স্বপ্নময় ভালোবাসার রহস্য






স্বপ্নময় ভালোবাসার রহস্য
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

খুব শীত শীত লাগছে। প্রকৃতি কুয়াশার চাদর পড়ে মুখ ঢেকেছে। চারপাশ পিন-পতন নিস্তব্ধতা।
শিমুল তুলার লেপে গা মুড়িয়ে রাকিব জড়ো সড়ো হয়ে শুয়ে আছে। ঘুম ঘুম চোখ। মাথার নার্ভগুলো শিথিল হয়ে শরীরকে অবশ করে ফেলছে।
ঘুমে কাতর রাকিব। মনটাও মরে গেছে। মানুষটাও মরে গেছে। কিন্তু স্বপ্ন জেগে আছে। স্বপ্নগুলো খুব অদ্ভুদ। কখনো মনে থাকে, আবার কখনো মন থেকে হারিয়ে যায়।
রাকিব একটা গ্রামের মেলায়। লোকজনের হৈ-হুল্লোর। নাগরদোলা উঠছে আর নামছে। যেমন- লোকজনের সাথে বিক্রেতাদের দর-দামের বোঝাটা উঠছে আর নামছে। সার্কাসের জোকারদের দেখে রাকিব হাসে। আবার কষ্টে হু হু করে মনটা কেঁদে উঠে। কারন সে শুনেছে চার্লি চ্যাপলিন মানুষকে হাসাতেন। কিন্তু তার জীবনটা কষ্টের ছিল।
হাওয়াই মিঠাই কিনে রাকিব ফুরফুরে মেজাজে খেতে থাকে। নানান মানুষের নানান রং দেখে রাকিবের মনেও রং ধরে। চুড়ি, নোলক আর ঝুমকোর দোকানে মেয়েদের দিকে রাকিবের চোখ যায়। চোখ যেন হয়ে যায় পরশ পাথর। একটা রূপবতী মেয়েকে দেখে রাকিব মুগ্ধ হয়ে যায়।
পরী না মেয়ে। রাকিব ভেবে কূল কিনারা পায় না। মেয়েটার পিছু নেয়। আজ যেন রাকিবের আবেগের বাধ ভেঙ্গে লজ্জা শরমের বালাই মানছে না।
মনে মনে রাকিব ভাবে এই মেয়েটাকেই সে বিয়ে করবে। না করতে পারলে সব শেষ। মেয়েটার পিছু পিছু হাটতে থাকে। এবার একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়। সব বাতাসে মিলিয়ে যায়।
রাকিবের ঘুম ভেঙ্গে যায়। এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। হায়রে স্বপ্ন, ধরা দিয়েও ধরা দিল না। কিন্তু মনটা পড়ে রইল মেলার মেয়েটার কাছে।
স্বপ্ন বিশ্বাস হয়। রাকিব স্বপ্নকে সত্য বলে মানতে শুরু করে। এখন আর তার কিছু নেই। একটাই ভাবনা। কিভাবে মেয়েটাকে খুঁজে পাবে। একটার পর একটা শহর, জনপদ, পাহাড় ছাড়িয়ে রাকিব মেয়েটাকে খুঁজতে থাকে।
রাকিব বুঝতে চায় না স্বপ্নকে খুঁজে পাওয়া যায় কিংবা যায় না। রাকিব এতদিন বিষয়টা নিজের মধ্যেই রেখেছিল। এখন ভাবছে তার বন্ধু মফিজের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবে। আবার রাকিবের বান্ধবী অয়নার সাথেও বিষয়টি শেয়ার করবে।
একদিন বিকেলবেলা মফিজ আর অয়নাকে সে একটা নদীর কাছে ডেকে নেয়। নদীর ¯্রােতের মত রাকিবের মনেও না বলা অনেক কথার ¯্রােত বয়ে যায়। মফিজ আর অয়নাকে সে তার স্বপ্নের রূপবতী মেয়েটার কথা শোনায়। তার প্রেমের কথা জানায়। কথাটা শুনে অয়না চিৎকার করে কেঁদে উঠে। না, এটা হতে পারে না। তারপর থেকে যায়।
রাকিব আর মফিজ অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। মফিজ কথাটা শুনে হাসতে থাকে। আরে স্বপ্ন কখনো সত্যি হয়। তুই বোকাই থেকে গেলি।
আমার একটা কথা শুন, বলে মফিজ। আগামী রোববার আমার বিয়ে। রাকিব আর অয়না অবাক হয়। আমরা তোর বন্ধু আর আমরাই আগে জানিনা। তুই খুব স্বার্থপর।
রবিবার। লাল নীল রংয়ের ঝাড়বাতিতে মফিজের বাড়ী যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে। মানুষগুলো রং বেরংয়ের মনে হচ্ছে।



অয়নার মনেও রং লেগেছে। একটু আড়ালে রাকিবকে ডাকে সে। রাকিব বলে কিরে পাগলি ডাকচ্ছিস কেন। এইতো। আমি ঐদিন কাঁদলাম। কেন জানিস।
রাকিবের আর জানা হয় না। বিয়ে পড়াবে, সবাই ডাকাডাকি করছে। রাকিব আর অয়না বউয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘোমটা পড়া বউ।
সবাই বলছে, বউয়ের ঘোমটাটা না খুললে দেখবো কিভাবে? এবার বউয়ের বান্ধবী ঘোমটা খোলে। রাকিব অবাক হয়ে যায়। এইতো তার স্বপ্নে দেখা মেয়েটা।
স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। বসন্তকাল যেন বিবর্ণ হয়ে যায়। মন ভাঙ্গে, বিশ্বাস ভাঙ্গে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়।
তার স্বপ্নের মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল। চোখ বুজে আসে। পিছনে ফিরে তাকায়। আবার অবাক হয়। এমন কি হতে পারে। ভাবনা আর বিস্ময়ে রাকিবের মন কল্পনা আর বাস্তবতার টানাপোড়নে ধাক্কা খায়।
পিছনে আরেকটা তার স্বপ্নের মত মেয়ে। একটু আশা জাগে। একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়ে আরেকটা স্বপ্নের জন্ম হয়। মফিজ রাকিবকে জিজ্ঞাসা করে, কিরে কেমন বউ দেখলি? রাকিব বলতে পারে না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করে, তোর বউয়ের মত ঐ মেয়েটা কে?
কে আবার, আমার বউয়ের জমজ বোন। রাকিবের মনে হয় বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলি। রাকিবের মন আছাড়ি বিছারি খায়। একটু একটু করে স্বপ্নের অন্য মেয়েটার দিকে আগাতে থাকে।
কিন্তু যখন প্রায় কাছাকাছি তখন মেয়েটার হাত ধরেছে আরেক জন। রাকিব বুঝে উঠতে পারে না কে সে। আবার মনে হারানোর আশংকা তৈরী হয়। মফিজ এবার এগিয়ে আসে। কিরে কি ভাবছিস? না কিছু না। কিছুতো একটা ভাবছিস। না, মানে ছেলেটা কে?
কেন? আমার বউয়ের বোনের জামাই। আবার রাকিবের মনে ঝড় উঠে। স্বপ্ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। যেমন ভেঙ্গে যায় কাঁচের আয়না। যেমন শীতের সকালে শিশির বিন্দু টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতির উপর।
কি করবে রাকিব ভেবে পায় না। স্বপ্ন কি কখনও বাস্তব হয় না। নাকি বাস্তবতা স্বপ্ন হয়ে যায়।
রাকিব ভাবছে তো ভাবছে। কোন কুল কিনারা পায় না।
এমন সময় স্বপ্নের মেয়েটা রাকিবকে বলে, কিরে রাকিব আমাকে ভুলে গেছিস। সেই হারানো দিনগুলির কথা।
রাকিব এবার আকাশ থেকে পড়ে। বিস্মিত হয়। তার স্বপ্নের মেয়েটা তাকে চিনে কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব। রাকিব তো তাকে চিনে না। স্বপ্নে দেখেছে। তবে কি স্বপ্ন বাস্তবতা হয়ে যায়। কোন সমীকরণ মেলাতে পারে না রাকিব।
মেয়েটা বলে, আমার বরের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই। ও আকাশ। আকাশ ও কে জানো ও রাকিব, যার কথা তোমাকে বলেছিলাম। আকাশ হেসে হেসে বলে কি রাকিব সাহেব প্রেম করলেন আপনি আর বিয়ে করলাম আমি। রাকিব কিছুই বুঝে উঠে না। শুধু বুঝে তার স্বপ্নের রাজকন্যা অন্য কারো হয়ে গেছে। তার স্বপ্নের প্রেম বাস্তবে প্রেমকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মেয়েটা তাকে কিভাবে চিনে তার কোন কুল কিনারা খুঁজে পায় না।
অয়না দৌড়ে আসে। কি রাকিব, তোর কি হইছে? রাকিব একটু উদাস। না, আমি স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছি। কিছুতেই কিছু মিলছে না। অয়না হাসে। তোর সব স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমি দিতে পারি। কিন্তু বাস্তবতার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।


রাকিব এবার অভিমান নিয়ে বলে, বল না অয়না। কি হয়েছে? বল না।
অয়না বলে, তুই যেটা স্বপ্ন বলছিস, সেটা হয়তো সত্য। আর তুই যেটা বাস্তবে দেখছিস হয়তো সেটা মিথ্যা।
কথাটা শুনে রাকিব অবাক হয়। কোনটা সত্য। কোনটা মিথ্যা। কোনটা স্বপ্ন। কোনটা বাস্তব। জিজ্ঞাসা করে।
অয়না বলে, তুই যখন ছোট ছিলি তখন অন্তর আর অন্তরা দুই বোনের সাথে তোর খুব মিল ছিল। ওরা দুজন জমজ বোন ছিল। এরপর ওরা দেশের বাইরে চলে যায়। যখন ওরা বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন তোর কি কান্না। এখনও আমার মনে আছে। তুই প্রতিদিন একটা করে ওদের চিঠি পাঠাতি। কিন্তু উত্তর আসতো না।
দিন যায়, রাত যায়। তুই ওদের ভুলতে পারিস না। আমার আর মফিজের সাথে তোর বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। কিন্তু তারপরও তুই ওদের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতিস।
সময় গড়ালো। বাস্তবে তুই ওদের হয়তো ভোলার চেষ্টা করছিলি। কিন্তু তোর স্বপ্নের মধ্যে ওরা দিনের পর দিন বড় হতে থাকে। তোর স্বপ্নের সাথে দিনের পর দিন তুই ওদের চেহারার পরিবর্তনের একটা কল্পনা তৈরী করিস।
আজ যাদের তুই দেখছিস তারা তোর অন্তর ও অন্তরা নয়। ওরা দুইজন জমজ বোন। কথা ও কবিতা।
অন্তর ও অন্তরা যেদিন চলে যায় সেদিন তাদের বিমান দুর্ঘটনা হয়েছিল। তারা কেউ বেঁচেছিল না।
রাকিব প্রশ্ন করে, তবে কথা ও কবিতা ওরা কারা?
ওরা তোর স্বপ্ন। স্বপ্ন মানে। এইতো মফিজের বউ। এইতো আকাশের বউ।
সব তোর স্বপ্ন। এখন জেগে থেকেও তুই স্বপ্ন দেখছিস। কথা ও কবিতা তোর বানানো কাল্পনিক চরিত্র। এখন বাস্তবতার মধ্যেও তুই স্বপ্ন দেখিস। জানি না এটা কোন রোগ কি না। হয়তো মনের রোগ। কিংবা স্বপ্নের রোগ।
আমি অয়না। আমিও তোর স্বপ্ন।
রাকিব বুঝে উঠতে পারে না সে স্বপ্ন না বাস্তবতার মধ্যে আছে।
রাস্তা ধরে হেটে চলেছে রাকিব। জীবনও চলছে জীবনের গতিতে। কিন্তু আজও রাকিব খুঁজছে নিজেকে। সে কি স্বপ্নের মধ্যে আছে? নাকি বাস্তবতার মধ্যে? সেকি ঘুমিয়ে আছে? নাকি জেগে আছে? কিছুই নেই।
হাসপাতালের মর্গে একটা লাশ পড়ে আছে। রাকিবের আত্মাটা অদৃশ্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বপ্ন আর বাস্তবতার খোঁজে। রাকিবও জানে না। সে কি লাশ নাকি মানুষ। সে কি জীবিত নাকি মৃত।
অয়নার কান্নাটা এখনও থামেনি। কারণ অয়না রাকিবকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখেছিল। অয়না রাকিবের স্বপ্ন হতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ রাকিবের লাশটা সনাক্ত করার জন্য তাকে মর্গে যেতে হলো।
হাসপাতালের মর্গে একটা আনন্দের চিৎকার শোনা গেল। বাকিটা রহস্যই থেকে গেল।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট