গল্প : দ্বি-খন্ডিত




 দ্বি-খন্ডিত
  তন্ময় আলমগীর

জাহানারা নিজের পার্সেল থেকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে আরিশা এবং তাশফিয়াকে দিতে দিতে বললেন- আংকেলের টাকা আংকেলকে ফেরত দাও। মাহমুদ সাহেব এতে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেলেন। লজ্জাও পেলেন খানিকটা। কোথাও কোন ধাক্কা লাগল? তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে গুতোটা যে গাঢ়, চোকা টের পাচ্ছেন। বললেন- কষ্ট পেলাম কিন্তু। জাহানারা বললেন- আর সব শিক্ষার সাথে সন্তানদেরকে আত্মসম্মানবোধটাও শেখাতে চাই। কিছু মনে করো না।
  আরিশা এবং তাশফিয়া নাচের তালিম নিতে চলে গেলে বাসাতে জাহানারা ও মাহমুদ ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ঠ থাকল না। বাইরের দুপুর ক্রমে এগুচ্ছে বিকেলের দিকে। খুব ধীর লয়ে। বর্ষার তেজহীন রোদে কোন প্রাণ নেই। এরচে পাতা ঝরার শব্দ বেশ কোমল। স্পর্শের মত খেলে যায় হৃদয়ের অতলে। দোলা দেয় ঢেউয়ের মত। রোদ পড়ে যাওয়াতে ছায়াছন্ন পরিবেশে এক ধরনের নৈঃশব্দ এসে জড়ো হয়েছে। রেলিংয়ে চুপিচুপ খুনসুটি করছে কয়েকটি চড়–ই। জানালার শার্সিতে ফোটা হাসনাহেনা ফুলের রাতের মাতাল গন্ধের ঝাঁঝ এখনো বাতাসে দৃশ্যমান। পর্দার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে ফ্লাইওভারের বুকে গাড়ির নিরব তোলপার। চোখে চিকচিক করছে শুভ্র আকাশের হাস্যরস।
  জাহানারা জানে, শুধু তার না, মেয়ে দুটো আশফাকেরও। দেখতে তার মত হলেও ওদের শরীরে বইছে আশফাকের রক্ত। তবে অতটুকুই। আর কোন প্রভাব, চিহ্নের ছিটেফোটাও নেই। থাকতে পারত। থাকার সুযোগ দেয়নি জাহানারা। জমজ সন্তান দুটো যখন কোলে, সেই তখন থেকে আশফাককে টাকার নেশায় পেয়ে বসে। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা, ব্যবসা দিয়ে প্রতিষ্ঠান। তারপর আজকের এই প্রতিষ্ঠিত আশফাক।
  টাকা দিয়ে এমন কোন হীন কাজ নেই যা সে করেনি। মদের নেশা, নারীর নেশা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ক্ষমতার নেশা। যে হাত দুটো ধরলে আবেগে বিগলিত হত জাহানারা, টাকা সে হাত দুটোকে পাপাস্ত্র বানিয়ে দিয়েছে। আরিশা, তাশফিয়ার কথা ভাবতে গেলে তবুও যেন কিসের এক পরাজয় অনুভ’ত হয় আশফাকের কাছে। রাগ-অনুরাগের দরোজা ভেঙ্গে হুরমুর করে ঢুকে পড়ে দক্ষিণা বাতাস। লকলকে লতাগুল্মের গায়ে খেলে যায় শীতল পরশ। তখন কী মনে হয় জাহানারার? মাহমুদ সাহেব জানতে চান। জানতে গিয়ে অবাক না হয়ে পারেন না। তিনি ভেবেছিলেন নিশ্চয় কষ্ট-টষ্ট হয়।
-ঠিক তা নয়। আনন্দ আনন্দ লাগে।
-আনন্দ! খানিকটা মিইয়ে পড়ে মাহমুদ সাহেবের গলা।
-হুম, আনন্দ। কিছুটা বেমানান লাগছে তাই না?
-কিছুটা না, পুরোটাই। দৈতসত্ত্বার শক্তিটা আসে কোথায় থেকে আমি জানি না।
-আমি জানি। আমাদের মত মানষদের মনে শুধু প্রেম বা শুধু ঘৃণা থাকে না। প্রেম আর ঘৃণা মিলে প্রেম অথবা প্রেম আর ঘৃণা মিলে ঘৃণা। যাকে বলে মাল্টি-ইমোশন। ফালুদা খেয়েছো তো? প্রতি চামচে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। সব স্বাদের কথা মনে থাকে না। তবে সব স্বাদের শেষে যেটা জিভে লেগে থাকে সেটাই আসল।


-তার মানে আশফাককে তুমি পুরোপুরি ভালও বাস না আবার ঘৃণাও করো না।
-কিছুটা এমনই। তবে তোমার ব্যাপারটা আলাদা।
  দুজনই শোয়ার ঘরে ঢুকল। হাতে দুঘন্টার মত সময় আছে। সন্ধায় আরিশা, তাশফিয়া ফিরলে ওদেরকে নিয়ে বাইরে বেরুতে হবে। বেনারশি পল্লিতে বসেছে তাঁতের মেলা। কিছু তাঁতের জামাকাপড় কেনা দরকার। জাহানারা চান, তার মেয়েরা মনেপ্রাণে এমনকি শরীরেও বাঙালি হোক। অন্তত তার মত যেন না হয়। এ উত্তাপ বড় ভয়ঙ্কর।
  জাহানারা কড়া করে দুটো কফি বানিয়ে এনে বারান্দার চেয়ারে এসে বসলেন, মুখোমুখি। খানিকটা হালকা লাগছে জাহানারার। কফিটা খেলে আরো ঝরঝরে হয়ে যাবেন। মাহমুদ সাহেব এসেছে বলে নয়, এই মুহুর্তে নিজেকে ভুলে থাকা ভীষণ প্রয়োজন তার। আশফাক যখন গভীর রাতে ঘনিষ্ট হত, তখন একপেশে জীবনটাকে এক নিমিষেই উড়িয়ে নিত পল্লবিত গাছটার লকলকে মগডালে। চারপাশের দিগন্তবিস্তৃত শুভ্র আলো পেলব ছোঁয়ার মত ঘিরে থাকত দেহপ্রাণ। কিন্তু এমন আশফাকের দেখা মিলত কদাচিত, সাগর সেঁচে মুক্তো আনার মত। সেই অতৃপ্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে সহজেই জায়গা করে নিল মাহমুদ সাহেব। অবিবাহিত। কাঁচা আবেগ আর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে পরাভ’ত হল জাহানারা। প্রথমে পার্ক, শপিংমল, চুমু। ক্রমান্নতির ধারাবাহিকতায় এখন তা বিছানা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
  জাহানারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে আরো খানিকটা সময় নিলেন। শরীর ক্লান্ত হলেও সরিষার দানার মত যতটুকু মন জুড়ে আছে আশফাক তা এখনো সচল। বিবেকটাও যাবতীয় কুসংস্কার নিয়ে পাহাদারের মত হাঁক ডাকছে। ডেবডেবে চোখে এখনো জেগে আছে পোড় খাওয়া অন্তঃপ্রাণ। জ্বও জ্বর লাগছে জাহানারার? নিজেই দেখল কপাল ছুঁইয়ে। এ সময় শরীর গরম হওয়া দারুন সুখের। কামজ্বরে আক্রান্ত না হলে প্রেমের খেলা জমে না।
  অতটা উচ্চমার্গীয় অভিরুচির বা বিলাসি ছিলেন না জাহানারা। আশফাক শিখিয়েছে। সোসাইটিতে তাল মেলাতে হলে আত্মঅহং (অন্য অর্থে অন্যের কাছে সস্তা হওয়া) বেশ শক্ত হাতিয়ার। এটাকে বহিঃখোলসও বলা যায়। ভেতর পুড়ে খাঁ খাঁ করলেও বাইরের জগতটাকে শোনাতে হয় সমুদ্রগর্জন। জাহানারা সে পথে পা বাড়ায়। কিন্তু টিকেনি। পিছলে পড়া পায়ের চিকিৎসা দাবি করলে আশফাক পথ্য দেয় আরো ভাঙতে ভাঙতে তারপর শক্ত হওয়ার। ততদিনে দুজনের শপথি হাতদুটো অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। পরিচর্য়ার অভাবে ভালবাসার খুঁটিতে ধরেছে ঘুণপোকা। অন্যের গরম ভারা ভাত রেখে আশফাক যেমন ফিরতে চাইত না ঘরে, তেমনি ধীরে ধীরে নিজেকে শানিত করল জাহানারা। মাঝখানে মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসলেও আশফাকের দেখানো পথে সেও যোগ্যসঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেল মাহমুদ সাহেবকে। মনের দলিল থেকে এমনকি শরীরের মালিকানা থেকেও ছিটকে যেতে লাগলেন আশফাক সাহেব।
  শেষ ধাপে অবস্থান করছেন জাহানারা। আশফাকের পতনের পর বিবেকের কুটুরিতে এখন কেবল টোকর মারছে মেয়েদুটো। বড় হওয়া, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যতের সিঁড়িগুলো উতরে যাবার প্রকৌশল তাদের জানা আছে কিনা সে চিন্তা। কেননা, জাহানারা নিজেই অন্ধ, বধির হয়ে সময়ের ¯্রােতে ঘুরপাক খাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে কোথা থেকে কোথায়া পা ফেলছে জানে না। অন্যের জন্য মসৃন পথের সন্ধান দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তবে, দু মেয়ে বা আশফাকের জন্য নয়, ফুরফুরে গতরে সুন্দর পৃথিবীর অপরপিঠের রুঢ়, কর্কশরুপ ছাড়িয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিজেকে কিছুটা আড়াল করতে পারছেন, সেটাইবা কম কীসে?




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট