নাফু
নূরে জান্নাত
বর্ষার শেষ,শরতের শুরু। আকাশে মেঘ ভেসে বেড়ায়। নদীর কুলের কাঁশবনে ফুল গুলো বিকেলের বাতাসে নেচে নেচে ওঠে। নদীতে পালতোলা নৌকা গুলো পূর্ণতা দিয়ে যায় নদীকে। নৌকোতে সবচেয়ে চুপচাপ শান্ত দুটি চোখ মেঘেদের ভেসে যাওয়া, নদীর ঢেউ, পাড়ের কাঁশফুল দেখে চলছে। মাঝে মাঝে চেষ্টা করছে নদীর ¯্রােতস্বীনী চকচকে জলে হাত ভেজাতে; কিন্তু পারছে না। এই মুহূর্তে নৌকো থেকে নীরব ও শান্ত চোখের দশ বছরের যে শিশুটিকে নামানো হলো ওর নাম নাফু। আর সঙ্গে টিপু ও অন্য দুজন নাফুর ভাই ও বোন। কোলে বাচ্চা নিয়ে মুখে আঁচল চেপে যে মহিলা হাঁটছে উনি নাফুর মা। কাঁধে ভার ভর্তি সবজি নিয়ে উশকোখুশখো চুল, ময়লা পাঞ্জাবি, ছেড়ার উপক্রমিত চোটি পায়ে যিনি হাঁটছেন তিনি নাফুর বাবা। নাফুর বাবা একজন সবজি বিক্রেতা। নাফুরা আজ নানীর বাড়ি থেকে ফিরছে। ওই এলাকায় সবজির দাম কম হওয়ায় ভার বোঝায় করে সবজি কিনে এনেছে নাফুর বাবা। শহরে ভালো দাম পাওয়া যাবে! নাফুর বাবা সারাদিন অলিতে গলিতে সবজি বিক্রি করে যে টাকা পায় তা দিয়ে সংসারের জন্য চাল, ডাল, তেল,নূন নিয়ে আসে। তাদের নূন পান্তায় দিন কাঁটে কোন রকমে। কয়েক সপ্তাহ হলো টিপু ফার্ণিচারের দোকানে কাজ করে যে পয়সা পায় তা দিয়ে মাঝে মাঝে মাছ,ডিম নিয়ে আসে। নাফু ডিম খুব পছন্দ করে। হয়তো সে কারণে আজ ওর প্লেটে অবশিষ্ট কোন খাবার নেই! দুপুর বেলা সবজির ভাড় কাঁধে চৌরাস্তার মোড় থেকে সোনালী ব্যাংক পার করে নাফুর বাবা এগিয়ে চলছে। হঠাৎ একটা স্কুলের সামনে গিয়ে থেমে যান! সেখানে তার নাফুর মত কত মেয়ে হাসছে,খেলছে,পড়ছে! তার নাফুকে যদি এরকম স্কুলে ভর্তি করাতে পারতো!! নাফু ওর তিন ভাই বোন থেকে আলাদা। সবাই যে ভাবে বাবা মায়ের কাছে আবদার করে নাফু তার কানি কোনাও আবদার করে না। নাফু চুলার পাড়ের কামরাঙ্গা গাছটা খুব পছন্দ করে। ওর সময় গুলো কামরাঙ্গা তলায় বেশির ভাগ কাঁটে। নাফুর প্রতি ওর পরিবার খুব একটা যতœশীল না হলেও কিছুদিন হলো নাফুর বাবা নাফুকে নিয়ে ভাবছেন। আকাশে আজ চকচকে চাঁদ উঠেছে। আঁখের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো নাফুর মুখে এসে পড়েছে। আস্তে আস্তে চাঁদের আলো নাফুর মুখে এসে পড়েছে। আস্তে আস্তে চাঁদের আলো থেকে নেমে আসা আলোর পাখা যুক্ত পরি নাফুকে ধবধবে সাদা ফ্রক পড়িয়ে দেয়। রুপলি রঙের আলোক উজ্জ্বল ফুলের মধ্যে বসিয়ে পরি গুলো নাফুকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। নাফু পরি গুলোর আড়াল থেকে ওর বাবার সাথে লুকোচুরি খেলে। এক সময় আকাশ মেঘে ভরে যায়, নাফুকে দেখতে পায়না ওর বাবা কিন্তু “বাবা” বলে নাফুর ডাক ঠিকি শুনতে পান। ঘুম ভেঙ্গে নাফুর বাবার বুক ধরফরিয়ে ওঠে। মেঝের অন্য প্রান্তে তাঁকিয়ে দেখেন সত্যিই আখের পাতার ফাঁক দিয়ে নাফুর মুখে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। প্রতিদিনের মত নাফুর বাবা সকালে সকাল সবজির ভাড় নিয়ে বেড়িয়ে যায়। নাফুর মা চুলার ছাঁই ফেলে উঠোন ঝাঁড়– দিচ্ছেন। হঠাৎ ছোট্ট উঠোনের ডগায় একজন ভদ্র মহিলা আর দুজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়ান। নাফুর মা উঠোনের এক কোণে মাদুর পেঁতে দেন তাদের বসার জন্য। নাফুর ভালো থাকার কথা চিন্তা করেই নাফুর মা তাদের কাছে নাফুকে দিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সেদিনের পর থেকে নাফু অনেক ভালো খাবার পাওয়া সত্বেও ঠিকমত খায় না। বার বার জানালার গ্রীল ধরে বাইরে আকাশ দেখবার চেষ্টা করে। নাফুকে খাবার জন্য জোর করা হলে নীরবে দুচোখ উপচে ওঠে। চোখের সামনে তার বাবা মা, ভাই বোনদের মুখ ভেঁসে ওঠে! ভেঁসে ওঠে নদী পাড়ের কাঁশফুল, খোলা আকাশ আর কামরাাঙ্গা গাছটি। নাফুকে অনেক গুলো নতুন জামা এনে দেওয়া সত্বেও কোন জামা ও ছুঁয়ে দেখে না। কেবল তার বাবার কিনে দেওয়া সবুজ রঙের ফ্রকটি ছাড়া। এক দুপুরে জোর করে নাফুর গাঁ থেকে খুলে নেওয়া হয় নোংরা সবুজ ফ্রকটি। নাফুকে বার বার বোঝানো হয় ফ্রকটি ধুয়ে আবার ওকে দেওয়া হবে; কিন্তু নাফু বোঝে না! শহর থেকে যারা নাফুকে নিতে গিয়েছিলেন তারা নাফুদের পরিবারকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। যা দিয়ে নাফুুদের বাড়িতে টিনের প্রশ্বস্ত ঘর তুলেছে। সবজির বাজার চড়া হওয়ায় পয়সাও বেশ আসছে। সবাই ভালো থাকা সত্বেও নাফুর মাকে মুখে আঁচল চেপে মাঝরাতে আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদতে দেখা যায়। তার উচ্চারিত অন্য শব্দগুলো না বোঝাও গেলেও “ও নাফুরে”... কিছুটা স্পষ্ট হয়। প্রতিদিন সবজি বিক্রি শেষে নাফুর বাবা বাড়ি ফিরে চুলার পাড়ের কামরাঙ্গা গাছটির দিকে তাঁকিয়ে শূন্যস্থান দেখে হার জিরজিরে পাজর কেঁপে ওঠে। যাদের কাছে নাফুকে দিয়েছিল তাদের ঠিকানাটা নতুন ঘর তোলার সময় কোথায় রেখেছে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় চলে যায়। ঈদ চলে আসে। এবার সত্যি সত্যি নাফুর কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়া হয় তার বাবার কিনে দেওয়া ছিড়ে যাওয়া সবুজ ফ্রকটি। নাফুকে পড়িয়ে দেওয়া হয় নতুন একটি ফ্রক। নাফু নীরবে সড়িয়ে ফেলা সবুজ ফ্রকের দিকে তাঁকিয়ে চোখের জলে বুক ভাঁসায়। ঈদের আগের দিন নাফুর বাবা শহর থেকে অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন। সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চিনি সেমাই রেখে নতুন জামা তুলে দেয় সবার হাতে।
নাফুর মা ঘুমের ভানে চোখের জলে বালিশ ভেঁজায়। নাফুর বাবার চোখে ঘুম নেই। কামরাঙ্গা গাছটির নিচে নাফু যেখানে বসে থাকতো সেখানকার মাটি নিয়ে হার জিরজিরে বুকের সাথে মালিশ করে আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আজ রাতে মনে হয় আকাশেরও মন খারাপ। তাইতো মেঘ করেছে আকাশের গাঁয়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে ঝড়ো হাওয়া। কাঁথাটা ভালো করে টেনে ঘুমোনোর চেষ্টা করে নাফুর বাবা। হঠাৎ দরজায় প্রচন্ড শব্দ হতে থাকে। বাতাসে হয়তো! কিন্তু না, বজ্রপরার শব্দের সাথে দরজার শব্দটা স্পষ্ট হতে থাকে। তবে কি গ্রামের রসু গুন্ডা শুনতে পেয়েছে গতকাল পাঁচ হাজার টাকার সবজি বিক্রির কথা!! নাফুর বাবা একটা লাঠি হাতে নিয়ে দরজা খুলে আঘাত করার জন্য লাঠি ঝুকলেই কে যেন তাঁর পায়ের উপর পড়ে পা জড়িয়ে ধরে। টর্চ জ্বালিয়ে পা জড়িয়ে ধরা মুখটা দেখে খুশিতে কাঁপতে থাকেন। একটানে নাফুকে বুকে তুলে নেন। নাফুর চোখে মুখে কত চুমু আঁকেন! নাফুর বাবার চিৎকার চেচামিচিতে সবাই জেগে যায়। নাফুর মা “ ও নাফুরে......” বলে বুকে জড়িয়ে নেন নাফুকে। নাফু নির্বাক শুধু চোখের জল ফেলে যায়। মা আর বাবার মাঝখানে শুয়ে আছে নাফু। নাফুর বাবা খুশিতে ঘুমোতে পারছেন না। এনজিও এর লোকজন নাফুর ভালোর জন্যই নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যে ভালো অনেক গুলো হৃদয় পোড়ায় সে ভালো না হওয়ায় ভালো ভাবতে থাকেন নাফুর বাবা। তার মেয়ে পালিয়ে এসে ঠিক কাজ করেছে। এবার নিতে এলে প্রথমে না করবে, না মানলে হাতে বটি তুলবে। নাফুর মাথায় হাত বুলতে বুলতে আরো ভাবেন ঈদ পর প্রতিবন্ধি যে স্কুলটা দেখেছিল শহরে ওখানে নাফুকে ভর্তি করে দেবে। কাল ঈদের নামাজ পড়েই নাফুর জন্য সবুজ রঙের নতুন জামা কিনে আনবে। এক সাথে সেমাই খাবে, ভালো ডাক্তার দেখাবে যাতে নাফু কানে শুনতে পায়, কথা বলতে পারে এবং স্বাভাবিক অনুভূতি ফিরে পায়। “আচ্ছালাতু খায়রুম মিনান নাউম”... ফজরের আযানের ধ্বনিতে সকাল হয়। পূব আকাশে লাল সূর্যটা উঁকি দেয়। পাশের বাড়ির ছেলে মেয়ে গুলো নাফুকে ঈদ মোবারক জানায়। টিপু চুলার পার থেকে মায়ের রান্না করা সেমাই নাফুকে খাইয়ে দেয়, নাফুর মুখ দিয়ে গড়িয়ে পরা লালাও অনেক বার মুছে দেয়। ঈদের নামাজ শেষে নাফুর বাবা সবুজ রঙের ফ্রক কিনে হাসি মুখে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ি ভর্তি লোকজন দেখে হকচকিয়ে যান!!! উঠোনে কাপড়ে ঢেকে রাখা ছোট্ট শরীর দেখে স্থিমিত নাফুর বাবা! নদীতে সবার সাথে গোসল করতে গিয়ে শেষ গোসল দেবে নাফু কে জানতো! নাফু তার বাবার কিনে আনা নতুন জামা না পড়লেও নাফু ঠিকই পড়েছে ধবধবে নতুন জামা। নতুন জামায় মোড়ানো নাফুকে নিয়ে খাঁটিয়া কাঁধে এগিয়ে চলে নাফুর বাবা!!!