মানুষ একা; হেলাল হাফিজের মত একা



মানুষ একা; হেলাল হাফিজের মত একা!

জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


মানুষ মূলত একা। ভীষণ রকমের একা। কতটা একা সেটা অনুমান করা কঠিন  তবে কিছু আনদাচ করা যায় আমাদের প্রিয় কবি হেলাল হাফিজকে দেখে। জীবন ঠিক কতটা নিঃসঙ্গতায় ভরপুর; কতটা বিরহে ভরপুর; কতটা এলোমেলো; কতটা দিক-বেদিক; তার নিখাদ উদাহরণ হলো হেলাল হাফিজ। আমরা আমাদের এই ছোট্ট ঝরাপাতার মত জীবন নিয়ে কত আনন্দিত; কত উচ্ছাসিত; কতটা বেসামাল সময়ের ভেতর ডুবে গিয়ে কিছুটা একটা ভুলে যাই। আমরা মানুষ আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চাই; স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চাই; স্বাদ নিয়ে বাঁচতে চাই কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটার তীব্র অভাববোধ থেকে যায়; যেটা কাটিয়ে ওঠা বড় ধরনের কষ্টকর। আমি বরাবর’ই জীবন ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। কিছুটা হেলাল হাফিজের সাথে মিলে যায় অকপটে। তবে এই মিলের ভেতর রয়েছে কেমন একটা দাহ। আমার কাছে জীবনটা ঠিক সকাল বেলার মত। দেখতে দেখতে রোদ উঠে যায়; দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়; দেখতে দেখতে নির্মলতা হারিয়ে যায়; দেখতে দেখতে দেখায় হয়না; দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায় কিন্তু কেন এমন ! চিন্তা করেছি অনেক। তবে ভেবে পাইনা। এর উত্তর কি; এর ভেতর অনেক প্রশ্ন । আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি । খুঁজতে খুঁজতে হেলাল হাফিজদের মত কিছু একটা পেয়ে যাই। তখন কিছুটা থমকে যাই। আমার সেই থমকে যাওয়া আমাকে অবাক করে দেয়। কিছু হতভম্ব করে দেয়। জানি না কেন এই নিরুত্তর তীব্র দাহ ভেতরে। এই নষ্ট সময়ে আমাকে কিছু দিয়েছে; কি দিবে কিংবা কি নিয়ে আমাকে এই জীবন কাছে হাজির হতে হবে; আমি ঠিক জানি না। একজন হেলাল হাফিজ এই জীবন অনেক কিছু বলে দেয়। একজন হেলাল হাফিজ জীবন নিয়ে অনেক অভিযোগ করে যায় । একজন হেলাল হাফিজ জীবন নিয়ে অনেক বিরহ জাগিয়ে দেয়। একটা হেলেন একজন হেলাল হাফিজকে জীবন চিনিয়ে দেয়। জীবন কি স্বাদ তা বুঝিয়ে দেয়। আমরা কেউ কেউ জীবন স্বাদ বুঝতে বুঝতে জীবন হারিয়ে ফেলি। একজন হেলাল হাফিজ তেমন হারিয়ে যায়। আমরা ঠিক তার মত জীবন চাই না; আমরা ঠিক তার মত বেদনা না চাইনা; আমরা তার মত বিরহ চাইনা । তবে এই জীবনে বিরহ, বেদনা, নিঃসঙ্গতা কেমন একটা স্বাদ দেয়; একজন হেলাল হাফিজ বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের কেন জানি মনে হয়; আমাদের অনেক কিছু বলার ছিল; আমাদের অনেক কিছু বলার থাকে । বাহিরের তাগাদা সেটা ঢেকে দেয়; আমরা ঘুমিয়ে পড়ি রোদের তাপে; আমরা জেগে থাকি রাতের শরীরে। একজন হেলাল হাফিজ পুড়িয়ে দেয় আমাদের; একজন হেলাল হাফিজ অনেক প্রশ্ন রেখে যায় জীবন নিয়ে; আমরা কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনা; আমরা কেউ তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনা; কিন্তু কেন ! আমাদের কাছে একজন হেলাল হাফিজ  ঠিক ফেরিওয়ালার মত থেকে যায়-


ফেরিওয়ালা


কষ্ট নেবে কষ্ট

হরেক রকম কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট !


লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট

পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,

আলোর মাঝে কালোর কষ্ট

‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট

দাড়ির কষ্ট

চোখের বুকের নখের কষ্ট,

একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট

অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,

ভুল রমণী ভালোবাসার

ভুল নেতাদের জনসভার

হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট

পথের এবং পায়ের কষ্ট

অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরিওয়ালার কষ্ট

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


আর কে দেবে আমি ছাড়া

আসল শোভন কষ্ট,

কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন

আমার মত ক’জনের আর

সব হয়েছে নষ্ট,

আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।


বিরহে পুড়ে; বেদনায় জ্বলে একটা মানুষের জীবন কতটা নিখাদ হতে পারে; কতটা শুনশান নীরব হতে পারে; কতটা শান্ত সমুদ্রের হতে পারে; সেটা কেবল’ই হেলাল হাফিজ বিশাল উদাহরণ। 


বারবার আমরা একটা জিনিস চিন্তা করলে সহজেই বুঝতে পারবো; জীবনে যত সমস্যা’ই থাকুক না কেন; সেটা সাময়িক। তবে আমরা কিন্তু সব মানুষ’ই চাই যে; জীবনটা সহজ হোক; সাবলীল হোক; সুন্দর হোক। জীবন সুখে ভরপুর থাকুক; সুন্দরের ছেয়ে থাকুক । কোনো ধরনের দুঃখ, বেদনা, বিরহ স্পর্শ না করুক; কোনো অস্থিরতা ভর না করুক। তবে হেলাল হাফিজ তার জীবনটা কেন জানি মনে হয় বেদনার হাতে তুলে দিয়েছেন; বিরহের হাতে তুলে দিয়েছেন। হয়ত সে সেই বিরহেই তাবৎ সুখ খুঁজে পেয়েছে; কেন জানি- বেদনাকে সে খুব কাছের মানুষের মত মনে করে; এক কথায় বিরহ আর বেদনা দিয়ে জীবনটা দারুণ ভাবে সাজিয়েছিল। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যপার যে; একজন হেলাল হাফিজ বিরহে পুড়িয়ে দেয়া একটা প্রেমিকাকে বুকে ধারণ করে জীবন পার করেছে; কি সাংঘাতিক। আহ; ভালোবাসা মানুষকে এভাবেও রাখে; ভালোবাসা মানুষ জীবন্ত মমী বানিয়ে রাখে; কি অদ্ভুত না! তাবৎ বিরহ বেদনা বুকে ধারণ করে জীবন পার দেয়া মানুষটা শেষে একা হয়ে চলে গেল আমাদের ছেড়ে। বেদনাকে আত্মার আত্মীয় করে বেদনাকে শান্তনাও দিয়ে সময় যাপন করে গেছেন। আর আমার দূরে দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাকে দেখে গেছি নিভৃত্বে...


বেদনাকে বলেছি কেঁদো না


আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?

কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,

দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের

একমাত্র মৌলিক কাহিনী।


আমার শৈশব বলে কিছু নেই

আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,

আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।

দুঃখ তো আমার হাত- হাতের আঙুল- আঙুলের নখ

দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।


আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুঃখী নই,

দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে।

আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,

অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,

পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে

সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফটি-ম্যাচের মতো বুকে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট