মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ও একটি অনন্য বই



মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ও একটি অনন্য বই
মাইনউদ্দিন মাইন

বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেইসবুকের কল্যাণে আমরা সকলেই মোটামুটি অবগত আছি যে,একুশে ফেব্রুয়ারী,ষোলই ডিসেম্বর, ছাব্বিশে মার্চ আমরা কতটা তাৎপর্যপূর্নভাবে পালন করি।দল মত নির্বিশেষে পালন করার মধ্য দিয়েই বুঝা যায় এই দিনগুলো আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনগুলো কেন পালন করা হয়,কিভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো এগুলো,কোথা থেকে এলো? এই সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলের জানা থাকা উচিত নিজ দায়িত্বে।তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেইসবুকের কল্যাণেই আমরা দেখেছি, এখনো অনেকেই আমরা জানিনা এই দিনগুলো কি।কিভাবে,কোথা থেকে এলো? শুধু ছোট শিশুই নয়, শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বয়সী সর্বস্তরের কেউ আমাদের নিরাশ করেনি যারা সকলেই অম্লান বদনে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত হাসি বিস্তৃত করে উত্তর দিয়েছে  একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের বিজয় দিবস।যা আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয়।এরকমভাবে দেখা যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের দেশের অনেকেই জানেন না সঠিক ইতিহাস। কি হয়েছিল সেদিন? কিসের জন্য,কাদের বিনিময়ে আমরা আজকে কথা বলছি,খাচ্ছি,ঘুরে বেড়াচ্ছি স্বাধীনভাবে?এইসব ইতিহাস কতজন জানি?হয়ত অনেকে জানি কিছুটা কিন্ত পুরোটা আসলে অনেকেই জানিনা।আবার সেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীরা কতটুকু অবদান রেখেছেন সেই তথ্য হয়ত জানি হাতে গোনা কয়েকজন।আমরা জাতি হিসাবে এখনো অনেকটা অনগ্রসর উন্নত বিশ্বের তুলনায়।আর আমাদের নারীরাও এখনো পিছিয়ে আছে অনেক ক্ষেএে।সেই নারীরাই আজ থেকে ৪৭ বছর আগে নিজেদের সন্তান, সংসার কে একপাশে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।সেই অনবদ্য ইতিহাস ও সংগ্রামের কথা অনেকে না জানলেও জানার সুযোগ এসে গেলো যখন তাদের নিয়ে লেখা হলো একটি অসাধারণ বই,"একাত্তর ও নারী "।যা প্রকাশ করেছে বাঙালি।
বইটি লিখেছেন রহিমা আক্তার মৌ।যিনি একাধারে একজন কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় গল্প, কবিতা, ফিচার, কলাম, প্রবন্ধ ও নারী বিষয়ে লেখা লিখে আসছেন। সমাজের নানা অসঙ্গতির ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ আর অবসর সময়কে কাজে লাগাতেই মুলতো তিনি কলম হাতে নেন।২০১৫ সালের পহেলা ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকার মুক্ত আলোচনা বিভাগে 'একাত্তর ও নারী' শিরোনামে নিয়মিতভাবে লেখাগুলো প্রকাশ হতে থাকে।এই বইটিতে তিনি ষোল জন নারীর কথা বলেছেন যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। বইটিতে শওকত আরা,হালিমা খাতুনদের মত নারীরা যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা দেখে একদিকে যেমন শিউরে উঠেছেন পাশাপাশি তাদের ক্রোধের আগুনে নিজেকে পরিণত করেছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে।
"শেখপাড়া,চব্বিশনগর,ঘোড়ামারা,বোয়ালিয়া,আলকার মোড়সহ আশপাশের গলিতে গলিতে ছিল শওকত আরার কাজ।৭ অক্টোবর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী আর শওকত আরা চারটি ট্যাংক বিষ্ফোরক,কয়েকটি এসএমজি,গ্রেনেড ও গুলির ম্যাগাজিন ভর্তি ট্রাকটি নিয়ে কোর্ট এলাকা থেকে ঘোড়ামারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।রাস্তায় পাকসেনারা তাদের অনুসরণ করতে থাকে।শওকত আরা যে যুদ্ধের সাথে জড়িত,এই খবর পেয়ে যায় পাকহানাদাররা।তাকে ধরার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করে পাকবাহিনী।"
এমন সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনায়িত এই বইয়ের প্রত্যেকজন নারীর অংশে।যেখানে একজন নারী তার স্বামী, সংসার ও সন্তানের কথা না ভেবে, ভেবেছেন এদেশের মানুষের মুক্তির কথা।যেখানে দেখা যায় সমাজের কত অন্যায়,অবিচার, অশালীন কথা সহ বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের।তাদের ব্যক্তিগত জীবন ছাপিয়ে তাদের সামাজিক ও জাতীয় জীবনেও মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্মম বাস্তবতার।যে বাস্তবতা তাদের স্ত্রী হিসাবে করেছে বঞ্চিত,মা হিসাবে রেখেছে সন্তান থেকে আলাদা, স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছে কলুষিত। এই বইয়ের পরতে পরতে এরকম কঠিন ত্যাগ ও দেশপ্রেমের অসংখ্য কথা বলা হয়েছে এবং তার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু অসাধারণ তথ্য যা বইয়ের পাঠকগনকে চমকে দিবে প্রত্যেক অংশের শুরুতে।মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতা, মুক্তিযুদ্ধের আসাধারণ চমকপ্রদ ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষার এক চমকপ্রদ উপস্থাপন এই বইটি জুড়ে।যা সকল বয়সী ও সকল শ্রেণীর পাঠকের জন্য সহজেই বোধগম্য।আমরা প্রায়শই ভাবি নারীর জীবনে তার স্বামী,সংসার, সন্তান এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই,কিন্তু সেই আমাদের বদ্ধমূল ধারনাকেও ছাপিয়ে এই বইয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে যে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে নারীর জীবনে। কিন্তু একজন মা যখন ছোট শিশুকে রেখে চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে; যাতে তাদের সেবা শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারে।সেই গল্প আমাদের গর্বের,আনন্দের।যার নাম স্বাধীনতা, যার নাম মুক্তি।
প্রাথমিকভাবে বইটি পড়ার সময় মনে হতে পারে প্রত্যেক অংশের প্রথমে একইরকম তথ্য দেয়া কিন্তু একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই বুঝা যাবে কি অসাধারণ নৈপূন্যের সাথে মুক্তিযুদ্ধের অজানা তথ্য দিয়ে পাঠককে বিস্মিত করেছেন।বইটি পড়ার সময় আমি যেই তথ্য ও ঘটনাপ্রবাহে বিস্মিত হয়েছি,যতটুকু উত্তাপ অনুভব করেছি,আপনারা হয়তো সেরকম বিস্মিত,সে রকম উত্তাপ অনুভব নাও করতে পারেন কিংবা আমার চেয়েও বেশি উত্তাপে আন্দোলিত করতে পারে,শীতল স্রোত বইয়ে দিতে পারে আপনার শিরা উপশিরায়।আপনার মধ্যে আলোড়ন তৈরী করতে পারুক অথবা শীতল স্রোতে না ভাসাতে পারুক,নারীদের অসামান্য অবদান ও ত্যাগ আর মুক্তিযুদ্ধের সব অজানা তথ্য আপনার মস্তিষ্কের তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।আপনি যদি ইতিহাস,মুক্তিযুদ্ধ,মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্য আর আমাদের মা বোনদের সেই মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের কথা সঠিকভাবে জানতে চান তাহলে এই বইটি অদ্বিতীয়।মুক্তিযুদ্ধ,মুক্তিযুদ্ধকালীন তথ্য ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীদের অবদান জানার জন্য ক্ষূধার্ত বাঘ হয়ে থাকেন তাহলে বলব এই বইটি অরণ্যঘেরা অসংখ্য হরিণ শাবকের বিচরনভূমি।

'একাত্তর ও নারী'
লেখক- রহিমা আক্তার মৌ
প্রকাশক - আরিফ নজরুল।
প্রকাশনা - 'বাঙালি'
প্রকাশকাল - ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রচ্ছদ- তাবাচ্ছুম মেহরীন।
শুভেচ্ছা মূল্য- ২০০/( দুইশত টাকা মাত্র)





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট