গল্প : বিরঙ্গনা



 বিরঙ্গনা
মোহাম্মদ অংকন

তন্নির বয়স তখন ১৬ বছরের মত। দেশে একাত্তের যুদ্ধ লেগে যায়। গ্রামে গ্রামে দলে দলে মিলিটারি পাক সেনারা আসতে থাকে। তন্নিদের গ্রামনিভৃত একপল্লী। চারিদিকে ঝোঁপঝাড় জঙ্গলে ঘেরা। অপরিচিতদের রাস্তা-ঘাট মনে রাখা মুশকিল। গ্রামের সবার কাছে খবর পৌঁছে গেল, কলম গ্রামের স্কুলমাঠে মিলিটারী বাহিনী ক্যাম্প তৈরি করেছে। এলাকার সকলের মনে ভয় ভীতির জন্ম নিল। তন্নির বাবা ছিল তাগরা জোওয়ান। যখন রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চেরভাষণশুনেছিল, তখনই মনোবল স্থীর করেছিল যুদ্ধ করার।

তন্নির স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি কোনো দিন। গ্রামের পথেঘাটে, বনে বাদারে দৌঁড় ঝাঁপ করেই এত বড় হয়েছে। গ্রামের পথঘাট ওর একদম চেনা। মেয়েটি দেখতে অনেক সুন্দরী। যেন গ্রামবাংলার সব রুপ-রস-রং দিয়েতার দেহখানা তৈরি করেছেন বিধাতা। এত সুন্দরী একটি মেয়ে, তবুও সে মেয়েদের পোষাক পড়েনা। সবসময় ছেলে হয়ে থাকে। যে কেউ দেখেই বলবে, এ তো ছেলে মানুষই। যখন প্যান্ট, শার্ট পড়ে,তখন মনে হয় এ যেন সত্যিই ওর বাবার বড় ছেলে। ওর জন্মেও আগেই ওর একটি ভাই হয়েছিল। বসন্ত রোগের কবলে পড়ে পৃথিবীতে টিকতে পারেনি। সেই ছেলের অভাব পূরণের তাগিদে তন্নিকে ছেলেদের পোষাক পড়িয়েই বড় করেছে তারমা-বাবা। তন্নিও এখন সেসব পোষাক ছাড়তে নাছড়বান্দা।

সেদিন ছিল এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ। পাক সেনাবাহিনী কলমগ্রামে প্রথম হানা দেয়। ধওে নিয়ে যায় অসংখ্য যুবকদের। গুলি কওে হত্যাকরে। তন্নিরবাবা ও আরও কয়েকজন পালিয়ে আতœগোপন করে। বাড়িতে পরে থাকে তন্নি আর ওর মা। ওদেও মাঝে ভীষণ ভয় কাজ করে। ওরা রেডিওতে শুনেছিল, পাকবাহিনীরা সুন্দরী মেয়েদেরও ক্যাম্পে ধওে নিয়ে যাচ্ছে। কারও কাছ থেকে নাচ দেখছে, কারও কাছ থেকে গানশুনছে। অতঃপর ইজ্জ্বত হরণ কওে রাস্তায় ছুড়ে মারছে।

বিকালের দিকে পাকবাহিনীরা তন্নিদের পাড়ায় টহল দিতেআসে। এক সময় তাদের বাড়িতেও আসে। ওর মাআর ও ঘরেই ছিল। এমন সময় তাদের দরজায় পাক সেনারা কড়া নাড়া। শার্ট-প্যান্ট পড়–য়া তন্নি তার বাবা হবে ভেবে দরজা খুলেই যেন থমকে যায়। এই প্রথম সে মিলিটারী দেখল। এক মিলিটারী উর্দু ভাষায় তাকে জিজ্ঞেস করে-
:তোমারবাড়িতে কে কে আছে?
তন্নি বুদ্ধি কওে উল্টর করে যে সে একাই রয়েছে। তারপর ওর হাত ধওে নিয়ে এসে ওদেও উঠোনে দাঁড় করিয়ে এক এক করে প্রশ্ন করতে থাকে।
: খোকা, তোমার নাম কি?
খোকা শব্দটি শুনতেই তন্নির মনে ছেলে ছেলে ভাব চলে আসে। সে চিন্তাকরে, হয়তো মিলিটারীরা আমাকে চিনতে পাওে নাই যে আমি ছেলে নাকি মেয়ে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তন্নি বলে ওঠে-
: আমার নাম মোঃইউসুফআলী।
: তুমি কি গ্রামের পথঘাট ভালো কওে চিনো, খোকা? সত্য না বললে গুলি করব।
: হ্যাঁ, আমি চিনি।
: চল আমাদের সাথে। এই গ্রামের সকলের বাড়ীতে নিয়ে যাও। তোমাকে আমরা মারব না। তুমি বাচ্চা ছেলে। একটু পর চলে এসো কেমন?

এমন পরিস্থিতিতে তন্নি বিপাকেই যেন পরে যায়। নাপারছে ওদেও হাত থেকে রেহাই পেতে, না পারছে মা’কে ডাকতে। কিন্তু ওর প্রবল সাহস ওকে তাড়া কওে ফিরছে। ও জানে, ওর বাবা যুদ্ধেই গেছে। তাই ও যুদ্ধ করতে চায়। যেহেতুএদের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছে, তাই ওর বাবাকে সহ সকল মুক্তিবাহিনীকে এদেও কার্যবিধির খবরাখবর দিতে পারবে। তাই ওদেও কথামাথা পেতে নিয়েগ্রাম ঘুরতে থাকে। ওর সামনে ওই গ্রামের জমসেদ, রকিব, নূরনবীকে হত্যা হতে দেখে সেদিন। তন্নির গাঁ শিউর্ েওঠে। ভয়বাড়তে থাকে। আর ভাবতে থাকে, ‘আমাকে ওরা কখন বাড়ি যেতে দিবে? যদি বুঝতে পারে, আমি ছেলে নই, তাহলে কি আমাকে ওরা ভাল রাখবে?

সন্ধ্যায় তন্নিকে মিলিটারী বাহিনীরা ওদেও ক্যাম্পে নিয়ে রাখে।
: খোকা, তুমিচিন্তা কর না, কালই তোমাকে বাড়ি যেতে দেব। আমরা এখান থেকে কাল চলে যাব।
তন্নি একটু স্বত্বি পায়। তন্নিকে মিলিটারীরা আদও যতœ করতে থাকে। ভাল মন্দ খেতে দেয়। তন্নি বুঝতে পারে, হয়তো ওরা আমাকে মারবেনা। কিন্তু ভয় একটাই, আমি তো মেয়ে। যদি জেনে যায়!

রাত গড়তেনাগড়াতেই মিলিটারীরা সবাই আড্ডা জমায়। তন্নিকে ওরা সঙ্গে নেয়। তন্নির ক্লান্ত শরীরে যেন তা নিতে পারছিলনা। পেট চুপছে আসছিল। ওদেরখাবার খেতে পারেনি খুব একটা। ছেলেদের শার্ট পড়লেই আর চুল ছোট থাকলেই কি নারীত্ব বোঝা যায় না? ১৬ বছরের একজন মেয়ে তার শারীরিক গঠন কেমন হতে পারে? নারীদেও শরীরের স্পর্শই বা কেমন হতে পারে? একজন পুরুষ মাত্রই তা নির্ণয় করতে পারে। তাই আড্ডা স্থলে মোঃ ইফসুফ আলী পরিচয়ের কিশোরকে একজন যুবতী হিসাবে আবিষ্কার  করতে জাদরেল মিলিটারীদের আর সময় করেও ঠালাগেনা।
সে সময় মেয়েদের ইজ্জ্বত হনন করা মিলিটারী জানোয়ারদের এক নেশা হয়ে দাঁড়ায়। তন্নিদের মত যুবতি পেলেতারা সব ভুলে যায়। শকুনের মত দেহটা কে চিড়ে চিড়ে ভক্ষণ করতে থাকে। আড্ডা বেশ ভালই জমে ছিল সে রাতে ঔ ক্যাম্পে। তন্নি ভাব ছিল, সকাল হলেই মুক্তি পাব। কিন্তু তারক্ষুধার্ত শরীরের গড়ন দেখে এক মিলিটারী তার বুকে হাত দিয়ে ফেলে। খামছে ধরে নব বেড়া ওাা নারী ত্বকে। তন্নিরপৃথিবীটা যেন উল্টো হয়ে যায় নর পশুর শক্ত হাতের থাবায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ও মা, জীবন গেল রে’। সবার কানে পৌঁছে যায়, তন্নি একজন নারী। তারপর দশ বারোটা শকুন তন্নির দেহটাকে ব্যবচ্ছেদ করে। খুলে ফেলে তার শখ কওে গায়ে জড়ানো লাল সবুজ শার্ট। শকুনদের লোলুপ দৃষ্টি দেখে সে আর দু’চোখ খুলতে পারেনা। তাকে উলগ্ন কওে নরপশুরা  মেতে ওঠে রঙলিলায়। অবলানারীর ‘বাঁচাও, বাঁচাও’কথাটি তাদের কানে একবারও পৌঁছায় না। কিন্তু আর কত সহ্য করা যায়। পুরুষ তো ওরা একজন নয়। তন্নির নারীত্ব কে বিলিয়ে দিতে হয় অবশেষে অসণিত পাক শকুনীদের ঠোঁটে। নিমিষে অপ্সান হয়ে ঢলে পড়ে শুকনো মাটিতে।

সকালে সূর্য ওঠে। মিলিটারিরা ছুটে যায় অন্য কোনোক্যাম্পে। তারপর তন্নির ঘুম ভাঙ্গে কয়েক শত কাকের চিৎকারে। নিজের দিকে তাকাতে পারেনা। শরীরের নি¤œাংশ জুড়ে চাপা চাপা লাল লাল রক্ত ফিনকিদিয়ে তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। পিঠে আর বুকে খামচির শত দাগ ফুলে উঠে। ধবধবে সাদা শরীরটা যেন কয়লা হয়ে গিয়েছে। বাম পাশে কাত হয়ে শার্টের ছেড়া টুকরো দিয়ে চেপে ধরে রক্ত নিসৃত ক্ষত বিক্ষত অঙ্গ। লজ্জা নিবারণ কওে ছুটে যায় প্রিয় মায়ের কাছে। গতকাল থেকে পথ চেয়ে বসে থাকা আদরের মা তন্নিকে দেখে যেন বাড়ির বারান্দায় আছড়ে পড়ে। তন্নি মুখ ফুটে বলে ওঠে, ‘মা, আমার আর কিছু রইলনা...।’
নয় মাস যায় কিংবাতারও বেশি সময়। শত শত মা বোনদের ইজ্জত হারানোর মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর ঐ সব মা বোনেরা বিরঙ্গনা হয়ে বেঁচে থাকে এই স্বাধীনতাকে দেখার জন্য। এক সময় বিরঙ্গনা তন্নি মা হয়ে যায়। জন্ম নেয় ছেলে সন্তান। কিন্তু পিতা যে কে সেই সন্তানের কোন ভাবে তা যেমন নির্ণয় করা যায় না, তেমনি জীবনের মায়া ত্যাগ কওে আত্মহত্যা করা হয়না। তন্নির বাবা যুদ্ধের ময়দান থেকে এক সময় ফিওে আসে। নাতির ফুটফুটে মুখখানা দেখে সব দুঃখ ভুলে গিয়ে তার নাম রাখে‘বাংলাদেশ’।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট