আকাশ আর সমুদ্রের পরোয়ানা জারি
ইমদাদ উল্লাহ ফিরদাউস
কোনো এক গোধূলিবেলায় পাড়ার সমুদ্রতটে হাঁটতে গিয়েছিলাম। অন্তহীন সমুদ্রকে নিজের বাঁ-পাশে রেখে তার একদম কূলঘেষে হাঁটতে থাকলাম আনমনে। হাঁটতে হাঁটতে যেন কোনো এক অজানা ভাবনার ঘোরে হারিয়ে গেলাম। সংবিৎ ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা উঁচু ঢিবির ওপর উপবিষ্ট অবস্থায়।
ভাবনার ঘোর কাটিয়ে মনোযোগ ফেরালাম মাথার ওপর খুঁটিহীন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নীলাকাশপানে, বুক জুড়ে তার ছড়িয়ে থাকা শিমুল তুলোর মতো মুঠো মুঠো মেঘরাশি। ক্রমাগত প্রবহমান জলধারার মতো করে সেসব মেঘপুঞ্জ ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার আড়ালে। ওসবের কোনোটাকে দেখতে মনে হচ্ছে যেন, খোদিতকোনো প্রাণীর কায়া বা প্রতিবিম্বিত কোনো মানবছায়া। কিংবা যেন কোনো মূর্ত বস্তুর প্রতিকৃতি বা অঙ্কিত কোনো দেহমূর্তি।
চোখ সরিয়ে এবার তাকালাম স্রোতস্বিনী সমুদ্রের দিকে, এ কী! না জানি, তার সে যে কি রাগ-ক্ষোভ; বিরামহীন তার ঢেউগুলো প্রবল গতিতে একটি অন্যটির ওপর ভীষণ ক্রোধের সাথে আছড়ে পড়ছে। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালা যেন আজ পুঞ্জিভূত দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ করছে। ওরা যেন আজ বিক্ষোভ-মিছিল ডেকেছে। আন্দোলিত সমুদ্দুর যেন উদগীরণ করছে নিজের ভেতর পুষে রাখা এতদিনকার সব ক্ষোভ-যন্ত্রণা। জানান দিচ্ছে চূড়ান্ত বিপ্লবের ঘোষণা। ধীরে ধীরে বেড়েই চলল কল্লোলিত সমুদ্রের বেপরোয়া আন্দোলন।
দ্রোহের অনলে তপ্ত ও তরঙ্গোদ্বেলিত সমুদ্রকে দেখে তখন নিজের ভেতরকার অনুসন্ধিৎসু সত্তা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। প্রশ্নকারী আত্মা আমা ব্যাকুল হয়ে উঠল। অমনি জিজ্ঞেস করে বসলাম। সীমাহীন আকাশের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললাম,
-আচ্ছা আকাশ! এইসব অগণিত মেঘ-রোদ্দুর, গ্রহ-নক্ষত্র, চাঁদ-সুরুজ-তারকারাজি এত সবকিছুকে যে সারাটাক্ষণ নিঃস্বার্থভাবে আগলে রেখেছ নিজের বুকে কোনোরকম মাইনে ছাড়াই- এতো উদার কী করে হলে? কার কাছে শিখলে এমন উদারতা?
প্রত্যুত্তরে আকাশ শুধু বলল - পরার্থপরতা ও পরোপকারিতা এবং মাত্রাতিরিক্ত সহনক্ষমতাই আমাকে এমন উদার করে তুলেছে।
উত্তাল সমুদ্রকে শুধালাম, এতো যন্ত্রণা-ক্ষোভ কেনো তোমার? কীসের এতো বিদ্রোহ আর বিক্ষোভ? এতটা বেপরোয়া সাহস কোথায় পেলে?
সমুদ্রর তখন উত্তর করল- আমার ওপর কৃত সীমাতিরিক্ত অত্যাচার-শোষণ এবং আমার সামনে ঘটিত সীমাহীন অন্যায়-অবিচার আমায় এমন বেপরোয়া সাহসী করে তুলেছে।
সেদিন আমি জানলাম নতুন একটি বিষয়। শিখলাম নতুন এক পাঠ। আকাশ ও সমুদ্রের পরষ্পর বিপরীতমুখী আচরণ থেকে আমি বুঝলাম, কোনো কিছুতে মাত্রাতিরিক্ত সহনক্ষমতা যেমন কাউকে বেহদ্দ উদারচেতা বানিয়ে তুলে আবার কোনো কাজ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেটা তাকে বেশ বেপরোয়া ও বিদ্রোহী করে তোলে।
শিক্ষার্থী