প্রায়শ্চিত্ত
কবির কাঞ্চন
ডানহাতে কাগজে মোড়ান থলেটা বুকের ডানপাশে শক্ত করে ধরে
উদভ্রান্তে পথ চলছে নুরুল। অনেক কষ্টে এই টাকা সংগ্রহ করেছে সে। গার্মেন্টসে চাকরি করে। মাস শেষে যে বেতন পায় তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার খরচ চলে না। তার সাথে আরো যোগ হয়েছে ছেলের স্কুলের বেতনাদি। কাছের মানুষদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত ধারকর্জ করে চলেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা টাকা না পাওয়ায় ইতোমধ্যে বন্ধুদের অনেকেই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইদানিং খুব বিপদে পড়ে গেলেও কেউ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় না।
হঠাৎ করে পুত্রের অসুখে মহাচিন্তায় পড়ে যায় সে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে বিভিন্ন টেস্ট শেষে জন্ডিস ধরা পড়ে।
ডাক্তার বললেন,
'হেপাটাইটিস বি পজিটিভ'। বর্তমান বিশ্বের আলোচিত কয়েকটি রোগের অন্যতম। এই রোগের প্রতিষেধক অদ্যাবধি আবিস্কৃত হয়নি। কেউ এর ক্যারিয়ার হলে বিভিন্ন উপায়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনবার চেষ্টা করেন। এলোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক দুই পদ্ধতিতে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছু প্রতিষেধক আছে। তবে গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, চিংড়িসহ সকল প্রকার তৈলাক্ত খাবার ও নেশাদ্রব্য পরিহার করে ভেষজ উদ্ভিদসহ পেঁপেঁ, আঙ্গুর, ডালিম, বাতাবিলেবুসহ বিভিন্ন ফল খেলে এই রোগ বেশি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আর একটা কথা, ওকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখবেন। এ রোগের মহৌষধ কিন্তু প্রোপার রেস্টে থাকা।
নুরুল মহাচিন্তায় পড়ে গেলো। কী করবে ভেবে কূল পায় না। আনমনে ভাবতে লাগলো, তবে কী আমার বুকের মানিককে অকালে হারাতে হবে! না, আমার দেহে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। যে করে হোক ওকে বাঁচাতে হবে।
নুরুলকে দীর্ঘক্ষণ ধরে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ডাক্তার আবার বললেন,
- কী ভাবছেন? এ নিয়ে টেনশন না করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। আপনি চাইলে ওকে এখানে রেখে আমাদের অধীনেও চিকিৎসা করাতে পারেন।
- স্যার, আমার ছেলে সুস্থ হবে তো?
- হ্যাঁ, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাব। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। এ যাবৎ আমাদের এখানে যারাই এই ধরণের রোগী এসেছেন তারা সবাই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।
- স্যার, আনুমানিক কত টাকা লাগতে পারে?
- হাজার পঞ্চাশেক তো লাগবেই।
নুরুলের মুখখানা মুহূর্তে মলিন হয়ে যায়। এরপর ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে অনুরোধের গলায় বলল,
- স্যার, আমরা গরীব মানুষ। এতো টাকা কিভাবে ব্যবস্থা করবো?
- দেখুন, রোগের কাছে কোন গরীব-ধনী নেই। ওর রোগটা কিন্তু অবহেলা করবার মতো নয়।
- স্যার, যেকোন উপায়ে হোক আমার কলিজার টুকরাকে বাঁচাতে হবে। আমি টাকা নিয়ে আসছি।
এরপর স্ত্রী, সন্তানকে ক্লিনিকে রেখে টাকা কালেকশনে নেমে পড়ে সে। কারো কাছে ধার না পেয়ে শেষে স্থানীয় একটি মাল্টিপারপাস সমিতি থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ক্লিনিকের দিকে ফিরছিল। পঞ্চাশ হাজার টাকা। খুব সাবধানে রিক্সা যোগে ইপিজেড মোড় পার হচ্ছিল। একটু ফাঁকা জায়গায় ওঁতপেতে থাকা তিনজন যুবক রিক্সাকে ঘিরে ফেললো। তাদের মধ্যে একজন নুরুলের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে বলল,
-সঙ্গে যা যা আছে সব দিয়ে দে; নইলে গুলি চালিয়ে দেবো।
নুরুল হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
- ভাই, আমার কাছে এখানে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। এই টাকা আমি আজ একটি সমিতি থেকে সুদে এনেছি। আমার একমাত্র ছেলে অসুস্থ হয়ে ক্লিনিকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এই টাকা দিয়ে আমি ওর চিকিৎসা করাবো। ভাই, আমাকে যেতে দিন।
অস্ত্রধারী জোর করে টাকার থলেটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। সব হারিয়ে নুরুল রাস্তার ধারে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। চারদিক থেকে লোকজন এসে জড়ো হয়। বিষয়টা জেনে সবাই আফসোস করতে থাকে। অবশেষে রিক্সাচালক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে রিক্সায় উঠিয়ে নিয়ে ক্লিনিকের দিকে চলে আসে।
ওদিকে অস্ত্রধারী হাইজ্যাকার বাসায় ফিরে এসে তার একমাত্র মেয়ে, তুলিকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে। তুলি বাবাকে কাছে পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। তুলিকে আদর করার সময় কেন যেন বারবার নুরুলের শেষের আহাজারির কথা মনে পড়ে তার।
এমন সময় তুলি "পেট ব্যথা! পেট ব্যথা!" বলে কাঁদতে থাকে। দ্রুত বাথরুমে নেয়া হয়। বাথরুম থেকে বের হয়ে আবার কাঁদতে শুরু করে। তুলির মা-বাবা তুলিকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। এরপর তুলিকে নিয়ে ছুটে আসে ক্লিনিকের দিকে। রিসিপশনে এসে প্রাথমিক চিকিৎসার পর কেবিন নিতে বলা হয়। তখন ক্লিনিকে কোন কেবিন খালি ছিল না। শুধু একটি কেবিন খালি হবার কথা ছিল। কিন্তু পূর্বের রোগী নির্ধারিত সময় পার হলেও কেবিন ছাড়তে গড়িমসি করছিল।
রিসিপশনিস্ট বলল,
-দেখি, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমরা কেবিন খালি করে দিচ্ছি। আপনাদের কেউ একজন ইচ্ছে করলে আমাদের ওয়ার্ড় বয়, মিন্টুর সাথে যেতে পারেন। তুলির বাবা মিন্টুর পিছেপিছে হাঁটতে থাকে। মিন্টু কেবিনে এসেই রোগীর লোকজনের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে। কেবিনের ভিতর মাথানিচু করে বসে থাকা একজন লোক জগতের সব হতাশা জড়ো করে মাথা তুলে বলল,
- ভাই, আর একটু সময় দিন। আমি আপনাদের বিল পরিশোধের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এই তো কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বন্ধু টাকা নিয়ে আসবে।
তুলির বাবা ভালোভাবে লোকটাকে প্রত্যক্ষ করলো। তার চিনতে একটুও কষ্ট হলো না। এই তো সেই লোক, যার কাছ থেকে আজই সে পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিনতাই করেছে। ওই টাকা থাকলে হয়তো তার ছেলের চিকিৎসা হতো। তাকে এমন অসম্মানে পড়তে হতো না। ইত্যাদি ভেবে খুব লজ্জিত হয় সে। তারপর সামনে এসে সালাম দিয়ে নুরুলকে বললেন,
- আপনি একটু আমার সাথে বাইরে আসুন। আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
বাইরে এসে নুরুল চোখেমুখে বিস্ময় এনে বলল,
- হ্যাঁ, কি বলবেন, বলুন।
- আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে?
- হ্যাঁ, ভাই আজ সকালে সমিতি থেকে সুদে টাকা নিয়ে ক্লিনিকের দিকে আসতে লাগলাম। পথিমধ্যে কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আমার সবকিছু কেড়ে নিলো। এখন ক্লিনিকের বিল পর্যন্ত পরিশোধ করতে পারছি না।
তুলির বাবা নিজের কৃতকর্মের জন্য ভিতরে ভিতরে পুড়ে মরছেন। হায়! জীবনে অনেক অপরাধ করেছি। কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। আমার সন্তান আমার কর্মের দোষে হয়তো শাস্তি পাচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তে বলে ওঠে, উফ! নিয়তি।
নুরুল বলল,
- কি ভাই, আমার কষ্টের কথা শুনে দুঃখ পেয়েছেন? আমি খুব দুঃখিত, ভাই।
- না ভাই, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি আপনার সন্তানের চিকিৎসার সব টাকা দিতে চাই।
নুরুল অবাক হয়ে কাঁদো গলায় বলল,
- আপনি আমাকে ঠিকমতো চিনেন না। অথচ আমার সন্তানের চিকিৎসার খরচ দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু কেন?
তুলির বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
- আপনি আমাকে একটু প্রায়ঃশ্চিত করার সুযোগ দিন। কথা দিচ্ছি আজকের পর আর কোন মানুষের ক্ষতি করবো না।
নুরুল তুলির বাবার কথার মানে বুঝে না। শুধু তুলির বাবার সুন্দর মুখের দিকে কৃতজ্ঞতায় নির্বাক তাকিয়ে থাকে ।