হেলাল হাফিজের জীবন, কবিতা, জীবনযাপন এবং রাষ্ট্রচিন্তা
ইসরাফিল আকন্দ রুদ্র
বাংলা কবিতার ভুবনে হেলাল হাফিজ অনন্য উজ্জ্বল ধ্রুব নক্ষত্র, যিনি তাঁর অমর রচনায় সময়, সমাজ, প্রেম এবং রাষ্ট্রের জটিলতাকে গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতা যেমন পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে, তেমনি বোধে আনে জাগরণ ।
হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে পিতা খোরশেদ আলী তালুকদারের ঔরসে, মাতা কোকিলা খাতুনের গর্ভে। বয়স যখন তিন তখনই হারিয়েছেন মাকে। মাতৃহীনতার বেদনাই তাকে ক্রমান্বয়ে কবি করে তুলেছে। মাকে খুঁজে ফিরেছেন সবখানে। তাঁর জীবন ছিল নিঃসঙ্গতায় ভরা। এই নিঃসঙ্গতা কখনো তাঁকে কবিতার গভীরতায় ডুবিয়েছে, আবার কখনো সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তীক্ষ্ণ ভাষায় প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে।
হেলাল হাফিজের কবিতা শুধু শব্দ নয়, এটি যেন তাঁর হৃদয়ের ভাষা, অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) তাঁকে পাঠকের কাছে এনে দেয় অপরিসীম জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের কবিতার বইয়ে সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং সবচেয়ে বেশি মুদ্রিত এ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের কবিতা সমূহ শুধু প্রেম নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সমাজের গভীর অনিয়মের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ।
হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম একধরনের চিরন্তন অভিব্যক্তি পায়। তাঁর প্রেমিকসত্তা গভীর, কিন্তু তা কখনো আবেগের ফাঁদে আটকা পড়ে না।
হেলাল হাফিজের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কয়েক প্রজন্মের প্রতিবাদী মন্ত্র হয়ে উঠেছে।
এই কবিতায় হেলাল হাফিজ সময়ের চেতনাকে ধারণ করেছেন। এটি একদিকে রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যুবসমাজকে জাগ্রত করেছে, অন্যদিকে প্রেম ও সংগ্রামের মিলিত রূপে সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
হেলাল হাফিজের কবিতার ভাষা সহজ, কিন্তু গভীর। তাঁর কবিতায় আধুনিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট। তিনি কবিতায় প্রচলিত ছন্দ ও আঙ্গিক ভেঙেছেন এবং নতুন শৈলী নিয়ে এসেছেন। শব্দ চয়ন এবং বাক্য গঠনে তাঁর প্রতিটি কবিতা পাঠকের মনে অমর হয়ে থাকে।
তাঁর জীবনযাপন ছিল কঠিন, কিন্তু তা সৃজনশীলতায় ভরপুর। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা এবং প্রেমের ব্যর্থতা তাঁকে যেমন আঘাত করেছে, তেমনি সেগুলো তাঁর কবিতার রসদ হয়ে উঠেছে।
কবিতার জগতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও একাকীত্বের মানসিক যন্ত্রণা তাঁকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে। তিনি সংবাদপত্রের সম্পাদনা, পত্রিকায় লেখালেখি এবং কখনো কখনো বেকার জীবনের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন।
তাঁর জীবন একদিকে সংগ্রামের প্রতীক, অন্যদিকে সৃজনশীলতায় ভরা। তিনি কখনো জীবনের এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাননি। বরং কবিতায় জীবনযাত্রার এই দিকগুলো স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
হেলাল হাফিজ রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টিপাত করেছেন। তাঁর কবিতাগুলোতে বারবার উঠে এসেছে শোষণ, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কবির কাজ শুধু সৌন্দর্যের প্রশংসা নয়, বরং সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা। হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতায় শাসক শ্রেণির অন্যায়কে কটাক্ষ করেছেন প্রতিনিয়ত।
হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম এবং রাষ্ট্রচিন্তা একসাথে জায়গা করে নিয়েছে। প্রেম তাঁর কাছে শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, এটি বৃহৎ চেতনার অংশ। তাঁর মতে, প্রেম একধরনের প্রতিবাদ, যা অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে মানবিকতার শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কবিতায় প্রেম এবং রাষ্ট্রের সংঘাত একটি নতুন মাত্রা যোগ করে।
হেলাল হাফিজ একাধারে প্রেমিক, বিদ্রোহী এবং স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর কবিতায় জীবনের গভীর অনুভূতি, রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচার এবং সমাজের অসঙ্গতির এক অদ্ভুত মিশ্রণ পাওয়া যায়।
তাঁর জীবন ছিল সংগ্রামময়, কিন্তু তাঁর কবিতা চিরন্তন। ব্যক্তি হেলাল হাফিজ হয়তো একা ছিলেন, কিন্তু তাঁর রচনাগুলো কোটি পাঠকের মনে স্থায়ী আসন পেয়েছে। তিনি শুধু এক প্রজন্মের কবি নন; তিনি সকল সময়ের কবি। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয়, জীবন এবং রাষ্ট্রের সমস্ত জটিলতা সত্ত্বেও, প্রেম এবং মানবতা চিরকাল জয়ী হবে।
এইভাবেই হেলাল হাফিজের কবিতায় জীবন, কবিতা, জীবনযাপন এবং রাষ্ট্রচিন্তার অনন্য মেলবন্ধন রচিত হয়েছে। তাঁর প্রতিটি পঙ্ক্তি আমাদের চিন্তাকে জাগ্রত করে এবং হৃদয়কে আন্দোলিত করে।