ভাবগাম্ভীর্যে নির্ভেজাল প্রাকৃতিক কবিতার কবি : ব্যঞ্জন মৃ






ভাবগাম্ভীর্যে নির্ভেজাল প্রাকৃতিক কবিতার কবি
ব্যঞ্জন মৃ
 
মাহমুদ নোমান

মায়ের গর্ভে প্রত্যেকটা সন্তানের একেকটা পৃথিবী। সেখানে আনমনে শুনতে উদগ্রীব থাকে মায়ের মুখের কথাগুলো। কী এক ভাবুক,উন্নতর রুচিসম্পন্ন শ্রোতা জ্ঞানভারে গাল ফুলা রেখে, যেন মায়ের গর্ভে সবাই কবি...
সত্যিই, কবি। সবাই কিছু বলতে চাই। কল্পনাশ্রয়ী হয়ে বুনতে চাই মনের কথামালা। সেখান থেকে যাঁরা নিজেদের সময়- শ্রম ব্যয় করে কথামালা সাজানোর চেষ্টায় একেকজন আলাদা হয়ে যায় একেকজন থেকে ভাবে আর বোধে...
সত্য কথা এই, আমরা কেউ নিজের আসা মায়ের পথকে দেখি না বা প্রমাণ করার জন্য পথটা কাউকে দেখিয়ে দিতেও পারবো না। কবিতার উৎপত্তিও তো তেমন। প্রথম লাইনগুলো কোত্থেকে আসবে, শুধু অনুভব করবে, মনে ধাক্কা দেবে। সেটা সাজিয়ে বোধের দরজা খোলে একাগ্রতায় লেখা হয় একেকটি কবিতা; তাই, জন্মদাত্রী মাকে অস্বীকার করে কবি হয়ে ওঠা অসম্ভবরকম বাড়াবাড়ি। বরঞ্চ কেউ ভাবতে চাইলেও বিরক্তিকর। কেননা আজকাল অনেকে কবিতাকে ইট-পাথরে বন্দি করে কি যে নির্যাতন করে নিষ্পাপ শব্দরাজিকে। ভাবতেও বমি আসে...
সেই জায়গা থেকে কবি ব্যঞ্জন মৃ আমার কাছে শ্রদ্ধার আসনে। সে এক মায়ের ছেলে। সত্যিকারের এক মায়ের ছেলে। নিজের মায়ের ‘আচিক’ ভাষাকে বুকে লালন করেছে গর্বভরে। এটা আমার কাছে অজানা থেকে যেত। সেজন্য অকৃত্রিম বন্ধু চুনিয়ার পূর্ণিমার কাছে আমি ঋণী। নতুন একটা ভাবের পৃথিবীর দ্বার খুলে দিয়েছে আমার কাছে...
চুনিয়ায় না গিয়ে ব্যঞ্জন মৃ এর কবিতা যতোই পড়তাম, বোধে সুঁড়সুঁড়িও দিতে পারতো না হলফ করে বলতে পারি। কেননা আমি ‘আচিক’ ভাষাটা কী, সেটাও জানি না। পূর্ণিমা যখন চুনিয়ার শালবনে, আনারসের বাগানে নিয়ে যায় মাটি ঘেমে যাওয়ার গন্ধে, এরপরে ব্যঞ্জনের কবিতাগুলো মনে এসে আলাদা পরিবেশ তৈরি করে দিল। এটাও সম্ভব হয়েছে মান্দিদের উলে¬খযোগ্য কবি পরাগ রিছিলের অনবদ্য বাংলা অনুবাদের কল্যাণে। বলাবাহুল্য যে, পরাগ রিছিল মান্দি হলেও আচিক ভাষার পাশাপাশি বাংলায় পারদর্শিতার স্বাক্ষর ইতোমধ্যে রেখেছে। কেননা পরাগ রিছিলের কবিতা চর্চা মূলত বাংলা ভাষায়। এবং স্মরণ করতে হয় শ্রদ্ধাভরে রাজীব নূরের ভূমিকা লিখে দেওয়াটা, এই বইয়ের জন্য অমূল্য ও অভূতপূর্ব সংযোজন। এসব মিলেই ব্যঞ্জন মৃ এর কবিতার বই ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ ।

সত্যিকার অর্থে, ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ বইটি সর্বাত্মক আন্তরিকতার ফসল। পরাগ রিছিলের ভালোবাসাময় অনুবাদে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। বইটির প্রচ্ছদ থেকে সবজায়গায় ভালোবাসার ছড়াছড়ি, এক সুতোয় গাঁথা মালা...
ব্যঞ্জনও বইটার শুরুতে ভালোবাসার আহ্বানে লিখেছে ‘চলো’ কবিতাটি-

....হ্যা চলো,
কাছাকাছি-ই পৌঁছে গেছি
বসলে এখন হবে দুর্বল অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ,
অন্ধকারেই উঠেছে ফুটে মিল¬াম স্ফি’র স্ফুলিঙ্গ।

        [চলো (রি'রিমারি) ৯ প]

আমি যখন প্রথম চুনিয়ায় যাই, মান্দিদের আতিথেয়তা আমার অতীত অতিবাহিত জীবনধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। সত্যিকারের মানুষ যে এখনো এই বাংলাদেশেই আছে, সেটাই দেখেছি চুনিয়ায় গিয়ে। তাই কেউ সেখানে গেলে একা যেতে দেবে না। আপনাকে ছোটশিশুর মতো হাত ধরাধরি করে হাঁটা শেখাবে। সত্যিই তো, নতুন পৃথিবীতে চলতে শেখাল, সেটাই ব্যঞ্জনের উপরোক্ত কবিতায় আন্তরিকতায় বলে গেল। মনে পড়ে গেল, আমার মতো সেই মুগ্ধতায় এই চুনিয়ায় এসে কবি রফিক আজাদ লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা- ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’...

মাতৃসূত্রীয় মান্দি জীবনের জীবনধারার সামান্য কিছু আমার নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। মান্দিদের নারীরা যখন আনারস বাগানে বা রোদেগরমে পুড়ে মাঠে, উঠোনে এমনকি ঘরের কাজকর্ম সামাল দিতে দেখেছি; তখন পুরুষদের দোকানে বসে ঝিমিয়ে থেকে আড্ডা দিতে দেখেছি স্বয়ং নিজের চোখে! এখানে ব্যঞ্জন মৃ নিজ মায়ের বন্দনা তদুপরি মান্দিদের নারীজীবনের এসব দিক প্রায় সব কবিতায় অকপটে তুলে ধরেছে। আমারও হাজার সালাম জানাই, মান্দিদের এসব নারীদের...নিজের মা বিজন্তা মৃ’কে নিয়ে অনবদ্য ও অন্যমাত্রার আর ভাববিন্যাসের অপূর্ব গাঁথুনিতে লিখলেন-
বি- হলো আত্মা
জ- চোখের জল মুছিয়ে দেয় নিজ হাতে
ন্ - প্রতিদিন সেবা করো
তী- তাঁর সম্মান খুব উঁচুতে
সা- জ্বলজ্বলে রাখে জোনাকির মতো নিখিলের শ্রী
ং- চারদিকে বওয়ায় মাহারির সুনাম
মা- আমি আদরের সন্তান, ব্যঞ্জন মৃ ।
-আমার মা বিজন্তী সাংমা মৃ [(আংনি আমা বিজন্তী সাংমা মৃ) ২৭ পৃ]
কিন্তু এই আদিবাসী যখন নিজ বাসভূমে নিপীড়িত, এমনকি নিজেদের সারল্যতার সুযোগে ভূমিদস্যুরা খেতের মাঠ- জমি বেহাত করেছে। ব্যঞ্জনের কবিতায় তখন আদিবাসী বীরদের কথা, নিজেদের বাসভূমের জন্য জীবন দেওয়া শহীদদের কথা দৃপ্তকণ্ঠে ধ্বনিত; ব্যঞ্জনের মনে কষ্টের আবাদ হয়েছে। কেননা একজন কবির আলাদা চোখ থাকে, আলাদা মন থাকে। সেখান থেকে সমাজের, পরিবেশে আগত সমস্যা সবার আগে চোখে ও মনে ধরা পড়ে। তাই ব্যঞ্জন মৃ লিখলেন-

ধান শুকিয়ে ময়ূর
কান পেতে শুনছে
সেটি দেখে গাছ যেন
ধীর পায়ে এগোচ্ছে!
[শিরোনামহীন (বিমুং গ্রি) ১৩ পৃ]

কী মারাত্মক ভাবগভীর উপরোক্ত লাইনগুলো। উপমা- উৎপ্রেক্ষা- প্রতীকে ব্যঞ্জন মৃ একেবারে প্রাকৃতিক। প্রকৃতির বিশুদ্ধ নির্যাসে উদ্ভূত ভাব। নির্ভেজাল  আকুতিগুলো, চিত্রকল্পগুলো কাব্যরসিকদের অন্য জগতে মাতিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে-

মামাদের পুকুরে
শাপলা ফুটেছে,
সেটি তুলতে গিয়ে
পেটে জল ঢুকেছে
[মামার পানসুপুরি (মামানি পানগুয়া) ১৭পৃ]

ছন্দোবদ্ধ অন্তমিলে সহজাত বিষয়কে অসাধারণ বলনে এটি একেবারে চালাকি নয়। কেবল পরিবেশ- প্রতিবেশ ব্যঞ্জনের বলার রিদমে ও ভাবে মাটিমাখা; ব্যঞ্জনের কবিতা পড়তে পড়তে পাঠকরা ব্যঞ্জনের সাথে পুরনো আত্মীয়তার টান অনুভব করবে। ভালোবাসার কথা লিখতে পাঠকের সাথে খুনসুটি করে হাসায়েও দেয় মুহূর্তে-

ক.
কান- চুল কেমন এলোমেলো
মোছ ওঠেনি ঠিকমতো,
হৃদয় শুধু আছে বলে
হৃদয়ে হৃদয়ে কথা হলো -
[স্বামী (আংশি) ২১ পৃ]

খ.
সাহস নেই ভোলাব তোমায় নানা ঢঙে...
প্রিয়তমা তোমার জন্য সত্যি হৃদয় ভাঙে
কুষ্ঠের দাগ কী ফর্সা শরীরের সাথে তুল্য
হৃদয়ের ঔজ্জ্বল্যই সত্যিকারের ঔজ্জ্বল্য...
 [বিশ্বাস-অবিশ্বাস (বিবি রা’মা রা’জা) ১৯ পৃ]

গ.
কি সুন্দর পেখম মেলো
বর্ণিল গোল গোল!
দু’মি গুঁজতে গুঁজতে দেখি
তোমারি ভূগোল
[দু’মি গুঁজতে গুঁজতে (দু’মি খা’রারাম) ৪৩ পৃ]

ব্যঞ্জন মূলত ভাবগাম্ভীর্যে কবিতার সাধক। রক্তে বয়ে চলা মায়ের ‘আচিক’ ভাষার অক্ষরগুলো প্রতিনিয়ত নতুন কবিতা লেখার ধ্যাণে ধাবিত করে। পরাগ রিছিলের মহৎ অনুবাদে মধুপুরের চুনিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মান্দিদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা বাংলাভাষায় নানান রসদের যোগান দিয়েছে ব্যঞ্জন মৃ এর ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ কবিতার বইটি। ব্যঞ্জন মৃ কেবল আকুতি জানিয়ে রেখেছে বাংলাভাষীদের কাছে, এমনকি পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে, নিজের বাসভূমে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা। মান্দি জাতির আচিক ভাষায় সেই আকুতি বাংলাদেশীদের কাছে সম্মানীয় আসনে নেবে নিঃসন্দেহে ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ বইটির মাধ্যমে...





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট