আধ্যাত্মিক



আধ্যাত্মিক
ফারুক হোসেন সজীব


আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে কেউ বিশ্বাস করেন?
করলে ভাল না করলে নাই! বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর! বিশ্বাস না করলে খোদাও মিলবে না এমনই কথা বলে গেছেন কত যে মনীষী তার ইয়েত্তা নেই। মওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর বক্তব্য এখানে তুলে ধরা যেতে পারে তিনি বলেছেন, ‘বুদ্ধি, যুক্তি ও ভক্তি এক নয়। বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে চিনা, বুঝা, ও পাওয়া যায় না। বরং এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি! তিনি আরও বলেছেন, সৃষ্টি দিয়ে কখনও অসৃষ্টিকে বোঝা যায় না! আমরা মানুষ হলাম সৃষ্ট বস্তু কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ অসৃষ্ট সুতরাং আমরা অসৃষ্টকে কোনদিন বুঝতে পারব না। তাই আল্লাহকে চিনতে হলে ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রয়োজন।’
আধ্যাত্মিক বিষয়ে বিশ্বাস করা আসলে কঠিন যতক্ষণ না তা নিজ চোক্ষে দেখা যায়। তাই নিজের চোখকে কীভাবে অবিশ্বাস করব যখন পুরো ঘটনাটাই ঘটেছে আমার চোক্ষের  সামনেই!
তাহলে খুলেই বলি- আমার বয়স তখন ষোল কিংবা সতের। ভাল-মন্দ বোঝার অন্তত কিছু জ্ঞান আমার হয়েছে আর কী! তখন গরম কাল ছিল মনে আছে আমি আর আমার দাদিজান অনেক রাত অবধি উঠানে শুয়ে শুয়ে গল্প করতাম। দাদিজানকে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি হাতে তস্বি জপতে। খুব কম কথা বলতেন। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে অন্য গ্রাম থেকে ছুঁটে আসতেন দাদিজানের কাছে কীসব পানি পরা, তাবিজ সুঁতো নিতে। এগুলো দেখে দেখে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবতাম, এ আবার এমন কী! কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিষয়টি আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হতে লাগল। দাদিজানকে মনে হতে লাগল উন্মাদ একটি মানুষ। আমি কোন কিছু দেখে ভয় পেলে কিংবা পরীক্ষা দিতে যেতে নারভার্স ফিল করলে, তিনি আমার বুকে কী সব বলে বলে ঝাড় ফুঁক দিতেন। ঝাড় ফুঁক দেওয়া শেষ হলে বলে দিতেন, এখন তবে যা শরীর বন্ধ করে দিলাম! শরীর বন্ধ মানে কোন খারাপ আত্মা জ¦ীন, ভূত এমনকী খারাপ মানুষের কুনজর থেকে আমি মুক্ত! শুনে বেশ হাসি পেয়ে যেত আমার। তবু দাদিজানকে এ বিষয়ে কিছু বলতাম না! কী দরকার বুড়ো একটা মানুষকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার। তিনি তো আর কারও কোন ক্ষতি করছেন না। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনতাম দাদিজানের পানি পড়া খেয়ে অনেক মানুষ নাকি সুস্থ হয়ে যেতেন। শুনে আমি নীরব থাকতাম। আসলে মানুষের বিশ্বাসে হাতুড়ি পেটানো উচিত না। আমার স্কুল, বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে হওয়ায় খুব ভোরেই আমি টিফিন ক্যারিয়ার আর কাঁধে বইয়ের জীর্ণ ব্যাগটি ঝুলিয়ে বেরিয়ে যেতাম। তারপর আসতাম সেই সন্ধ্যা নাগাদ। আসা-যাওয়ার পথে তেমন কোন বাড়ি ঘর ছিল না। বলতে গেলে একটা মস্ত বিল পার হয়ে যেতে হত আর আসতে হত। বিল পার হওয়া কোন সমস্যা ছিল না, সমসা ছিল বিলের মাঝখানে একটি প্রকান্ড বটগাছটিকে নিয়ে। বুড়ো বটগাছটি যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। গাছটির চারিদিকে অসংখ্য বটের ঝুরি। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে পথে মানুষ বেশ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে গামছা বিছিয়ে বেশ আয়েশ করে জিরিয়ে নিত গাছটির ছায়ায়। আমি মাঝে মাঝে বটের ঝুরি ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো ঝুল খেলতাম। কিন্তু সন্ধ্যার সময় যখন বটগাছটির পাশ দিয়ে বাড়ি আসতাম বুকটা ঢিবঢিব করত। মনে হত এই বুঝি পিছন থেকে কেউ ডাক দিবে আমাকে, না হলে ঘাড় মটকাবে!
বটগাছটিকে নিয়ে অনেক কুৎসা রটনো ছিল। তবে এটা নাকী সত্যি গ্রামের ‘লবা’ ডাকাত অনেক মানুষ খুন করে গাছটির গোড়ায় পুঁতে রাখত। কেউ কেউ অমাবস্যা রাতে বট গাছটির উপরে আলোও দেখেছে। তবে এটা অবশ্য ঠিক গাছটির গোড়ায় অনেক পশুপাখির হাড়গোড় পড়ে থাকত সব সময়। একদিন আমি ভয়ে ভয়ে দাদিজানকে বললাম, দাদিজান আমার ভীষণ ভয় করে ঐ বটগাছটির কাছ দিয়ে যেতে। শুনে তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেন আর তস্বি জপতে লাগলেন। তারপর চোখ বড় বড় করে তাকাতেন। সেই বড় চোখ দেখে আমি ভয় পেতাম। দাদিজান বলতেন, হ্যাঁ ভয় আছে গাছটিতে! অনেক অভিশাপ বহন করে চলেছে গাছটি! অনেক মরা মানুষের সাক্ষী হয়ে নীরব দাঁড়িয়ে আছে! একদিন সে সব বলে দিবে! এসব শুনে আমার আরও ভয় ভয় করত, শরীরে কাটা দিয়ে উঠত। দাদিজান আমাকে বলতেন, তবে তোর কোন ক্ষতি হবে না! ওরা চেনে যে, তুই আমার নাতী!
ওরা কারা দাদিজান? আমি জিজ্ঞেস করতাম।
দাদিজান পান চিবাতে চিবাতে বলতেন, ওরা জিন-ভূত! অতৃপ্ত আতœা!
শুনে আমার আরও ভয় করত।
রাত বেশি হয়ে গেলে দাদিজান বলতেন, ঠিক আছে এখন ঘরে গিয়ে ঘুমা। আমরা সাধারণত উঠানে পাটি বিছিয়ে গল্প গুজব করতাম।
দাদিজানের মুখে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প শুনে কেন যেন আমার ঘুম আসত না। আর রাতে হিসু করতে কিংবা ইয়ে করতেও ভীষণ ভয় করত, কারণ আমাদের বাসায় কোন এট্যাস্ট টয়লেট এসব ছিল না! অবশ্য এসের কথা গ্রামের কেউ চিন্তাও করত না। আমাদের পায়খান, প্রশাবে ব্যবস্থা ছিল বাইরের তেতুল গাছটির নিচে! চারিদিক টিন দিয়ে ঘেরা আধা-পাকা বলা যায়! রাতে প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিলেই আম্মুকে ডাকতাম। আম্মু  বলতেন যা আমি দাঁড়িয়েই আছি! আসলে কিন্তু আম্মু দাঁড়িয়ে নেই! তিনি শুয়েই থাকতেন! এভাবে বলে তিনি আমাকে সাহস দিতেন।
দেখতে দেখতে আমার এসএসসি পরীক্ষা চলে এল। পড়াশুনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগলাম। গ্রামে আমিই একমাত্র তখন এসএসসি দিচ্ছি। সবার কুদৃষ্টি- সুদৃষ্টি দুটোই আমার ওপরে আছে।
একদিন পড়তে পড়তে বেশ রাত হয়ে গেছে। আসলে আমি স্কুল থেকে ফিরেই খাবার খেয়ে পড়তে বসতাম। রাত নয়’টা পর্যন্ত পড়তাম। গ্রামে রাত নয়’টা মানে কিন্তু অনেক রাত। পরিশ্রমী মানুষগুলো ঘুমের গভীরে তলিয়ে থাকে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। দরজা খুলে বাইরে চলে এলাম। সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিল দেখলাম, দাদিজান একা একা উঠানে তখনও বসে আছেন। আমি আস্তে আস্তে দাদিজানের কাছে গিয়ে জিঙ্গেস করলাম, দাদিজান কি করো?
দাদিজান বোধহয় বসে থেকেই ঘুমিয়েই পড়েছিলেন তবু বললেন, নাহ! জেগেই আছি! আয় বোস! তোর পড়া শেষ?
আমি বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, সামানে এসএসসি পরীক্ষা ভাল রেজাল্ট করতে হবে। এটা ভাবলেই দুচোখের পাতা  এক হয় না দাদিজান!
খুব চিন্তায় আছি! (আমার দাদিজান লিখতে পড়তে জানতেন। তিনি তাদের সময়ে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলেন)  দাদিজান আমাকে আশ্বস্ত করতে বলতেন, চিন্তা করে কাজ নাই, তুই ঠিক ভাল পাশ দিবি!
মনে মনে বলতাম, দিন বদলাচ্ছে দাদিজান ভাল রেজাল্ট না করতে পারলে কোথায় ভর্তি-চান্স পাওয়া যায় না। কম্পিটিশান! দারুণ কম্পিটিশান!

পূর্ণিমা রাত। চারিদিক দিনের আলোর মতো ফর্সা। বাড়ির চারিদিকে যদিও ঝোপঝাড় তবু সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমাদের উঠানের সামনে  তিনটি সুপারি গাছ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সুপারি ঝুঁলছিল। সুপারিগুলো পেকে একদম ঝুনাপাকার মতো লাল হয়ে আছে। দাদিজান পান খেতেন। মাঝে মাঝে দেখতাম তিনি সুপারিগুলো যাঁতি (সুপারি কাটার যন্ত্র) দিয়ে কাটছেন।
দাদিজান সুপারিগাছগুলোর দিকে মুখ করে বললেন, আজ পূর্ণিমা রাত!
আমি বললাম, হু জানি!
আজ তোকে আমার কেরামতি দেখাব! কী দেখবি?
কেরামতি! মানে?
আমার ক্ষমতা! কী দেখবি?
আমি নড়েচড়ে বসলাম অবাক হয়ে দাদিজানের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার মাথা ঠিক আছে?
দাদিজান হাসতে হাসতে বললেন, তুই তো আমার ক্ষমতাকে বিশ্বাস করিস না! তাই আজ তোকে আমার ক্ষমতার একটি নজির দেখাব!
 শুনে আমি হ্যাঁ না কিছুই বলছি না!
দাদিজান বললেন, এই যে সুপারিগাছগুলো দেখছিস, আমি আজ আমার ক্ষমত বলে সুপারি গাছগুলো থেকে সুপারির কাঁদি এক ঝাপটায় তোর সামনে এনে ফেলব!
দেখবি নাকী আমার ক্ষমতা?
আমি জোর সাহসে বললাম, দেখব! হঠাৎ অনুভব করলাম আমার বুকের ভিতরে ঢিবঢিব করছে। হয়ত অজানা কোন আশঙ্কা আমাকে ভর করছে! তবে টের পাচ্ছি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে!
দাদিজান আমাকে বললেন, সুপারিগাছগুলোর দিকে চেয়ে থাক!
আমি চেয়ে আছি সুপারিগাছগুলোর দিকে! মাঝে মাঝে দাদিজানের দিকেও তাকাচ্ছি!
দেখলাম, দাদিজান তস্বি হাতে উঁচু করে বৃত্তের মতো কী যেন করছে! হয়ত শূন্যে বৃত্ত-ই আঁকছেন তিনি!
হঠাৎ কীভাবে কোত্থেকে সুপারিগাছ তিনটি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল! যেন সূর্যের আলো-রশ্মি উপচে পড়ল গাছগুলোর মাথায়! তাপরপর এক ঝাঁপটায় একটি সুপারির কাঁদি এসে পড়ল আমার ঠিক সামনেই! ভয়ে আমি লাফ দিলাম! দাদিজান আমাকে বললেন, ভয় পাস না! ওরা তোর কোন ক্ষতি করবে না!
আমি পুরো হতভম্ব হয়ে গেছি দেখে! দাদিজান আমাকে বললেন, যা ঘর থেকে একটি ডালা (বেত দিয়ে তৈরি জিনিস) নিয়ে আয়! সুপারিগুলো তুলতে হবে!
আমি আচমকা ভয় পেয়ে একবার সুপারিগাছগুলোর দিকে আর একবার দাদিজানের দিকে তাকাচ্ছি। দাদিজান সুপারি গাছের দিকে তাকিয়ে আবারও বৃত্ত আঁকলেন। আমি দেখলাম, আস্তে আস্তে আলো রশ্মি নিভে যাচ্ছে! হঠাৎ কোথাও উধাও হয়ে গেল!
দাদিজান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখলি তো! এবার বিশ্বাস হয়েছে?
আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না! আসলে আমার ঘোর তখনও কাটেনি!
দাদিজান সুপারি কুড়াতে লাগলেন। আমাকে আবারও বললেন, যা ডালা নিয়ে আয়! আমি এক ছুঁট ঘরে চলে গেলাম। জানালা খুলে উঁকি দিয়ে দাদিজানকে দেখতে লাগলাম!
দাদিজান তখনও সুপারি কুড়াচ্ছেন উঁবু হয়ে, যেন সাদা শাড়ি পরা অপিরিচিত কেউ একজন! আমি হ্যাঁপাতে হ্যাঁপাতে আম্মুর রুমে গিয়ে সব খুলে বললাম। শুনে আম্মু বাহিরে চলে এলেন। দাদিজানের দিকে তেড়ে এসে বললেন, নাতীকে ভয় দেখিয়েছেন কেন? ওর যদি কোন ক্ষতি হয়?
দাদিজান আমায় কাছে ডাকলেন, আমি ওনার কাছে যেতেই ভয় পাচ্ছিলাম! তিনিই আমার কাছে এসে আমার বুকে ফুঁ দিলেন! বললেন, এখন ভয় গেছে? আমি অনুভব করলাম, সত্যি আমার আর কোন ভয় লাগছে না! হঠাৎ কী হল আমার! সত্যি কোন ভয় লাগছে না! মনে হচ্ছে সুপারিগাছে এক পৃথিবী আলো এসে পড়ল, তাতে আমার কী! এ আর এমন কী ক্ষমতা! তারপর থেকে আজ অবধি আমার কোন ভয় নেই। বলতে গেলে দারুণ সাহস হয়েছে আমার!
আজ কত বছর পার হয়ে গেছে। আমার দাদিজান এখন আর পৃথিবীতে নেই! আমাদের বাসার পাশেই কবরস্থান। সেই কবরস্থানেই আমার দাদিজান ঘুমিয়ে আছেন! জন্মের পর থেকে দেখে এসেছি তিনি কোন দিন কারও কোন ক্ষতি করেননি! বরং মানুষের উপকার করেছেন।
আহা! বড় ভাল মানুষ ছিলেন আমার দাদিজান! মাঝে মাঝে আমি নিশিরাতে কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকি, কারণ অনেক বছর তো হয়ে গেল আমার দাদিজান মারা গেছেন! তিনি কেমন আছেন? বড্ড জানতে ইচ্ছে করে!
আহা! আমার বাল্যকালের খেলার সাথি ছিলেন তিনি। সৃষ্টিকর্তার কাছে দুহাত তুলে এখনও মাঝ রাতে তার জন্য দোয়া করি! আর মনে মনে বলি-তোমার অনেক ক্ষমতা ছিল দাদিজান! আজ আমি সত্যি-ই বিশ্বাস করি তোমার অনেক ক্ষমতা ছিল! সেই ক্ষমতা বড়ই অলৌকিক! সেই ক্ষমতা আধ্যাত্বিক !


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট