আনন্দময় এক স্মৃতিপর্ব
রাহাত রাব্বানী
এমন কয়েকজন ব্যক্তি আছেন, যারা ঈদের খুশি, ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে পারেন বহুগুণ। যাদের সাথে কিছুসময় থাকার গোপন ইচ্ছে অনেকেরই। তেমন একজন ব্যক্তি মাশরাফি; যাঁর অন্য কোনো বিশেষণ প্রয়োজন নেই। বরং তাঁর নামই মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় প্রতিটি মানুষের ভেতর, প্রেরণা জোগায়। হ্যাঁ, বলছিলাম ঈদ-উল-ফিতর ১৭ এর কথা। যা অন্যান্য বছরের ঈদ আনন্দকে ছাড়িয়ে যায় ঢের বেশি। এবং এর মূলে রয়েছে মাশরাফির স্মৃতি।
ঈদের সকাল। প্রতিবারের মতোই ফজরের নামাজ শেষে চাচাতো ভাই সিয়ামকে নিয়ে বেরিয়ে পরি আশেপাশের বাড়িতে। প্রতিবেশী চাচাতো ভাই মিজানও তখন আমাদের সঙ্গ দিয়ে যায়। ঘুরা হয় গ্রামের কিছু অংশ। শুভেচ্ছা বিনিময়ের সাথে কয়েক বাড়িতে সেমাই-পায়েসও খেতে হয় আমাদের। এরপর গোসল শেষে নতুন পাঞ্জাবিতে নিজেকে সাজিয়ে বেরুতে হয় ঈদের নামাজের জন্য-পিয়ার আলী ঈদগাহ ময়দান। তার আগে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সাথে দেখা করা যেন আমাদের পুরাতন রুটিন। যার অনেকাংশজুড়ে পকেট ভারী করার লোভ কাজ করে। একটা সময় ছিলো ঈদ সেলামীতে পাঞ্জাবির পকেট ভারী হতো। কিন্তু এখন আর সেই ভাগ্য হয় না। বয়সের সাথে সাথে কতকিছুই না বদলে যায়! চাচাতো ভাই শিশির, তুষার, সিয়ামসহ গ্রামের অন্যান্যদের সাথে চলতে থাকি নামাজের উদ্দেশ্যে। নামাজ শেষে মাওনা বাজারে সামান্য আড্ডা। বিকালে ভিন্ন পরিকল্পনা বন্ধুদের সাথে। অথচ সেইবার বিকালের কোনো পরিকল্পনা ছিলো না আমার। সাধারণ একটা দিনের মতোই সেই ঈদের বিকাল। অনেকটা গোপন অভিমান। রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি সকালে ঢাকা ফেরত আসবো। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারেনি মগজে। নিউরণে নতুন ভাবনা ঢুকিয়ে দিলো সমকাল গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি ইজাজ আহমেদ মিলন (ভাই)। মাশরাফি বিন মর্তুজার সাথে দেখা করতে যাওয়ার মতো এক সংবাদ মুহূর্তেই হৃদয় আকাশ থেকে কাটিয়ে দিলো মন খারাপের মেঘ। এরপরের আনন্দ আর দেখে কে!
ঘড়ির কাঁটা যেন স্থির হয়ে বসেছে। আমার উত্তেজনার কাছে পরাজিত। চোখে ঘুম নেই। কখন ভোর হবে? কখন ভোর হবে?-প্রশ্নটাই আমার পুরো রাত দখলে নিয়েছে। অবশেষে কাঙ্খিত সেই সময়। নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগেই অনেকটা অন্ধকার নিয়ে হাজির হলাম মিলন ভাইয়ের বাসায়। আগের রাতেই এখানে এসে রয়েছেন ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সোহাগ সুমন, কবি খন্দকার ছাঈম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই আসলেন অগ্রজপ্রতিম বন্ধু কাওছার মাহমুদ ও শরীফ চৌধুরী। এছাড়া মিলন ভাইয়ের সহধর্মিণী বিউটি ভাবি এবং তার দুই পুত্র তো থাকছেনই আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে।
ভোর চারটার দিকে সলিংমোড় থেকে আমাদের মাইক্রোবাস যাত্রা শুরু করে। যাত্রার পূর্বেই সোহাগ সুমনের একটি সেল্ফি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। কেননা সেল্ফির শিরোনাম বেশ রহস্যময়। মাওনা চৌরাস্তা থেকে যোগ দিলে বাচিকশিল্পী ইকবাল আহমেদ নিশাত, প্রিয় নিশাত ভাই। অত্যন্ত শৌখিন এই মানুষের উপস্থিতি আমাদের আনন্দ-উত্তেজনায় নতুন মাত্রা প্রদান করে। আমাদের এই আনন্দের সাক্ষী হওয়া থেকে বঞ্চিত হোন সাংবাদিক রাজীবুল হাসান। হঠাৎ এপেন্ডিসাইটিস এর পীড়া তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালের বিছানায়। রাজীব ভাইকে হাসপাতালের বিছানায় রেখেই আমরা চলছি মাশরাফি ভ্রমণে।
ফাঁকা রাস্তা। গাড়ির গতির সাথে কেটে যাচ্ছে রাতের অন্ধকার। এরসাথে নিশাত ভাইয়ের ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তির পাশাপাশি গান আমাদের ভাসিয়ে রাখে আনন্দ সাগরে। আমাদের সোহাগ তো আছেই! অবশেষে ঢাকার রাস্তা শেষে পৌঁছালাম পদ্মার পাড়ে। এখানে প্রাতরাশ হবে পদ্মার ইলিশ ভাঁজার সাথে। পছন্দসই ইলিশ অর্ডার করে ছবি তুলার প্রাথমিক এক পাঠ শেষ করা হলো।
খাওয়া পর্ব শেষে পুনরায় যাত্রা শুরু। পদ্মার বুকে ভেসে চলছি। শীতল বাতাস আর মিষ্টি রোদ সব মিলিয়ে পদ্মার পরিবেশ কী যে দারুণ কাব্যময়!-তা বর্ণনার বাইরে। এরমাঝে নিশাত ভাইয়ের কণ্ঠে গান ‘পদ্মার ঢেউ রেএএ.....’। তাছাড়া ছোটখাটো একটি সাহিত্য আড্ডাও জমে ওঠে মাঝপদ্মায়।
দীর্ঘ এ ভ্রমণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত পদ্মা ছাড়াও দেখা হয় জসীম উদ্দীন এবং হুমায়ুন আজাদের আড়িয়াল খা নদীর সাথে। এছাড়া মধুমতী নদী ছিলো আমাদের ভ্রমণের এক বিশাল সাক্ষী।
অবশেষে ধরা দিলো সেই স্বর্ণালী সময়। পৌঁছি মাশরাফির বেড়ে ওঠা মামা বাড়িতে। রাস্তার পাশে থাকা মামার এই দালানবাড়িতেই থাকেন জনগণের অধিনায়ক। দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির বয়স কম নয়। বাড়ির সামনে ছোটোবড়ো, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপচে পরা ভীড়। সবার উদ্দেশ্য প্রিয় অধিনায়কের একটু দেখা পাওয়া। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই ক্যামেরা বন্দী করি ভীড়ের এই দৃশ্য। যা সাক্ষ্য দেয় মাশরাফি শুধু একজন ক্রিকেটার নন, তিনি ভালোবাসার নাম। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখা হলো মাশরাফির সহোদর মুরসালিন এর সাথে। আমাদের পরিচয় দিলাম।
মুরসালিন যেন জনতার মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন, ‘ভাইয়া ঘুমিয়েছেন। এখনি ওঠে এসে সবার সাথে দেখা করবেন।’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ম্যাশের অৎ¯্র ভক্ত প্রতীক্ষায় আছেন। কারো মাঝেই বিরক্তি নেই কোনো।
জনসমুদ্রের এই উদ্যান সৈকতে সাদা টি-শার্ট গায়ে লম্বা দেহের অধিনায়ক এসে দাঁড়ালেন। মনে হলো- ‘তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার...’
মাশরাফি দাঁড়িয়ে আছেন অজ¯্র ভক্তের ভীড়ে। আমরা দূর থেকে দেখছি তাঁর উদারতা, নিরহংকার ব্যক্তিত্ব। মাশরাফি যে উদার একজন ব্যক্তি তা খেলার মাঠেই প্রমাণ দিয়েছেন । তবুও তাঁর উদারতা সামনে থেকে যতই দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। আগত সবার সাথেই কুশল বিনিময় করছেন, কোলাকুলি করছেন, ছবি তুলছেন। সামান্য বিরক্তও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেন নি। মুরসালিন জানায় সকাল থেকেই তিনি এভাবে ভক্তদের সাথে দেখা করছেন। ভীড় অনেকাংশে কমে গেলে আমাদের দল বিশেষ মাধ্যমে ম্যাশের সাথে সময় কাটায়। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়াও মিলন ভাই তাঁর দুটি গ্রন্থ এবং আমি উপহার দেই আমার গ্রন্থ। মাশরাফি বিন মর্তুজাকে গ্রন্থ উপহারের উল্লেখযোগ্য এই স্মৃতির আলোকচিত্র ধারণ করে মুরসালিন বিন মর্তুজা এবং খন্দকার ছাঈম।
মাশরাফি শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম একজন সফল অধিনায়ক হওয়া সত্তেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি তাঁর আশেপাশে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হলেও মাশরাফি নিজ থেকে তা পছন্দ করেননি। তিনি তাঁর ভক্তদের সাথে দেখা করবেন। এবং তিনি জানেন তাঁদের ভালোবাসার গভীরতা। যার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফেরত নেওয়া হয়। [মাশরাফির বন্ধু ও এলাকাবাসীর থেকে পাওয়া তথ্য]
মাশরাফির সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই সময় যেন জীবন পাতার অন্যতম এক স্মরণীয় আনন্দ স্মৃতি। যেই আনন্দের কাছে হার মানে অনেক মধুময় সময়। কালের হিসাবে মাশরাফি ভ্রমণ অতীত হলেও এর রেশ রয়ে যাবে বছরের পর বছর। যা চির বর্তমান হৃদয় পঞ্জিকায়। কেননা তিনি মাশরাফি। আর কোনো জাতির ইতিহাসে এমন মানুষই আসে শতবর্ষের আরাধনায়।