ঈদ
আহমদ মেহেদী
১. ঈদ এলেই কাপড় পট্টিতে উপচে পড়া ভিড় থাকে। জৈষ্ঠের গরম আর রোযা মিলে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। আমার বন্ধু সোহেলের বাড়িতে কামরাঙ্গা গাছটার নিচে বসে আছি। উদ্দেশ্য দুজনে দাবা খেলব, গাছের নিচে বেশ ছায়া। আর বিকেল হলে বাজারে যাব। পকেটে নানার দেওয়া পাঁচশ টাকার মলিন নোটটা নিয়ে ভাবছি। ঈদ নিয়ে ভাবছি, ঈদ নামক স্বপ্নের মাঝে কেটেছে আমার গতকাল রাত্রটা। আজকের বাজারে পাঁচশ টাকা দিয়ে কিইবা কেনা যাবে? সোহেল বলল-কিরে এবার ঈদে কিছু কিনবিনা? আমি বললাম-কিনব। আসলে পাঁচশ টাকা দিয়ে আমার ও সোহেল এর জন্য দুটি টি শার্ট কিনব ভেবেছিলাম। সোহেল বলল-আমার দরকার নাই,তুই একটা ভাল চাইয়া কিইন্নালা। সোহেল ওআমার পারিবারিক অবস্থার ততটা পার্থক্য নেই। তার বড় সংসার আর আমি ধনী নানার বাড়িতে থাকি বলে এই টাকাটা জুটেছে। প্রতিটি ঈদ এলেই সোহেল খুব গম্ভীর হয়ে থাকে আর আমায় বলে-কিরে এবার ও কি ঈদে কিছু কিনতে পারবনা? আমি বললাম-দেখ আমার কাছে পাঁচশ টাকা আছে;বিকেলে তুই আর আমি মিলে বাজারে যাব। দেখি দুটা কম দামি টি শার্ট আনতে পারি কীনা। এই বলেই দুজনে দাবা খেলায় মন ভাসালাম।
দাবা খেলছি আর ভাবছি। গত কয়েকটি ঈদে আমরা একে অন্যের সঙ্গী হয়ে ঈদের অজুহাতে আধুুনিক মহড়ায় সামিল হতে পারিনা। খেলায় মন থাকলেও কয়েকটি পাঁচশ টাকার চকচকে নোট চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। বাবাকে ও কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আমার প্রাইভেট পড়ার টাকা যোগাতে চাউল বিক্রি করতে হয়েছিল তার উপর মা’র অসুখ। কিছুই ভাবতে পারছি না। মানুষ গরিব হয়ে জন্মায়,এতিম হয়ে জন্মায়। কিন্তু আমার সব আছে। (বাবা-মা, দাদা-দাদী,নানা-নানী)। তাই বলে ঈদের জন্য নিজের পছন্দ মত কাপড়-চোপড় কিনতে পারবনা? এ যে কি কষ্টের তা বলে শেষ করতে পারবনা। এমনিতে মা বাবার সাথে আমার লেখাপড়ার খরচ নিয়ে সবসময় ঝগড়া করে আসছে। মা বলত-তোমার এই ছেলের জন্য চাউল বেঁচার সবকটি টাকা খরচ করলে? আর আমরা না খেয়ে আছি। পরিবাবের এমন হীন অবস্থা দেখলে সত্যি মনে বড় কষ্ট পেতাম,অকপটে দুচোখে জল এসে যেত। তাই ঈদ এলে আমার কাছে কখনও ভাল লাগেনি। আজও লাগে না। দু-বেলা খাবারের জন্য যে সংসারের কর্তার সবসময় যুদ্ধ করতে হচ্ছে সে সংসারের একটি ছেলের স্বপ্নের কোন দাম নেই,তার চাওয়া-পাওয়া নিতান্তই অবহেলিত। আমার ‘আমি’-কে বরাবরই এমন দৃশ্যের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম। যখন বন্ধুরা প্রশ্ন করতো ঈদগাঁহে যাইনি কেন তখন তাদের সত্য উত্তরটি কখনোই দেইনি। বরং বলেছি-এবার আমাদের গ্রামের ঈদগাঁহে গেছি। কাকা এমন ভাবে বলল না গিয়ে থাকতে পারিনি। বড়ই লজ্জার সেদিনের সেই মুহূর্তুগুলো। আজও সবটুকু স্পষ্ট মনে আছে। সোহেল ৮ম শ্রেণীর পর আর এগোতে পারেনি। আমি এস.এস.সি কোনরকম শেষ করেছি। সে সংসারকে টিকানোর জন্য সামান্য রোজগারের আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে। নানার বাড়ীতে থাকতাম বলে পরিবারের বোঝা যে কী তা তখন বুঝতাম না। কাজ সেরে বিকালে দুজনে কলেজের মাঠে চলে যেতাম। সুখ-দু:খের জলসাতারে হাবুডুবু খেতাম। মাধাইয়া মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি কলেজ মাঠ। যেই কলেজে আমাকে ও সহপাঠীদের জোড় করে ভর্তি করানো হয়েছে। আমার নানা এই কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য বিধায় আমাকে বলল-‘‘তুই এই কলেজে ভর্তি হয়ে যা,বেতন-টেতন লাগবেনা।’’
মা-তো শুনে খুব খুশি। কেননা বেতন ছাড়া কলেজে তার ছেলে ভর্তি হয়ে পড়তে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা ভাল কলেজে ভর্তির আশাকে মাটি চাপা দিতে পারল। আমার না থাকুক অন্য অনেকেরই সামর্থ্য আছে ভাল কলেজে পড়াশুনা করার। স্থানীয় এম.পি ও এম.পি’র-খাস দালাল এই কলেজের অধ্যক্ষ আমাদের কচি- স্বপ্নের শরীরে দু:স্বপ্নের -চাপাতি বসিয়ে দিয়েছিল। সোহেল বলল-‘‘তুই কি এই কলেজে পড়বি না? আমি বললাম-না। দরকার হলে পড়াশুনা করব না। এমনিতেই তো পড়াশুনা আর করা যাবে বলে মনে হয় না।
সোহেল বলল- কি আর করবি। ভর্তি হয়ে যা। ভালমত পড়লে এই কলেজ থেকেই ভাল রেজাল্ট করতে পারবি। আমি নিশ্চুপ ছিলাম সেদিন। সে তার জায়গা থেকে আমাকে বুঝানোর চেষ্টায় ক্রুটি করেনি। আমার নাড়ি- নক্ষত্র জানে বলেই শান্তনার সুরে কথাগুলো বলেছিল বিষন্ন আকাশ পানে চেয়ে।
সোহেল প্রায়ই বলত- আল্লাহ আমাদের তওফিক দিলনা দোস্ত । আমরার সমাইন্না বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেছে আমরা আমরা কই? এটাই নিয়তি আর নিয়তির নিষ্টুর ঝড়ে বলি হয় কিছু স্বপ্নের, স্বপ্ন-বিভোর কিছু পাগলেরা; একটু শুধু ভাল থাকতে চাওয়া জীবনের। যে জীবনে ঈদ এলেই মনে দু:খ ধানা বেঁধে উঠবে না। ছলছল চোখে সিগারেট টা ধরিয়ে বলত- কি আর করবি গরীব হয়ে জন্মেছি আমরা!
২.সাত দিন ধরে কলেজ বন্ধ। সারাদিন বাড়ীতে একা। সোহেল সোনাপুর কাজে গেছে। তার ফিরতে সন্ধ্যা হবে। তাঁর বোনের বাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিল। ছোট বোন-জামাইকে ঈদের দাওয়াত না দিলে নাকি বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হনুফাদের বাড়ি ‘তাবিজ বাবা’,র বাড়ীর নিকট। ‘তাবিজ বাবা,এই অজপাড়া গায়ের একটি আতঙ্কের নাম। রিক্সাচালক থেকে শুর“ করে সব শ্রেণীর মানুষের তার অদ্ভুত দরবারে যাতায়াত। একটু কল্যাণের আশায়-দু:খ-কষ্ট লাগবের আশায়। এমনও লোক দেখেছি যারা মা-বাবাকে ভাত দিতে নারাজ কিন্তু তাবিজ বাবাদের জন্য মরতে ও রাজি। এ সমাজ আস্তে আস্তে তথাকথিত বাবাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তাইতো সোহেল একদিন বলল-চল তাবিজ বাবার কাছে যাই। গিয়ে দেখি কিছু পাইকীনা।আমি যেতে চাইনি কিন্তু সোহেল বলাতে না গিয়ে থাকতে পারিনি ঐদিন। তার বোনের বাড়ীর কাজ শেষ করে রাতের অন্ধাকারে সোজা তাবিজ বাবার আস্তানায় হাজির হলাম। রাত্র তখন ১২.৩০ ধস হবে। বিস্ময়ের ঘোরে কেমন জানি লাগছে নতুন এই পরিবেশটাকে। তাবিজ বাবা একটি মাচার উপর একটি লুঙ্গী গায়ে বসা। খদ্দেরদের জন্যে ও একই ব্যাবস্থা। হনুফাদের বাড়ি থেকে ১-১.৫ কিলোমিটার দূরে হবে হয়ত। রাতের আধারে বুঝতে পারিনি। যারা নতুন যাবে তারা প্রথমেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবেন। বিড়ি ও গোলাপ জল ছিটানো গন্ধে চারদিক থমথম,ধ্যান-মগ্ন নিবিড় তপস্যা তাবিজ বাবার আস্তানা জুড়ে। আমি আর সোহেল মাচার উপর বসে পড়লাম। চামচা ধরনের একজন আমাদের দুজনকে দুটি বিড়ি এগিয়ে দিল। কিছুদিন হল সিগারেট ধরেছি। বিড়িতে অভ্যস্ত না। তারপর ও বাবার আস্ততানার বিড়িটা নিলাম। বিড়িটা টানছি আর ভাবছি এ কোথায় এলাম? মানব কূলের সকল রোগের ঔষধ নাকী এই সুখ্যাত বিড়ি। চামচা ধরনের লোকটি পরে অবশ্য নাম জানতে পেরেছিলাম ‘‘জালাল বখশী’’ মাচায় বসা সকল মক্কেলদের উদ্দেশ্যে-বলছে- ‘‘যার যা নিয়ত করে বিড়ি টানেন। আর যাওয়ার সময় ঐ দোকান থেকে(আঙ্গুল। দিয়ে ইশারা দিয়ে) দু’প্যাকেট বিড়ি নিয়ে যাবেন। যার যা সমস্যা ভাল হয়ে যাবে। বাড়ীতে নিয়ে মা-বাবাকে,প্রতিবেশীকে যার যেই রোগ,আরোগ্য লাভের জন্য এই বিড়িটা খাওয়াবেন। জালাল বখশীর কথা আমার কানে ঢুকছে না। পাশেই বসা মা’র মত বয়সী মহিলাদেরকে দেখছি। মনের সুখে বিড়ি টেনেই চলেছে। যেন কোন অদৃশ্য শক্তি সকলকে বিড়ি টানাতে বাধ্য করছে! তাবিজ বাবার একদল ভক্ত তার পায়ের কাছে তবলা আর ঢোল বাজিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করছে। একটা সুর মনে পড়ছে‘‘থাকতে যদি না পাই তোরে,চাই না মরিলে’’। মনের সুরে ঝং ধরা ভক্তরা সুর তেমন তুলতে পারেনি। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হল তাবিজ বাবা নাকী ল্যাংটাই থাকেন। তবে লুঙ্গিটা যত সামান্য পেচিয়ে রাখেন। মাচার মধ্যেই তাঁর মল-মূত্র ত্যাগের অভিনব ব্যবস্থা। বিড়ি টানাই তো চলছে তার ফাকে কিছুক্ষণ পর পর কয়েকজন লোক সম্ভবত বাবার খাস লোক কটবেল ফাটিয়ে নিয়ে আসতেন। বাবা শুধু হা করেন দু’তিন জন মিলে বাবাকে কটবেল খাইয়ে দেন। দুইজন অবিরত বিড়ি সাজানোতে ব্যস্ত । একটি শেষ হলে আরেকটি। তাবিজ বাবা কয়েক মিনিট পরপর(গুপ্তবায়ু) সজোরে ছাড়েন। সবাই নির্বিকার। আমার বিস্ময়ের সীমা অতিক্রমের পালা। কোন সে বনে খেলাম ধরা। ইচ্ছা করলেই যায়না ছুটা। সোহেল তাবিজ বাবার স্পেশাল বিড়ির অপেক্ষায় আছে। আমি কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম।
৩.পরদিন সকালে বাড়ীতে এলাম। নিজেকে কেমন জানি অপরিচিত লাগছে কিছুটা(সন্ন্যাসী সন্ন্যাসীভাব)। রাত জাগা আর তাবিজ বাবার কেরামতির অংশ বিশেষের ঘূর্ণিপাক স্মৃতিকে উলট পালট করে দিচ্ছে মনে হয়। কাল ঈদ গোসল সেরে তাবিজ বাবার টানের মত লম্বা একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠেই বাজারে চলে গেলাম। সোহেল আর আমি কাপড় পট্টির একপাশে দাড়িয়ে আছি। কত ভিড়। চেনা-জানা অনেক মানুষ। কারো হাতে ব্যাগ-ভর্তি কাপড়,কারো হাতে দামী মোবাইল। বাচ্চাগুুলোর বায়না ধরার যেন শেষ নেই। দেখতে ভালই লাগছে। আমাদেরই শুধু দেখার পালা। এ পালা শেষ না হলে ও কোন ক্ষতি নেই। মনের অজান্তে চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। এবারের ঈদেও আমরা নতুন কাপড় পড়তে পারব না! (তাবিজ বাবার বিড়িতে মনে হয় কাজ হয় নি।) তাবিজ বাবার কারণে হোক বা না হোক, সোহেল মালয়েশিয়ায় গেছে সাত বছর হল। গত পরশু আমার জন্য দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে ঈদের কেনাকাটার জন্য। সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট ‘‘নাগরাজ এবারের ঈদে তোর যা ইচ্ছা কিনবি। তাহলে সেদিনের দু:খকে ভুলে যাব। আর মার্কেটে গেলে দেখবি মার্কেটের আশে পাশে অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের মত কেউ উকি দিচ্ছে কিনা !
পকেটে দশটা এক হাজার টাকার চকচকে নোট। অথচ কিছুই কিনতে ইচ্ছা করছে না। আজ পকেটে টাকা আছে। কিন্তু একা যে কিছু কিনব তা পারছিনা আমি। বন্ধু টাকাটা জমা করে রাখলাম। তুই যখন দেশে আসবি তখনই না হয় কিনব দুজনে মিলে। আবার যাব যে জায়গায় দাড়িয়েছিলাম আমরা একদিন। অতীত অনেক কথাই মনে করিয়ে দেয়। সেদিনের কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তা কী ভুলা যাবে। যাবে না। আনন্দময় কাটুক সকলের ঈদ, বিষন্নতা দূরে থাকুক।