জায়নামাজে অশ্রুর গন্ধ
নূরনবী সোহাগ
বছরে দুইবার রাতুলের গ্রামে যাওয়া হয়। একবার রমজানের ঈদে আর অন্যবার কোরবানির ঈদে। তবে এবার রাতুল তৃতীয়বারের মত গ্রামে যাচ্ছে। গতকাল রাতুলের বড় খালা ফোন করে জানালেন, রাতুলের নানী আপুর শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বিশেষ কওে রাতুলের মাকে খুব করে দেখতে চেয়েছে। তাই সময় বিলম্ব না করে রাতুলরা আজই রওনা হয়েছে। রাতুলের আব্বু ছুটি না পাওয়ায় রাতুল তার আম্মুর সাথেই যাচ্ছে। রাতুল লঞ্চযোগে গ্রামে যাবে, রাতুলের বাবা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। গ্রামে যাচ্ছে বিষয়টা ভাবতেই রাতুলের খুব ভাল লাগছে। গ্রাম রাতুলের কাছে খুব প্রিয়। বরাবর গ্রামীণ দৃশ্যপটে রাতুল মুগ্ধ হয়ে যায়। এমনটা ভাবতে ভাবতেই লঞ্চ ছাড়ল। রাতুল কিছুক্ষণ বাইরে দাড়িয়ে ছিল। কেবিনে ঢুকে বুঝতে পারলমা কাঁদছে, একটু পরপর তিনি চোখ মুছছেন। বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রাতুল আবার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ অজানা শঙ্কায় মনটা ভরে গেল রাতুলের, নানী আপুর কিছু হবে না তো! নানী আপুকে রাতুল খুব ভালবাসে। রাতুলের নানী আপুর জীবনটা অনেক কষ্ট ও বেদনাচ্ছন্ন। গ্রামের বাড়িতে তিনি একা থাকেন। রাতুলেরমা অনেক বুঝিয়েও তাকে শহরে আনতে পারেননি। তিনি তার স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। রাতুলের নানী আপুর গল্পটা একটু শুরু থেকে বলা যাক, তার তিন সন্তান। বড় দুই মেয়ের পরে এক ছেলে। দুই মেয়ের পরে ছেলে হওয়ায় রাতুলের নানা জান ভীষণ খুশি হয়েছিল। নানাজান শখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন এনায়েত। এনায়েত জন্মের ছয় মাসের মাথায় রাতুলের নানা জান মারা যান। পরবর্তীতে রাতুলের নানী আপুই কোলে পিঠে করে তার তিন সস্তানকে মানুষ করেছেন। এনায়েত রাতুলের নানী আপুর বড় আদরের ছেলে ছিল। রাতুলের বড় খালা এবং মা’ও এনায়েতকে খুব আদর করতেন। রাতুলের মামার বয়স যখন নয় অথবা দশ বছর, তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়! গ্রাম থেকে তখন অনেক মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাতুলের নানী আপু মন স্থির করলেন এনায়েত’কেও যুদ্ধে পাঠাবেন। তাতে অবশ্য রাতুলের মা এবং খালা বাধ সাধলেন কিন্তু রাতুলের নানী আপু সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। অবশেষে রাতুলেরমামা যুদ্ধে গেলেন। রাতুলের নানী আপু বলতেন, ‘আমার ছেলেকে আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করেছি’ কিন্তু সে উৎসর্গ তখন সত্যিতে পরিণত হল যখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ফিরে এলেও রাতুলেরমামা আর ফিরে আসেননি! রাতুলের নানী আপু ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন তখন। অতি শোকে তিনি ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে গেলেন।রাতুলের নানীআপু সারাদিনের বেশির ভাগ সময়ই জায়নামাজেই থাকেন, কান্নাকাটি করেন। রাতুলের নানী আপুর জায়নামাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট আছে। আর তা হল ওই জায়নামাজই নাকি রাতুলের নানাজান নামাজ পড়েছেন, রাতুলের এনায়েত মামা বসে আরবি পড়া শিখেছেন। রাতুলরা পৌছালো ভোরের দিকে। রাতুলের নানী আপু এখন অনেকটা ভালো আছেন। তিনি নামাজ পরে জায়নামাজেই শুয়ে আছেন। রাত্লু নীরবে গিয়ে নানীআপুর পাশে বসল। নানী আপু হয়তো একটু তন্দ্রার মত পরেছিল। নানী আপু রাতুলকে বললেন, এখন গিয়া ঘুমাও ভাই, ‘সকালে কথা অইবো’ রাতুল বলল, ‘নানীআপু, আমি একটু তোমার পাশে শুই।’ নানীআপু শরীরটা একটু পেছনে ঘেঁষে কোলের কাছে একটু জায়গা করে দিলো। রাতুল নানীআপুর কোলের কাছেই শুয়ে পরল। নানীআপু স্বস্নেহে একটি হাত রাখলো রাতুলের গায়ে। রাতুলের হঠাৎ মনে পড়ল, এটাই সেই জায়নামাজ, যাতে নানাজান নামাজ পড়েছেন। নানীআপুর পাশে দাড়িয়ে হয়তো এনায়েত মামাও কোনদিন নামাজ পড়েছেন অথবা নানীআপু সিজদায় যাবার পর তার পিঠে উঠে বসেছেন।এই জায়নামাজে বসেই নানীআপু প্রত্যেক মোনাজাতে কাঁদেন তার প্রিয় এনায়েতের জন্য! হতে পারে এনায়েত মামাও কোনএকদিন এই জায়নামাজে আমার মতই শুয়েছিল নানীআপুর কোলের খুব কাছে...