অপরাহ্নের গল্প
অরূপ রতন
সকাল ন‘টার মধ্যে ডাক্তারের আসার কথা। সৌমেন অবশ্য সাড়ে আটটাতেই হাজির হয়েছে। পাঁচ টাকায় টিকিট নিয়ে দরজায় সিরিয়াল নিতে এগিয়ে এসে সেতো একেবারে হতভম্ব। মাত্র কয়েকজন মানুষ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। সৌমেন হাত ঘড়ি দেখল। সবে আটটা বেজে চল্লিশ। তার অবশ্য আজকেই সদর হাসপাতালে প্রথম আসা নয়। তবে টিকেট কেঁটে ডাক্তারের সাক্ষাত প্রার্থী হয়ে আসা আজই প্রথম। সে লক্ষ করল একটা ফর্সামতো ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই ছেলেটি বলল, ‘ডাক্তার বোস কী এখানে বসেন?’
‘জ্বী।’
‘আমি চন্দ্রনাথ। বন্দর থেকে আসছি। বাবাকে একটু দেখাব।’
‘আমি সৌমেন। সৌমেন চ্যাটর্জী। আমার নিজেরই একটু সমস্যা হয়েছে। আপনি কী টিকিট নিয়েছেন?’
‘ও হ্যাঁ, টিকিট নিতে হবে। আপনি দয়াকরে আমার সিরিয়ালটি ধরে রাখবেন? আমি এখনি টিকিট নিয়ে আসছি।’
সৌমেন নিশ্চয়তা দিলে চন্দ্রনাথ টিকেট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। সৌমেন এবার আবিস্কার করল হাসপাতালের এই চত্বরে মুহুর্তেই অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে। কিন্তু কখন এতো মানুষ ঢুকল সে ঠিক ঠাওর করতে পারেনি। সে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে গেল যখন দেখল তার পেছনে প্রায় কুড়ি পঁচিশেক লোক দাঁড়িয়ে গেছে। বেচারী চন্দ্রনাথের কথা তার মনেই ছিল না। এখন মনে হওয়ায় খানিকটা লজ্জিত হল সে। সৌমেন দরজা ভেদ করে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল চেম্বারে ডাক্তার বসেছেন কি না। না, ডাক্তার এখনো আসে নি। তবে মূহুর্তে চারপাশ জুড়ে অনেক মানুষের জটলা বেঁধে গেল। ভেতর থেকে দারোয়ান গোছের একজন চিৎকার করে বলল,‘দরজা থেক্যা একটু সর্যা যান। একটুক সোজা হয়্যা দাঁড়ান। ডাক্তার সাব এখনি চল্যা আসবেন।’ সৌমেন ঘাড় উঁচু করে দরজায় উঁকি দিল। না, এখনো ডাক্তার আসে নাই। লোকটি অনর্থক চেঁচিয়ে একটা জটলা বাঁধিয়ে দিল। সরকারি ডাক্তারের মর্জি। কখন আসবে তার কে জানে। সৌমেন মনে মনে বিরক্ত হল। অবশ্য আমাদের দেশে সবকিছুর মধ্যেই যখন অনিয়ম চলছে তখন ডাক্তারের দেরি করে চেম্বারে প্রবেশ করার মধ্যে কোনো অন্যায় দেখছে না সৌমেন। চন্দ্রনাথ টিকিট কাউন্টার থেকে ফিরেছে। পেছনের দিক থেকে সৌমেনকে হাত ইশারা করে জানিয়ে দিল লাইনে দাঁড়িয়েছে সে। সৌমেন আশ্বস্থ হল। যদিও সে মনে মনে লজ্জিত। পেছনের দিক থেকে কেউ একজন বলল,‘ডাক্তার চেম্বারে ঢুকছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে সবাই নিশ্চুপ। সৌমেন সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ কোথা থেকে এক বৃদ্ধ তার হাত জাপটে ধরে বলল,‘বাবা আমাকে বাঁচান।’ সৌমেন চমকে লোকটির দিকে তাকাল। তারপর লোকটির চোখে চোখ রেখে বলল,‘কে আপনি? কাকে চান?’
লোকটি এবারও একি ভঙ্গীতে বলল,‘আমাকে বাঁচান! আমাকে বাঁচান!’
‘কী হয়েছে আপনার? কেন এমন করছেন?’ সৌমেন হতভম্ব।
লোকটি চোখ তুলে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে বুঝল গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। বুক চাপড়ে আকুতি করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। সৌমেন হতভম্ব। কে এই লোক? হাসপাতালের এই বহুল গণ সমাবেশের মধ্যে লোকটি কেনই বা তার কাছে ছুটে এলো? সে জানে না। ডাক্তার বোস চেয়ারে বসতে গিয়ে লক্ষ করলেন
দরজার বাইরে বেশ হট্টগোল হচ্ছে। তিনি এ্যাসিসট্যান্টকে ডেকে দরজা বন্ধ করে দিতে বললেন। এই দেখে পাশ থেকে একজন বললেন, ‘প্রায় দু’সপ্তাহ ঘুরে ঘুরে ডাক্তার বোসের সিরিয়াল পেয়েছি। লোকটি সব শেষ করেদিল।’ সৌমেন প্রায় ধমকের সুরে বলল, ‘কী দেখছেন কী? একটু ধরুণ না। লোকটি যে একেবারে মূর্ছা গেছে।’ ভীড় ভেঙে চন্দ্রনাথ এগিয়ে এসে বলল,‘কী হয়েছে দাদা? উনি কে?’ সৌমেন কোনো জবাব না দিয়ে বলল,‘একটু ধরুণ প্লিজ।, চন্দ্রনাথ বৃদ্ধের কাঁধে হাত দিয়ে একটু ঝাঁকুনি দিল। তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় সৌমেন আর দেরি না করে দাঁড়িয়ে নার্সকে ডাকা মাত্রই একজন অল্প বয়স্ক নার্স স্ট্রেচার নিয়ে সৌমেনের সামনে হাজির হলো।
চন্দ্রনাথ পাশেই ছিল। সৌমেন তার দিকে লক্ষ করে বলল,‘আপনি অযথা আমার সাথে সময় নষ্ট করলেন।’
‘অযথা বলছেন কেন? লোকটি যেভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।’
‘ভয় পেয়েছেন?’ সৌমেন হাসল।
‘ভয় পাব কেন? আমি অত সহজে ভয় পাওয়ার পাত্র নই।’
‘সে আমি বুঝেছি।’
‘আচ্ছা, লোকটি কে বলুনতো? একেবারে যে আপনার উপরই এসে পড়লো। কোনো আতœীয়-স্বজন?’ সৌমেন জানতে চায়লো।
‘না, না উনি আমার কেউ নন। তবে যেভাবে মূর্ছা গেল সত্যি আমি একেবারে হতভম্ব।’
ভেতর থেকে ডাক্তার বোস বেরিয়ে আসতেই তারা দু‘জনই দাঁড়াল। চন্দ্রনাথ সৌমেনকে লক্ষ করে বলল,‘আজকে বোধ হয় ডাক্তার বোস টিকিট এর লোকগুলোকে দেখবেন না।’
সৌমেন বিড় বিড় করে বলল,‘দেখবেন কী করে, যে হাঙ্গামাটা শুরু হলো। তিনি আবার হৈ চৈ একদম পছন্দ করেন না।’
ডাক্তার বোস কাছে আসতেই সৌমেন নমস্কার জানিয়ে বলল,‘পেশেন্টের অবস্থা এখন কেমন?’
‘কার কথা বলছেন?’ ডাক্তার বোস সৌমেনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘ঐ যে উনি, আপনার চেম্বারের সামনে মূর্ছা গেলেন।’ সৌমেন মনে করিয়ে দিল।
‘ও আচ্ছা, ঐ বৃদ্ধের কথা বলছেন? যিনি লাইনে দাঁড়িয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন?’
‘জ্বি, জ্বি উনার কথায় বলছি। উনি কেমন আছেন এখন?’
‘তেমন তো ভালো বুঝলাম না। উনি কে আপনার, বাবা?’
‘সৌমেন চমকে উঠলো। তারপর ডাক্তার বোসের চোখে চোখ রেখে বলল,‘না, উনি আমার কেউ নন।’
তাহলে উনার আতœীয় স্বজন বা ছেলে সন্তানদের একটু খবর দিন। বৃদ্ধের অবস্থা ভালো বুঝলাম না।’
সৌমেনের ভেতরটায় হু হু করে উঠলো। সে কোনো রকমে নিজেকে সামলিয়ে বলল,‘উনি লাইনে ছিলেন না। আমরাই বেশ কয়েকজন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। উনি হঠাৎ কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে আমার উপর পড়লেন। আমি উনাকে চিনি না। কোনোদিন দেখেছি বলেও মনে হয় না।’
‘বাহ, বেশ ইন্টারেস্টিং তো ব্যাপারটা।’ ডাক্তার বোস বললেন।
‘আপনি এটিকে ইন্টারেস্টিং বলছেন?’
‘বলছি মশাই। প্রতিদিন এই হাসপাতালে আমাদের যে কত নতুন নতুন ঘটনার সামনে পড়তে হয় তা বলে শেষ করার মতো নয়। তাই এ সব ঘটনাগুলোকে আমাদের কাছে ইন্টারেস্টিং ই লাগে।’ ডাক্তার বোস ব্যাখ্যা করলেন।
চন্দ্রনাথ এতোক্ষণ কোনো কথা বলেনি। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তার বোসকে উদ্দেশ্য করে সে বলল, ‘তাহলে এখন কী উপায়? আমরা কী করতে পারি?’
‘সেটাই একটু ভাবুন। আর আমরাও দেখছি কী করা যায়। আপনারা থাকুন। আমি আসছি।’
কথাগুলো শেষ করেই ডাক্তার বোস ডক্টরস্ চেম্বারের ভেতর ঢুকে গেলেন। চন্দ্রনাথ সৌমেনের দিকে তাকিয়ে বলল,‘কী করবেন এখন?’
‘আপনি কী চলে যেতে চাচ্ছেন?’ সৌমেন সরাসরি জিজ্ঞেস করলো।
চন্দ্রনাথ ইতস্তত করে বলল,‘না, আসলে আমার কিছু কাজ ছিল। অবশ্য আরো কিছুক্ষণ হাসপাতালে আছি।’
সৌমেন আর কিছু বলল না। তার নিজেরও কিছু কাজ আছে। সেগুলো সেরে ফেলা উচিত। কিন্তু এখন এ অবস্থায় সে কীভাবে জলে গা ভাসিয়ে দেবে। তাছাড়া লোকটিকে সে-ই নিজের উদ্যোগে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। এখন সে-ই যদি দায়িত্বের অবহেলা করে তবে সেটা হবে তার জন্য চরম অপমানের। সৌমেন এরকম অপমান হজম করতে পারবে না। চন্দ্রনাথ কোনো উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল,‘কিছু বলছেন না যে?’
সৌমেন আশ্বাস দেবার মতো করে বলল,‘ঠিক আছে, আপনি যান। আমি সামলে নেব।’
দুপুর দুটো দশে বৃদ্ধের জ্ঞান ফেরে। সৌমেন পাশেই বসেছিল। তার আর কোথাও যাওয়া হয়নি। একজন অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে স্বার্থপরের মতো চলে যাওয়া তার ধাতে নেই। সে প্রচ- আতœ পীড়ায় ভোগে। আর এ কারণেই সৌমেনদের মতো মানুষদের পিছুটান বেশি। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বেশি। মনের সাথে শরীরের যুদ্ধে কেবল মাত্র মনের আবেগেরই জয় হয়। বৃদ্ধ ঘুমাচ্ছে। নিঃসাড় শরীর নিয়ে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে যা বুঝা গেল তাতে বৃদ্ধ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। তার পোশাকে একটা রুচিবোধের আঁচর লেগে আছে। একটা ভদ্রস্থভাব লেগে আছে বৃদ্ধের চোখেমুখে। সৌমেন অবশ্য মনে মনে তৃপ্ত। সে সবকিছু জয় করে বৃদ্ধের জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পেরেছে এটাই বড় কথা। বিধাতা প্রত্যেক মানুষের চেহারায় একটা অপূর্ব জ্যোতি দান করেছেন। একটা অপূর্ব মহিমা খেলা করে সবার চোখে মুখে। কেবল সে ঘুমিয়ে থাকলেই সেই অপূর্ব জ্যোর্তিময় চন্দ্রবদনটি স্পষ্ট হয়। সৌমেন বৃদ্ধের পাশে বসে সেই অপূর্ব চন্দ্রবদনটি দেখছে। পেছন থেকে কেউ একজন বলল,‘এখনো ঘুমাচ্ছে?’ সৌমেন খানিকটা ঘোরের মধ্যে ছিল। হঠাৎ কারো কথায় সজাগ হলো। ট্রে হাতে পেছনে নার্সকে দেখে সে বলল,‘জ্বি, ঘুমাচ্ছেন।’
‘ঘুমাতে দিন। ডাক্তার বোস উনাকে জাগাতে নিষেধ করেছেন। বেচারী বোধ হয় অনেকদিন ঘুমাননি।’
‘আমি বসে বসে উনার ঘুমানো দেখছি। মনে হচ্ছে একজন মানুষ পৃথিবীর সকল জঞ্জাল দূরে সরিয়ে রেখে বেশ আয়োজন করে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।’
‘বাহ্, বেশ বলেছেন তো, তৃপ্তির নিঃশ্বাস।’ নার্স বলল।
‘উনার কী হয়েছে বলুনতো। ডাক্তার বোস তো কিছু বললেন না।’
‘সত্যি বলতে আমিও কিছু জানি না। আমি এসেছি রোগীর পালস্ নিতে।’
নার্স এক হাতে বৃদ্ধের কব্জি ধরে একটু চাপ দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো। কিছু একটা নোট লিখে সৌমেনের দিকে তাকিয়ে বলল,‘ঠিক আছে। আমার কাজ শেষ। আমি আসছি।’ নার্স বিদায় নিল। সৌমেন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলো। কিন্তু নার্স আর কিছু বলল না দেখে হতাশ হলো সে। লোকটার এখন কী ক-িশন? কোথা থেকে এসেছে? আতœীয় স্বজন কারা? সৌমেন কিছুই জানে না। ঘাড় ঘুরিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাতেই সৌমেন একটি দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল। সে তার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। বৃদ্ধ বেডের উপর পেছনে একটা বালিশ রেখে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। সৌমেন বিস্ময় লুকাতে পারলো না। দৃষ্টি সরু করে বলল,‘এখন কেমন আছেন?’
বৃদ্ধ কোনো জবাব দিতে পারলো না। তার গলা শুকিয়ে আছে। সৌমেন আবার বলল,‘আপনি কী আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
‘তুমি কে? তোমাকে তো আমি চিনলাম না।’ বৃদ্ধ জবাব দিল।
‘আমাকে চিনছেন না!’ সৌমেন বোকা বনে গেল।
‘সত্যিই আমি তোমাকে চিনতে পারছি না। আচ্ছা বল তো, আমি এখানে কেন?’
বৃদ্ধের কথায় সৌমেন থমকে গেল। তবে ভড়কে গেল না। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলো। তারপর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল,‘আমি ডাক্তার বোসের সিরিয়াল নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর আপনি হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসে আমার উপর একেবারে মূর্ছা খেয়ে পড়লেন।’
‘আমি ঠিক বলতে পারবো না কী হয়েছিল। এখানে আর কেউ নেই? ’ বৃদ্ধ এদিক ওদিক তাকালো।
‘না, আর কেউ তো নেই। আপনি কাউকে খুঁজছেন?’
‘সুধারামকে খুঁজছিলাম। ও বোধ হয় আমাকে খুঁজে পায়নি।’
‘সুধারাম কে? আচ্ছা আপনি ঠিকানা দিন। আমি খুঁজে আনার ব্যবস্থা করছি।’
‘সুধারাম আমার কেউ নয়। কিন্তু ঐ ই তো আমার দেখভাল করে।’
‘আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি তো বেশ অসুস্থ।’
‘আমি অসুস্থ হব কেন? আমিতো দিব্যি ভালো আছি। তবে সুধারাম বলে, আমার পাগল হতে নাকি আর দেরী নেই। আমি জানি ও ঠাট্টা করে এসব বলে।’
‘আপনার বাড়ির ঠিকানাটা দিন। আমি যোগাযোগ করছি। নিশ্চয় এতোক্ষণে আপনার বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে পড়েছেন।’
বৃদ্ধ সৌমেনের দিকে এক নজর তাকালো। কী যেন বলতে গিয়ে থেকে গেল। সৌমেনও তাকিয়ে ছিল বৃদ্ধের দিকে। কিন্তু বৃদ্ধের মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। সৌমেন এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, আপনার নাম কী? কী করেন আপনি? আপনার বাসা কোথায়?’
‘আমি হৃষিকেষ চক্রবর্ত্তী। তেমন উচ্চ পদস্থ কেউ নই যে নাম শুনেই আমাকে শনাক্ত করতে পারবে। এক সময় আমার ট্রান্সপোর্টের ব্যবসায় ছিল।’
‘এক সময় ছিল, আর এখন?’
‘এখন কিছু নেই। বেকার বুড়ো মানুষ।’
‘আপনার পরিবার, সন্তান সন্তুতি উনারা কোথায়? আর সুধারাম বলে যাকে খুঁজছেন সেই বা কোথায়? দ্বিধা করবেন না। আপনি ঠিকানাটা দিন। আমি উনাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি। ভুলে যাবেন না, আপনি কিন্তু বেশ অসুস্থ। ডাক্তার বোস আপনাকে দেখছেন।’
‘কী বলছো! আমি সুস্থ। পুরোপুরি সুস্থ। তবে মাঝে মাঝে আমার কী যেন হয়। সুধারাম যদিও বিষয়গুলো দেখে। তাই এতোদিন টের পাইনি। তবে আজ যথেষ্ঠ অনুভব করছি।’
‘তাহলে তো বুঝতেই পারছেন, এবার ঠিকানাটা বলুন।’
‘আমি ভবাণী গঞ্জের মোড়ে থাকি।’ বৃদ্ধ বলল।
‘ভবাণী গঞ্জ?’ সৌমেন একটু ভাবলো। কিন্তু তার ভাবনায় স্পষ্ট কিছু বের হলো না।
‘আপনার স্ত্রী, পুত্র,কন্যা উনারা কোথায়?’
‘স্ত্রী মারা গেছে প্রায় দশ বছর হলো। আর.......।’ বৃদ্ধ থেমে গেলেন।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সৌমেন বলল, ‘বলুন, আপনার ছেলে মেয়েরা কোথায়?’
‘আমার কেউ নেই। আমি একা।’ কথাটি বলতেই বৃদ্ধের চোখে পানি চলে এলো। তৎক্ষণাৎ তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে নিলেন।
‘তাহলে সুধারাম কে? আপনি তো সুধারামের খোঁজ করছিলেন।’
‘আগেই বলেছি, সুধারাম আমার রক্তের কেউ নয়। তবে এখন ঐ ই আমার অন্ধের যষ্ঠি।’
‘আপনার কথা না আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ সৌমেন হতাশ।
‘পৃথিবীর সহজ কথাগুলোই মানুষ সহজে বুঝতে পারে না।’
‘সৌমেন বৃদ্ধের দিকে তাকালো। কী এক আশ্চর্য অনুভূতি তার হৃদয়কে আন্দোলিত করে ফেলল। সে বৃদ্ধের চোখে চোখ রেখে বলল,‘বাহ্! সুন্দর বলেছেন তো। কিন্তু আপনার কথাগুলো কেমন যেন হেয়ালি মনে হচ্ছে। কোথায় যেন একটা উদাসীনতা।’
‘আমিতো এভাবেই কথা বলি। তাছাড়া....’
‘তাছাড়া .....’ সৌমেন সজাগ হলো।
‘দেখলে বুড়ো মানুষের কা-। তোমার সাথে সেই কখন থেকে বক বক করছি অথচ তোমার নামটাই জানা হয়নি। অবশ্য সব মানুষকেই পরিচয় দিতে হয় না। মানুষের ব্যবহারই তার পরিচয়। তুমি নিতান্তই ভদ্রলোক।’ বৃদ্ধ প্রসঙ্গ পাল্টাল।
‘লজ্জা দিবেন না। আমি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। আমার নাম সৌমেন চ্যাটার্জী। যদিও পরিচয়টা আমার আগেই দেয়া উচিৎ ছিল।’
দরজায় শব্দ হতেই সৌমেন পেছনে তাকাল। ডাক্তার বোস আসছেন। সৌমেন দাঁড়িয়ে ডাক্তারকে বসতে দিল। ডাক্তার বললেন,‘আমি বসব না। পেশেন্টকে আর একটিবার দেখতে এলাম।’ ডাক্তার বোস বৃদ্ধের প্রেশার মাপলেন। হার্ডবিট নিলেন। তারপর জিহ্বা দেখে বললেন,‘বাহ্, আপনি তো এখন সুস্থ।’ যেমনটি দেখেছিলাম তেমনটি আর নেই।’
‘আমি বললাম না, এখন আমি সুস্থ।’ সৌমেনের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বলল।
‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার মনের জোর অনেক।’ ডাক্তার বোস বললেন।
‘এ বয়সে ওটুকুই আমার সম্বল ডাক্তারবাবু। অবশ্য এখন আর আগের মতো বল পাই না। বয়স আমাকে হার মানতে বাধ্য করছে।’
‘এটা প্রাকৃতিক বিষয়। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে ভেঙ্গে পড়বেন না। নিয়মিত ঔষধ খান। আশা করি সব জয় করে আগের উদ্যোম ফিরে পাবেন। যেহেতু ভয়ের কিছু নেই, তাই সন্ধ্যা নাগাদ আপনাকে রিলিজ করে দিতে চাচ্ছি।’
বৃদ্ধ সৌমেনের দিকে তাকাল। সৌমেন ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল,‘সত্যি বলছেন, উনি এখন সুস্থ!’
‘জ্বি, উনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।’
‘ধন্যবাদ ডাক্তার বাবু।’ সৌমেন ডাক্তার বোসের দিকে তাকাল।
‘ইটস্ ওকে। আমি উনার রিলিজের ব্যবস্থা করছি।’ ডাক্তার বোস দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
সৌমেন দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তার বোস চলে যাওয়ার পর আবার নিজের আসনে গিয়ে বসল। বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,‘শুনলেন তো, ডাক্তার বোস বলে গেলেন আপনি এখন সুস্থ।’
‘এটাতো আমি আগেই বলেছি। তুমি অযথাই টেনশন করছিলে।’
‘আসলে প্রথম অবস্থায় আপনি যেভাবে মূর্ছা গেলেন তাতে আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম। এখন অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছি। ভালোই ভালোই সব মিটে গেলেই হলো।’
‘তোমাকে যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি।’ বৃদ্ধ বলল।
‘অবাক হওয়ার কী আছে? আপনি অযথাই অনেক কিছু ভাবছেন।’
‘ভাবনার অনেক কিছু আছে। তুমি আমার জন্য যা করলে তা কতজন করে। তাছাড়া আজকালকার দিনে কে কার পেছনে সময় নষ্ট করতে চায়। তুমি সারাটা দিন আমাকে নিয়ে হাসপাতালে বসে রইলে।’
‘আমার কোনো কষ্ট হয়নি। তাছাড়া আমার কোনো রাজ কার্যও ছিল না। আপনি এ সব নিয়ে ভাববেন না। আর আমাকে দয়া করে মহান কোনো কিছুর সাথে তুলনাও করবেন না। কারণ পৃথিবীতে মহান হওয়া অনেক কঠিন কাজ। যে কেউ মহান হতে পারে না।’
‘তা না হয় ভাবলাম না। কিন্তু তুমি নিজেও চিকিৎসা নিতে এসেছিলে। আমার জন্য সেটাও তোমার হলো না।’
‘ও টা কোনো বিষয় না। আজ হয়নি, আগামীকাল না হয় আবার আসবো। এবার সুধারামের ঠিকানা দিনতো। ডাক্তার বোস কী বলে গেলেন। সন্ধ্যার আগেই আপনাকে রিলিজ করে দেবে। ঠিকানাটা দিন, আমি সুধারামকে আনানোর ব্যবস্থা করছি।’
‘সুধারাম আমাকে এমনিতেই খুঁজে বের করে ফেলবে।’ বৃদ্ধ বলল।
‘মানে!’ সৌমেন পরিস্কারভাবে জানতে চায়লো।
‘মানে কিছু না। আসলে মাঝে মাঝে আমার কী যেন হয়। সব গুলিয়ে ফেলি।’
‘আপনি কিছু লুকোচ্ছেন মনে হচ্ছে।’
‘লুকোনোর কিছু নেই। আর তোমার কাছে কী বা লুকোবো।’
হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই সৌমেন পেছনে তাকালো। বাইরে নার্সের সাথে দু’তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। নার্স লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,‘ভেতরে আপনাদের পেশেন্ট।’ একজন দরজা ভেদ করে দৌড়ে বৃদ্ধের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,‘কর্তাবাবু, আপনার কী হয়েছিল? আপনি হাসপাতালে কী করে এলেন?’
সৌমেন লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,‘উত্তেজিত হবেন না। উনি এখন ভালো আছেন। আপনারা কারা?’ সৌমেন প্রশ্নটি করে বৃদ্ধের দিকে তাকাল।
বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল,‘ঐ ই সুধারাম।’
‘আপনি এসেছেন, খুব ভালো হয়েছে। উনি আপনার কথাই বাব বার বলছিলেন।’ সৌমেন সুধারামকে বলল।
‘বাবা এখন কেমন আছে?’ পাশ থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল।
‘আপনি?’
‘উনি দেবনাথ চক্রবর্ত্তী। কর্তাবাবুর বড় ছেলে। আর ইনি অমর নাথ চক্রবর্ত্তী কর্তাবাবুর ছোট ছেলে সুধারাম পরিচয় করিয়ে দিল।
সৌমেন ঘাড় ঘুরিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাল। বৃদ্ধ কিছু বলল না। তিনি মাটিতে চোখ নামিয়ে নিলেন। দরজায় ডাক্তার বোস নক করে বললেন,‘আপনারা এসেছেন?’
ডাক্তার বোসকে দেখে দেবনাথ চক্রবর্ত্তী বলল,‘ডাক্তার বাবু, বাবা এখন কেমন আছে?’
‘এখন ভালো আছেন। কিন্তু উনার মধ্যে একটা এ্যাবনরমাল ব্যাপার আছে। প্রথম দিকে সত্যিই ঘাবরে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল। থ্যাংকস্ গড।’
‘সত্যি ডাক্তার বাবু আপনি না থাকলে কী যে হত।’
‘আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। সৌমেন বাবুই সব দেখভাল করেছেন। আর আমার যেটুকু দায়িত্ব আমি পালন করেছি। ধন্যবাদ দিতে চাইলে উনাকে দিন। আমি তাহলে রিলিস লেটার নার্সকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ ডাক্তার বোস বিদায় নিল।
‘দেবনাথ চক্রবর্ত্তী সৌমেনের দিকে এগিয়ে এসে বলল,‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ সৌমেন বাবু। আপনি না থাকলে সত্যিই বাবার খুব বিপদ হত।’
‘ঠিক আছে, আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। মানুষ হয়ে আর একজন মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাইতো কর্তব্য। কিন্তু আপনারা খবর পেলেন কীভাবে?’
‘ডাক্তার বোস আমাদের টেলিফোন করেছিলেন। বাবার ট্রান্সপোর্টের ব্যবসায় থাকার জন্যে মোটামুটি শহরের মানুষ আমাদের চেনেন।’
সৌমেনের খানিকটা খটকা লাগল। সে হিসেব মেলাতে পারল না। বৃদ্ধ বলেছিল তার কোনো সন্তান নেই। পাশ থেকে দেবনাথ চক্রবর্ত্তী বললেন,‘সুধারাম বাবাকে ধীরে ধীরে গাড়িতে তোল। আমরা এখনি রওনা হব।’
সুধারাম আর দেরি না করে বৃদ্ধকে আলতো করে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। সৌমেন বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে ছিল। বৃদ্ধ কিছু বলল না। তার চোখে জল। সৌমেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। সে সুধারামকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,‘দেবনাথ চক্রবর্ত্তী এবং অমর নাথ চক্রবত্তী আসলে কে?’
‘বললাম না কর্তাবাবুর ছেলে।’ সুধারাম বলল।
‘কিন্তু আপনার কর্তাবাবু যে বললেন, তিনি একা, তার কোনো সন্তান নেই।’
‘কর্তাবাবু এ কথা রেগে বলেছেন।’
‘রেগে বলেছেন!’
‘হু।’
‘কেন বলুন তো।’
সুধারাম এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু নিচু গলায় বলল,‘জীবনের শেষ সময়ে এসে যে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুর জন্য দিন গুণতে হয় সেই বাবার সন্তান থাকা আর না থাকা একই।’