গল্প : ঝুলন্ত মানুষ






ঝুলন্ত মানুষ
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

কি হবে বুঝতে পারছেনা রায়হান।
এমন অবিশ্বাস ঘটনাও ঘটতে পারে জীবনে এটা ভাবতে গেলেও যেন ভাবা যায়না।
আর দশটা দিনের মতোই তো সকালটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কেন এমন হলো।
সবার চোখে মুখে আতঙ্ক আর দীর্ঘশ্বাস।
অনেক মানুষের ভিড় করেছে তাদের বাড়িতে। বিড়বিড় করে একে অন্যের সাথে জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে কি যেন বলছে।
সবাই বলছে এটাতো হবার কথা ছিলোনা। কপালটাই বুঝি খারাপ ছিল। না হলে এমন তো হবার কথা নয়।
এখনো দূর দূরান্ত থেকে লোকজন তাদের বাড়িতে ছুঁটে আসছে। কথাটা যেন বাতাসের আগেই ছড়িয়ে গেছে।
শহরের মেয়রের গাড়ি হর্ন বাজাতে বাজাতে তাদের বাড়িতে। তিনিও ‘থ’ বনে গেছেন।
পুলিশের লোকজন এটা ওটা নেড়ে চেড়ে দেখছে। তাদের চোখেও যেন অবিশ্বাস। আশেপাশের বৌ-ঝিরা ঘোমটা আলতোভাবে খুলে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে  কিন্তু তারাও কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছে না।
সময়টাই বুঝি খারাপ। সময় যেন আজ হঠাৎ করে আটকে দিয়েছে জীবন।
ঘুম থেকে উঠেছে  সবাই। কিন্তু যা দেখলো তাতে যেন মন সায় দেয়না।
কাঁদবারও সুযোগ হয়ে উঠেনি কারও। কারণ কেউ তো বুঝতে পারছেনা বিষয়টা আসলে কি আর কারা ঘটালো। কেনইবা  এমন হবে।
সাদা কাপড় ঢাকা কি যেন আর তা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কাপড়গুলো সরিয়ে কেউ দেখার সাহস পাচ্ছেনা।
সাংবাদিকরাও চলে এসেছে। কোনো কোনো টিভি লাইভ দেখাচ্ছে। এখন এটা যেন গোটা রাষ্ট্রের মানুষের ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা দেশের মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে কি ঘটতে যাচ্ছে আর কেনইবা এমনটা হলো ।
সাদা চামড়ার মানুষদের দেখা গেলো। কেউ কেউ বললো ওরা সি এন এন, বি বি সি থেকে এসেছে।
তাহলো রাষ্ট্র ছেড়ে বিষয়টা আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে।
এখন সারা বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি এদিকে।
তিনটা কাফন পরানো লাশ মনে হচ্ছে।
আর একপাশে ছোপ ছোপ কুয়াশার মতো জমে থাকা রক্ত। সবাই বোঝার চেষ্টা করছে এদের মেরে ফেলে কাফন পরানো হয়েছে নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু। এরাই বা কারা। থমথমে গুমোট একটা ভাব।
রায়হান এবার এক' পা দু' পা করে সামনে আগায়। বাবা মার দিকে তাকায়। খুব দুশ্চিন্তাগস্থ মনে হলে তাদের। যেন উটকো ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়েছেন তারা।
রায়হান বাঁশ ঝাড়ের নিচে কাফনে ঢাকা লাশটার দিকে এগুতে থাকে। সবার চোখ তখন রায়হান দিকে।
পুলিশের বাঁশি বাজায়।
রায়হান তবুও নির্বিকার। সে সাদা কাফনের লাশটার কাছে বসে পড়ে।
এবার কাফনের কাপড়টা খুলতেই মানুষের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। অনেকে ভয়ে কেঁদে ফেলে ।
মনে হলো মুখোশ পড়া একটা লাশ ।
সবাই ভাবছে মুখোশের ভিতর লাশটা কার ?
টিভি ক্যামেরার অসহনীয় আলো আর কিল্ক কিল্ক করে ছবির ক্যামেরাগুলো যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুখোশের উপর ।
মুখোশটা টেনে খুলতেই যা বেরিয়ে এলো তা নিয়ে কেউ আগের মুহূর্তেও কেউ ভাবতে পারেনি ।
কেউ কেউ ভয়ে চিৎকার করলো । কেউ কেউ আবার জ্ঞান হারালো ।
পুলিশ ভিড়কে সামাল দিতে মৃদু লাঠিচার্জ করলো ।
সবার চোখ দেখছে সেই মুখোশের নিচের অজ্ঞাত কোনো বস্তু ।
কি হতে পারে সেটা মানুষ না অন্য কিছু। জীব না জড় । জীবন না মৃত্যু। কল্পনা না বাস্তব ।
রায়হানের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা রংহীন পানি। রংহীন কিন্তু তা দেখে বোঝা কঠিন আনন্দ না বেদনার রং সেই চোখের পানিতে।
ভিতরে একটা ক্ষত বিক্ষত কুকুরের লাশ দেখলো সবাই। খুব যতœ করে রায়হানের দাদি এই কুকুরটাকে মানুষ করেছিল। কুকুর আবার মানুষ। মানুষ এজন্য যে সে প্রভুর প্রতি অনুগত ছিল। ওটা কুকুর ছিলোনা ছিল বিশ্বাস। যে অকৃতজ্ঞ নয়। কারণ কুকুর হলেও তার প্রতি বিশ্বাস রাখা যায় আর প্রভুর প্রতি তার ভালোবাসা সে প্রমান করতে পারে।
পাশের কাফনটার দিকে এগুলো রায়হান। কাফনটা আলতো করে তুলতেই সেখানে দেখা মিললো একটা মরে যাওয়া শুকনো গাছ। যার পাতাগুলো অযতেœ বিবর্ণ হয়ে গেছে। একটু পানি পেলে গাছটা বড় হতে পারতো। কিন্তু সেটা সে পারেনি কারণ খুব অযতœ  তার উপর হয়েছে। এটা অত্যাচার। আর যাদের বিবেক থাকেনা তাদের মধ্যেই এটা জন্ম নেই। ওটা মোর গাছ ছিলোনা ওটা ছিল মানুষের নির্মমতার রূপ। একটা গাছ যখন ফল দেয়, মানুষ তখন গাছের বুক চিরে ফল গুলো টেনে টেনে ছিড়ে আনে। খুব কষ্ট হয় গাছের কিন্তু মেনে নেই। কারণ তাদের বোবা কান্নায় লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবন। মানুষ বেঁচে থাকে রসালো ফল খেয়ে। মানুষের আনন্দ আর গাছের বেদনা। কারণ ওরা যে উদ্ভিদ, মানুষের মতো প্রাণী না ।


নিম গাছের নিচে, দক্ষিণ দিকের চৌবাচ্চাটার পাশে পুরোনো একটা বারান্দায় রাখা কাফন ঢাকা অজানা বস্তুর দিকে রায়হান এগিয়ে যায়। চোখ কান্নায় তার লাল, বিবর্ণ মুখ আর নির্বাক চোখ। সব যেন জীবন আর সত্যের মাঝামাঝি একটা শুন্য স্থান। পেন্ডুলামের  মতো ঝুলে থাকা মন, স্থবিরতা আর জড়তা। এবার কাপড়টা তুলবে সে ।
কি আছে ওখানে সবাই ভাবে। ভাবে আর ভাবে। ভাবনাগুলো যেন পাখি হয়ে যায়। উড়ে চলে সবার মন শুধু চোখ দুটো পাথরের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
আস্তে আস্তে পরম মায়া নিয়ে রায়হানের সিক্ত হাত কাপড়টা সরাতে থাকে।
কি যেন উড়ে যাচ্ছে।
সবার চোখ মাটি থেকে উপরের দিকে। শুন্য বাতাস থেকে অসীম শুন্য আকাশের দিকে বাড়তে থাকে চোখ।
কি ছিল তাতে যা উড়ে যায়? জীবন পাখি যে দেহ ছেড়ে চলে যায়। আত্মা না জীবনের আতশবাজি।
না, সাদা কাপড়ে ঢাকা গ্যাস বেলুনগুলো কাপড়ের ভারের বন্ধন মুক্ত হয়ে উড়ে চলেছে অজানা গন্তব্য।
যেন মানুষের দেওয়া  কষ্টে নিজের আত্মাকে মুক্ত করেছে বেলুনগুলো। এই বেলুনগুলো ঘিরে মানুষ আনন্দ করে। মানুষের মনকে পুলকিত করে বেলুন। দোল খায় মন। কিন্তু নির্মম মানুষ একসময় বিদায় করে দেয় বেলুনগুলো। যতক্ষণ ফুলে থাকার দম থাকে ততক্ষন তার দাম থাকে আর যখন  সময়ের সাথে চুপসে যায়, মানুষ স্বার্থপর হয়ে যায়। তখন আনন্দ  দেওয়া বেলুনগুলো হয়ে যায় ডাস্টবিনের আবর্জনা। আবার যতক্ষণ আকাশে উড়ে চলা দেখা যায় ততক্ষন মানুষের চোখ আর মন বেলুনের দিকে থাকে । আর যখন দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায় তখন মন আর চোখ থেমে যায়। কেউ খবর রাখেনা বেলুনগুলো মিলিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো। এইতো মানুষ। এটা কি মানুষের নির্মমতা নাকি এটাই বাস্তবতা। কে জানে আর কেবা এর উত্তর খুঁজবে।

একটা এম্বুলেন্সের শব্দ আসে সবার কানে । আবার গোলক ধাঁধায় পড়ে যায় মানুষ ।
অনেকে বিড় বিড় করে বলতে থাকে এম্বুলেন্স কেন? প্রতীক্ষার চোখ বড় হয়, দীর্ঘ  হয়  অপেক্ষার  সময়।
সবাই এম্বুলেন্সের দিকে হা-করে তাকিয়ে। কি হবে আর কি হবেনা কেউ জানেনা ।
এরপর আসে সময়। সময়ের পর সময়।
দুজন লোক এম্বুলেন্স থেকে নামে সাদা কাফনে ঢাকা একটি শবদেহ নামিয়ে আনে শত বছরের বট গাছটার নিচে । শবদেহ না অন্য কিছু কে জানে।

রায়হান আবেগ ধরে রাখতে পারেনা । আবেগ হার মানে কান্নার কাছে । বাস্তবতার আঘাত হানে কল্পনায় ।
সব কিছু যেন এলোমেলো ।

হাত কাঁপতে থাকে রায়হানের। চোখ ভাসতে থাকে পানিতে। মনে উঠে অদৃশ্যমান ঝড়। কাপড়টা তুলতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে রায়হান আর চার পাশের সবাই নিস্তব্ধ। কি যেন একটা কষ্টের জিনিস ছিল ঐ কাপড়ে ঢাকা। এখন বেরিয়ে এসেছে।

চামড়ায় ভাঁজ পড়া একজন বৃদ্ধা। খুব মায়া হবে মুখটা দেখলে, মোচড় দিয়ে উঠবে বুকটা ।

চোখগুলো তখনও  খোলা। শুধু প্রাণটা নেই। মনে হলো অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে চোখগুলো তাকিয়ে আছে কাউকে দেখবে বলে। হয়তো প্রাণের আপনজন। কে জানে কে  বলবে। এটা শুধু কল্পনা করা যায়,  যেখানে বাস্তবতা নির্বাসিত।
এবার রায়হান বাবা মাকে ডাকে। বাবা চেয়ে দেখে মৃত বৃদ্ধার মুখের দিকে। নাড়ির টানে যে চাপ পড়ে। চোখ ফুটে পানি বের হতে পারেনা। এ যেন বুকফাটা যন্ত্রনা। কাউকে দেখানো যায়না আর বুঝানো যায়না। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ আর বোবা বিলাপ।

রায়হান বাবা মাকে চেচিয়ে  বলে ‘তোমরা কি চিনতে পারছো ওকে ’।
বাবা তোমার মমতাময়ী মা। যার ঋণ কেউ কখনো শোধ করতে পারেনি, পারবেনা ।
কাল তোমরা তাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এলে। কিন্তু তার চোখ তোমাকে দেখবে বলে এখনো খোলা। খোলা জানালার মতো।
তোমাকে হারানোর শোকে উনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। তুমি তো তার কষ্টটা বুঝতে পারোনি। তোমার থেকে ঐ মৃত কুকুরটা অনেক বিবেকবান। দাদি তার উচ্ছিষ্টগুলো খেতে দিতে ওকে। দাদিকে যখন দামি গাড়িতে উঠিয়ে ঐ বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তার চোখ ছিল বিস্মিত আর কান্না ছিল নিরুপায়।

সেও ছুটেছে গাড়ির পিছনে। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটেছে। ক্লান্ত হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের ফটকে বসে পড়েছে। কারণ তার জন্য তো বৃদ্ধাশ্রমের ফটক বন্ধ। তোমরা চলে আসার পর সে দাদির জন্য চিৎকার করেছে। আছাড়ি বিছাড়ি খেয়ে ফটকের নির্দয় স্টিলের ফ্রেমে। আর পাহারাদাররা বিরক্ত হয়ে তাকে নির্দয়ভাবে মেরেছে। রক্ত ঝরে তার দেহে, রক্ত ক্ষরণ হয়েছে তার অন্তরে। তবুও সে দাদির কাছে যেতে চেয়েছে। যখন পারেনি তখন মৃতপ্রায় হয়ে ফিরে এসেছে দাদির দুপুরে বসা থাকা উঠোনে। তার পর রক্ত আর জলে ভেসে থেমে গেছে তার জীবন। তাকেই দেখিয়েছি প্রথমে। কারণ তার মায়া মমতা আর কৃতজ্ঞতা মানুষের চাইতে বেশি ছিল যা তোমাদের মধ্যে নেই।

একটা শুকনো বিবর্ণ গাছ এরপর দেখিয়েছি। গাছটা বিবর্ণ আর মানুষ তাকে বরণ না করলেও মাটি তাকে মায়ার বন্ধনে বরণ করে নেয়। অনেকগুলো রংবেরং এর বেলুন যখন মানুষের চোখের সামনে উড়তে থাকে মানুষ তখন আনন্দিত হয়। কিন্তু চোখের বাইরে চলে গেলে কেউ তার খবর রাখে না। এরপর রায়হান সবার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে হয়তো আমরা মানুষ নই। মনও নেই। সময় বদলায় কিন্তু মন বদলায় না। তারপর সময় চলতে থাকে তার নিজস্ব গতিতে। যার কোন সীমা নেই, ঠিকানা নেই। আর একরাশ ঝুলন্ত মানুষের অনুভূতিহীন জীবাশ্ম পড়ে থাকে মাটিতে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট