্গেনা ।
স্বাধীন অভুক্ত । মায়াবী নিস্পাপ শুকনো চোখ দেখে কান্না বেরিয়ে আসতে চায় । কিন্তু ক্ষুধা পিপাসা কান্না বের হতে দেয়না ।
খবর আসতে থাকে বিভিন্ন জায়াগায় হানাদার আর তাদের এ দেশের সঙ্গীরা শরণার্থী দলের উপর আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা করছে ।
আতংকিত সবাই । তবুও বিশ্বাস টেনে নেয় শরণার্থীর দলকে । পায়ের চামড়া ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চায় । প্রখর রোদ গ্রাস করে শরীরের চামড়াকে আগুনের দাবদাহে । তারপরও চলা রিফ্যুজিদের । পথ যেন ফুরায় না কিন্তু সময় ফুরিয়ে যায় ।
একটা জায়গায় এসে থমকে যায় স্বাধীনের পরিবারসহ শরণার্থীদের দল । সামনে দেখতে পায় দানবদের । সেই দানবদের সাথে বিশ্বাসঘাতকদের ।
থমকে যায় সময় । থমকে যায় জীবন । থমকে যায় আশা, বিশ্বাস আর স্বপ্ন ।
স্বাধীনের বাবাকে টেনে হিচড়ে দাঁড় করায় আরো অনেক যুবকদের সাথে । কাপড় দিয়ে চোখ বাধে সবার । আতংক আর অজানা আশংকায় স্বাধীনের মা নির্বাক হয়ে যায় ।
এবার হানাদাররা লাইন করে সারি সারি দাঁড়ানো চোখ বাধা যুবকদের গুলি করতে থাকে ।
লুটিয়ে পরে কিছুক্ষন আগে জীবন্ত স্বপ্ন দেখা মানুষেরা । রক্ত আর রক্ত । আর্তনাদ আর চিৎকার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লাল শাড়ি পড়া নববধূ বউ থেকে বিধবা হয় । তখনও হাতের মেহেদির রং আর পায়ের আলতা দৃশ্যমান ছিল । কিন্তু সব কিছু বিবর্ণ হলো মুহুতেই । সম্পর্কের পর সম্পর্কে ছেদ বিচ্ছেদ । সন্তান হয় বাবা হারা । মা বাবা হয় সন্তান হারা ।
এবার স্বাধীনের বাবার পালা । স্বাধীন কাঁদছে । স্বাধীনের দাদি অজ্ঞান হয়ে গেছে ।
বন্ধুকের গুলি তাক করা হয়েছে । ট্রিগারে চাপ দেওয়া হলো । বিকট শব্দ ।
স্বাধীনের বাবা তার কি হলো । সে কি শহীদ হলো আজ । তার রক্ত কি রঞ্জিত করলো মেঠোপথ । চোখ বন্ধ সবার ।
চোখ খুলছে সবাই । স্বাধীনের বাবা বেঁচে আছে ।
যখন খান সেনারা ট্রিগারে চাপ দিয়েছে । তখন কে যেন একজন বলেছে । মেরো না, মেরো না, ওর নিস্পাপ সন্তানটার দিকে একবার তাকাও । মাসুম বাচ্চা । তখন যে ট্রিগারে চাপ দিয়েছিলো, তার চোখ স্বাধীনের দিকে গেলো, হাতটা কেন যেন কেঁপে উঠলো । লক্ষচ্যুত হলো শয়তানের বুলেট ।
এর পর রেগে শয়তানটা উম্মাদ হয়ে গেলো । এরপর বেয়োনেড দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে লাথি দিয়ে ফেলে দিলো স্বাধীনের বাবাকে ।
এরপর অন্যদের একে একে মেরে ফেললো । ঠিক এসময় কারা যেন বলে উঠলো মুক্তি মুক্তি পালাও পালাও ।
মুক্তিযোদ্ধারা এসে গেছে । বাংলার বীর সন্তানেরা । বীর বাঙালিরা ।
খান সেনারা ভয়ে পালিয়ে গেলো । রেখে গেলো রক্তে ভেজা শহীদের ।
কাছে গেলো মুক্তিযোদ্ধারা । স্বাধীনের বাবার হাতটা ধরে দেখলো এখনও সেখানে জীবন আছে ।
স্বাধীনের বাবা বেঁচে গেলো । এখন ভারতের শরণার্থী শিবিরে ।
স্বাধীনের মা ভাবছে । আমার সন্তানকে যদি সেদিন গলাটিপে মারতাম তবে আজ আমি বিধবা হতাম । স্বাধীনের দাদি হারাতো সন্তান । ভাই হারাতো ভাইকে । স্বাধীন হারাতো বাবাকে ।
কি জানি কি হয়েছিল । কেন স্বাধীনকে দেখার পর বুলেট লক্ষচ্যুত হলো । কেন শয়তানের হাত কেঁপে উঠলো । যে স্বাধীনকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো সেই স্বাধীন বাঁচালো আরেকটি প্রাণ । বেঁচে গেলো একটি পরিবার ।
তবে কি স্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা ছিল ?
জানেনা কেউ । অনেক রাজাকার আজ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে । মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার হয়েছে ।

এখন সময় ভাবে সেদিনের শিশুটি কি মুক্তিযোদ্ধা ছিল ।

গড়িয়ে যায় সময় গাড়ির চাকার মতো ।
স্বাধীনের মায়ের আর সন্তান হয়নি । স্বাধীন এখন তার সব । সময় গড়িয়েছে আর গড়িয়েছে। মা ভাবছে স্বাধীনকে যদি সেদিন মেরে ফেলা হতো তবে তার পৃথিবীতে আর কেউ থাকতোনা । একাকী নির্বাসিত হতো তার জীবন দুর্বিষহ যন্ত্রনায় ।
সময় বলছে নিঃশব্দে ‘স্বাধীন’ তোমরা শিশু ছিলে । তোমার নাম সার্থক হয়েছে স্বাধীন, তুমি তো আজ স্বাধীন। তুমি স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছো, মানচিত্র পেয়েছো। তোমার মতো আরো অনেক স্বাধীন আজ বড় হয়েছে। সন্তানের পিতা হয়েছে । প্রজন্মের পর প্রজন্ম তৈরী হয়েছে। এবার তাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাও । বঙ্গবন্ধুর গল্প । তবেই না দেশপ্রেম আর গর্বিত বাংলাদেশ।

DHANSHALIK YOUTUBE CHANNEL : https://www.youtube.com/channel/UCvalpdS1Kp_2lW5-Qibzzpw

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট