সময়ের শ্রাবণ দিনের স্মৃতি



সময়ের শ্রাবণ দিনের স্মৃতি 
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

সময়টা ভালো কাটছেনা সময়ের।
ঘড়ির কাটা ধরে সময় চলে। কিন্তু মানুষের জীবনের ঘড়ির কাটা নেই। তা বলে জীবন তো থেমে নেই।
একদিন সময়ের জীবনে সব ছিল। সময়টাও জীবনের সাথে চলছিল। এখন না সময়, না জীবন কোনোটাই সময়ের সাথে নেই।
পিছনে তাকালেই দুঃসহ জীবন আর সময়। বসন্তের ঝরা পাতার মতো। মরা নদীর মতো। মৃত আগ্নেয়গিরির মতো।
কি হারিয়েছে সময় কে জানে, কেইবা বলতে পারে। কিন্তু যা হারায় তা কি কখনো ফিরে পাওয়া যায়।
শহরের ফুটপাত দিয়ে হেটে চলে সময়। লাল নীল নিয়ন বাতির রাত জ্বালানোর আলো। একটার পর একটা গাড়ির রাস্তার পিচ ঢালা পাথরের সাথে বেঁচে থাকার লড়াই। মানুষের মুখ আর মুখোশ। সব যেন চেনা শহরে অচেনা লাগে সময়ের।
সময়টা সময়ের এমন ছিলোনা। বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, হৈ চৈ একদিন ছিল এখন নেই। 
সময়ের এখন আর সেই দিনগুলি নেই। এখন সময়ের সাথে সময়রা চলে আর অন্য কেউও নয়। চারজন সময়।
হঠাৎ করেই জুটেছে এই বাকি তিনজন সময়। একদম সময়ের মতো দেখতে। চলা ফেরা, কথাবার্তার ধরণ  সবকিছু।
সময় নিজে সাদা রঙের হাল্কা টি-শার্ট আর চাপা জিনসের প্যান্ট পরে।
সময়ের সাথে আরো যে তিনজন সময় এখন সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়, তাদের একজন কালো টি-শার্ট, আরেকজন সবুজ টি-শার্ট আর অন্যজন হলুদ টি-শার্ট আর চাপা জিনসের প্যান্ট পরে।
সময় ভাবে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেলে। বুঝতে পারে না কিভাবে এই তিনজন সময় কিভাবে তার জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
কালো টি-শার্ট পরা সময় সময়কে বলে তোমার অতীতের কথা কি মনে আছে? নাকি ভুলে গেছ। তোমাকে অতীতে যারা বিপদে ফেলেছে তাদের কথা কি মনে আছে? এখন তো সময় হয়েছে তাদের বিচার করার। প্রতিশোধ নেবার।
সময়ের অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। সমুদ্রের বিশাল নোনা জল থেকে কয়েক ফোটা জল সময়ের চোখ দিয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে। মন অস্থির হয়। বন্দি পাখির মত ছটফট করে।
সময়ের বিয়ের দিন। চারিদিকে হৈ-হুল্লোড়, মাতামাতি। নন্দী গ্রামের স্মৃতির সাথে সময়ের বিয়ে।
বিয়ে হলো। স্মৃতির সাথে সময়ের প্রাণের বন্ধন সময়ের সাথে সাথে আরও দৃঢ় হলো। দিন যায়, রাত যায়। সময়ের পর সময় যায়। নদীর পানি এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রতে গড়িয়ে সময়ের সাথে হারিয়ে যায়। মেঘ বৃষ্টির খেলা হয়। বৃষ্টির জলে পিপাসার্ত মাটি আনন্দে নেচে উঠে। সবুজ ফসলে ভরে যায় ভরা যৌবনের মাটির আনন্দ। সময়ের চিরায়ত মিল মেলায় স্মৃতির গর্ভে সন্তান আসে। সময়ের মুখে হাসি ফোটে। কল্পনা আর বাস্তবের অদৃশ্য মিলন সময়কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কেরোসিন তেলের কুপির আলোটা নিভু নিভু করে সারা রাত ধরে জ্বলতে থাকে। সময় যেন ফুরাবার নয়। সবাই বলে সুখের সময় আসতে দেরি লাগে। কিন্তু দুখের সময়টা ঝড়ের মত আসে আর লুটপাট করে নিয়ে যায় মানুষের জীবন আর মন।
একদিন অমাবস্যার রাত আসে। সময় আর স্মৃতির মন মাছরাঙ্গা পাখির মত আনন্দে দোল খায়। যমজ সন্তানের জন্ম দেয় স্মৃতি। একটি মেয়ে, একটি ছেলে।
এক, দুই, তিন দিন করে বছর গড়ায়। সময় কাজ শেষে বাড়ি আসে। স্মৃতি, স্মৃতি ডাকে। সময়ের সামনে তিনজন স্মৃতি এসে দাড়ায়।
সময় অবাক হয়। মাথাটা হঠাৎ করে ঘুরে উঠে। চোখ কচলাতে কচলাতে সময় স্মৃতিকে বলে আরে পাগলী আমার সাথে এমন করছো কেন। কিন্তু সময় বুঝে উঠতে পারে না কে তার স্মৃতি।
স্মৃতির মাঝে স্মৃতি হারিয়ে যায়। সময় ভাবে আর ভাবে। কিন্তু তার স্মৃতিকে খুজে পায় না।
রাত আসে, দিন আসে। এক এক করে সব স্মৃতিরা একদিন হারিয়ে যায়। ফেলে রেখে যায় সন্তানদের। সময়ের মন পাগল হয়ে উঠে। সময় নন্দী গ্রামে স্মৃতির খোঁজে যায়। স্মৃতিদের বাড়ির সামনে এসে দাড়ায় সময়। দরজায় কড়া নাড়ে। একটা বৃদ্ধা মহিলা লাঠিতে ভর করে সময়ের সামনে এসে দাড়ায়।
কারে খুঁজো বাবা? বৃদ্ধা জিজ্ঞাস করে।
সময় বলে স্মৃতিকে। বৃদ্ধা বলে স্মৃতি তোমার কে হয়?
আমার বউ।
বৃদ্ধা হাসে। তোমার বউ স্মৃতি কেমন করে হয়?
সময় বলে, যেমন করে বিয়ে করলে বউ হয়।
কত বছর হলো তোমাদের বিয়ে হয়েছে?
এইতো তিন বছর।
কি বলো! বৃদ্ধা বলে।
স্মৃতি তো আরও দশ বছর আগে মারা গেছে।
সময় বলে, পাগল হলে নাকি দাদী।
বৃদ্ধা বলে, আমি পাগল না। তুই পাগল হয়েছিস।
সময় ভাবে আর ভাবে। কিভাবে বাস্তব কল্পনা হয়ে যায়, সময় তার কুল কিনারা খুঁজে পায় না।
সময় মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
সময় এখন পাবনায়। পাগলা গারদে।
অনেক দিন চিকিৎসার পর সময় আবার পাগল থেকে মানুষ হয়েছে।
সময় ছেলে মেয়ের জন্য বাসায় ছুটে যায়। কিন্তু সেখানে ঘর নেই, বাড়ি নেই, মানুষ নেই। খা খা মাঠ।
সময় সন্তানদের খুঁজে আর খুঁজে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না।
সময় আবার নন্দী গ্রামের দিকে ছুটে যায়।
স্মৃতিদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে।
আবার বৃদ্ধা বের হয়ে আসে।
সময় গড়িয়েছে নদীর মতন। বৃদ্ধা আরও বৃদ্ধা হয়েছে।
সময়ের বয়স আরও বেড়েছে।
সময় বৃদ্ধার দিকে তাকায়।
বৃদ্ধার দু’পা জড়িয়ে ধরে বলে, বলনা দাদী আমার স্মৃতি কোথায়? আমার সন্তানরা কোথায়?
বৃদ্ধা এবার আকাশের দিকে তাকায়। বিন্দু বিন্দু কাঁন্নার জল সময়ের মরচে ধরা গায়ে এসে পড়ে।
এবার বৃদ্ধা বলতে শুরু করে। স্মৃতিরা যমজ তিন বোন। জন্মের সময় মাকে হারায়। এরপর বাবাকে।
দিন যায়, রাত যায়। প্রকৃতি তিন বোনকে লালন পালন করে।
ওরা বড় হয়। দু’জনের দেশের বাইরে বিয়ে হয়।
কিন্তু ভাগ্য বুঝি তাদের সহায় ছিল না।
স্মৃতির দুই বোনের স্বামীরা একদিন আত্মহত্যা করে। কেন করে কেউ জানে না। কেউ বলতে পারে না।
স্মৃতির বোনরা দেশে ফিরে আসে। স্মৃতির সাথে পাশের গাঁয়ের শ্রাবণের প্রেম হয়। সময় বাড়ে প্রেম বাড়ে।
স্মৃতির দুই বিধবা বোনও শ্রাবণের প্রেমে পড়ে।
প্রেম নিয়ে তিন বোনের লড়াই শুরু হয়।
শ্রাবণ মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়। তিন বোনের মান অভিমানের খেলা হয়। স্মৃতির দুইবোন একদিন জোর করে সময়ের সাথে ওর বিয়ে করিয়ে দেয়। স্মৃতির মন ভাঙ্গে, প্রাণ ভাঙ্গে। কিন্তু শ্রাবণের প্রতি প্রেম ভাঙ্গে না।
দিনের পর দিন সময়ের সাথে স্মৃতি প্রেমের অভিনয় করে।
সময়ও বিষয়টা কখনও বুঝে উঠতে পারেনি।
একদিন স্মৃতির দুই বোন সময়ের বাড়িতে যায়। সময়কে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরিকল্পনা হয় রাতের আধারে ঘুমন্ত সময়কে মেরে ফেলার। কিন্তু স্মৃতি বুঝে উঠতে পারে না কেন তার বোনরা সময়কে মেরে ফেলতে চায়। হয়তো তাদের ভিতরের কালো মেঘ কিংবা অদৃশ্য প্রতিশোধ। যেমন তারা বিধবা হয়েছে তেমনি স্মৃতিকেও বিধবা বানাতে চায়। 
স্মৃতি সময়কে হয়তো ভালবাসেনি কিন্তু মনের অগোচরে সময়ের জন্য স্মৃতির কোথায় যেন একটা ভালবাসা না ভালবাসার জায়গা তৈরী হয়েছিল।
অস্থির হয় স্মৃতির মন। সময় আসে। মুখ খুলতে পারে না স্মৃতি। স্মৃতি বুঝতে পারে সময়কে সে ঠকিয়েছে।
সময় তো তাকে প্রাণ দিয়ে, মন দিয়ে ভালবেসেছে। কিন্তু সময়কে সে কিছুই দিতে পারেনি।
রাত আসে। দিন যায়। আবার রাত আসে।
একদিন স্মৃতি শ্রাবণকে সাথে নিয়ে ঘুমন্ত দুই বোনকে হত্যা করে। মুহুর্তেই স্মৃতি মানুষ থেকে খুনি হয়ে যায়। আচলে মুখ লুকায় স্মৃতি। শ্রাবণের সাথে হাত ধরে পাড়ি দেয় কোন গন্তব্যহীন ঠিকানায়।
সময়কে বাঁচাতেই স্মৃতি দুই বোনকে হত্যা করে।
সময় বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি না বলেছিলেন স্মৃতি দশ বছর আগে মারা গেছে।
বৃদ্ধা বলে, মিথ্যে তো বলিনি। দুই বোনকে হত্যা করে স্মৃতিও আত্মহত্যা করে।
তুমি যখন এসেছো তখন দশ বছর পেরিয়ে গেছে।
সময় অবাক হয়। ভাবে আর ভাবে।
যদি দশ বছর আগে স্মৃতি মারা যায় তবে সে দশ বছর কোথায় ছিল।
বুঝে উঠার চেষ্টা করে সময়। বুঝে উঠতে পারে না। মন খারাপ করে সে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরেই অন্য সময়দের সাথে তার দেখা হয়।
কালো টি-শার্ট পরা সময়কে সময় জিজ্ঞাসা করে, বলতে পারো আমার জীবন থেকে কিভাবে দশটি বছর হারিয়ে গেছে?
সময়কে সময় বলে, স্মৃতি যখন তোমাকে ফেলে চলে যায় তখন তুমি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলে। উম্মাদের মত তুমি চিৎকার করে  স্মৃতি স্মৃতি বলে বার বার ডেকেছো। নিজের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছো। দশ বছর তোমার চিকিৎসার পর স্মৃতিশক্তি ফিরলে তুমি নন্দী গ্রামে যাও। কিন্তু সেখান থেকে তুমি পাগল হয়ে ফিরে আসো। তোমাকে পাগলা গারদে পাঠানো হয়। এরপর চিকিৎসার পর চিকিৎসা। আরও পাঁচটি বছর কেটে যায়। তুমি ভাল হয়ে আবার নন্দী গ্রামে যাও।
বুড়ির সাথে দেখা হয়।
সময়ের পোড়া মন পোড়া মাটির মত হয়ে যায়। সময় কালো টি-শার্ট পরা সময়কে বলে কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ আমি নেবো। সময়ের। পোড়া কপালের। না মরে যাওয়া কয়েকটা মানুষের।
এসময় সবুজ টি-শার্ট পরা সময় সময়কে বলে সময় তুমি তো সময়ের সাথেই চলছো। সময় তোমাকে অনেক শিখিয়েছে। তোমার সন্তানদের কথা কি তোমার মনে পড়ে।
সময় ভাবে আর ভাবে। কিন্তু কোন কুলকিনারা খুঁজে পায় না।
সময়কে এবার হলুদ টি-শার্ট পরা সময় বলে, সময় এতো ভেঙ্গে পড়ো না। একটু ভবিষ্যতকে নিয়ে ভাবো। হয়তো তুমি জীবনে সব হারিয়েছো। কিন্তু এখনো তো অনেক সময় তোমার জীবনে পড়ে আছে। যে সময় হারিয়ে যায় তা নিয়ে ভাবতে নেই। যে সময় এখনও আসেনি তা নিয়ে ভাবতে হয়।
সময় ভাবে আর ভাবে। কোন কুলকিনারা পায় না। ভাবনায় ভাসতে ভাসতে আকাশ, নদী, সাগর, সমুদ্র, প্রকৃতি, জীবন পার হয়ে সময়, সময় থেকে সময়ে পাড়ি দেয়।
ঘুম ভাঙ্গে সময়ের। সময় ভাবে সময়দের নিয়ে। স্বপ্নের সময়। একজন সময়ের ভিতরের অতীত, একজন বর্তমান আর একজন ভবিষ্যত। ঘুমের ঘোরে সময় তিন সময়ের সময়দের দেখেছিল। কিন্তু স্বপ্নের বাইরে ছিল বাস্তবতা। স্মৃতির, স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকা। শ্রাবণের নিখোঁজ হওয়া। আর তার সন্তানরা। হয়তো বেঁচে আছে কিংবা বেঁচে নেই। কিন্তু সময় এখনো তো বেঁচে আছে। হয়তো বেঁচে থাকবে চিরদিন। কিংবা একদিন মরে যাবে সবার অগোচরে। কেউ তার আপন নয়। সব স্মৃতি। দুঃসহ স্মৃতি।
দিন যায়, সময় গড়ায়। রাজপথের হাজার মানুষের ভিড়ে সময় হারিয়ে যায়। হারানো সময় খুঁজে বেড়ায় তার স্মৃতির মুখ, সন্তানদের মুখ। হয়তো একদিন এমনি করেই পথ চলতে চলতে দেখা মিলবে একটি ছেলে, একটি মেয়ের। যারা তার আপন ছিল। কিন্তু আজ হারিয়ে গেছে। যেমন হারিয়ে গেছে সময়ের সময়।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট